আসল বয়সের খোঁজে!

মহীনের ঘোড়াগুলির একটা গান আছে—‘বাড়লে বয়স সবার মানুষ হয় কি?’ যেই প্রশ্ন মহীনের ঘোড়াগুলিরা করেছিল সত্তরের দিকে, সেই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেলেন এত দিনে! হ্যাঁ, জন্মসনদে বয়স ২৮ হলেও আপনার আসল বয়স যে ২৮, তা কিন্তু নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আপনার বয়স ২৮ হতে পারে, আবার ৩৮-ও হতে পারে! এমনকি ১৮-ও হতে পারে!

কী হেঁয়ালির কথা!

গবেষণায় জড়িত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি খোলাসা করার চেষ্টা করেছেন নিউ সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনের কনসালট্যান্ট হেলেন থমসন। সেটা নিয়েই ২০১৭ সালের জুলাই সংখ্যায় ‘আপনার আসল বয়স কত’ শিরোনামে মূল প্রতিবেদন লিখেছেন তিনি।

আমাদের সবার বয়স জন্মসনদে লেখা থাকে। একে বলে ক্রনোলজিক্যাল বয়স। এর মাধ্যমে জন্ম নেওয়ার পর থেকে আপনার বয়স কত হলো, সেটা বোঝায়। আমাদের আরও একটি বয়স আছে। একে বলে বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক বয়স। আমাদের শরীরের কোষগুলো কীভাবে ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে এর মাধ্যমে জৈবিক বয়স পরিমাপ করা যায়। বয়স নির্ণয়ের এই মাপ দুটি সব সময় যে মিলে যাবে, সেটা কিন্তু নয়। চারপাশেই ব্যাপারটা আমরা হরহামেশা ঘটতে দেখি। কারও কারও চেহারা দেখে বলি আপনার এত বয়স! দেখে তো মনেই হচ্ছে না! আবার কাউকে দেখে বলি, উনি বয়সের তুলনায় বেশ বুড়িয়ে গেছেন। আমাদের শরীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে গঠিত। এর কোনো কোনোটি খুব দ্রুত বুড়িয়ে যায়। আবার কোনোটি আস্তে আস্তে যায়।

কাগজে-কলমের বয়সের সঙ্গে শরীরের কোষের বয়স মেলানোর জন্য গবেষকেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা আসলে একজন মানুষ জীবনের কতটা সময় পেরিয়ে এসেছেন, আর কতটা আসেননি, সেটা বের করার চেষ্টা করছেন। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাগুলোতে একজন মানুষের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য কেমন যাবে, তা কাগুজে বয়সের চেয়ে জৈবিক বয়স থেকে আরও ভালো জানা যাচ্ছে। তা ছাড়া এটির মাধ্যমে আমাদের বয়স্ক হওয়ার গতি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। এমনকি রোগবালাই প্রতিরোধ করাও যাবে। আমাদের বয়স্ক হওয়ার ব্যাপারটাও কমানো যাবে।

একজন মানুষের আসল বয়স কত, তা জানতে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর এজিংয়ের গবেষক থমাস কির্কউড। তাঁর মতে, বয়স হলো ধারাবাহিকভাবে আমাদের শারীরিক দক্ষতা কমা, মৃত্যুর আশঙ্কা বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া। তবে সব প্রাণীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিন্তু এক রকম নয়। ‘অমর জেলিফিশ’ নামের এক প্রাণী আছে, যারা তাদের লার্ভা অবস্থায় ফিরে গিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় আসতে পারে। যদিও এই ক্ষমতা মানুষের নেই।

আমাদের বয়স কেন হয় অথবা আমরা কেন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হই? এর সবচেয়ে পরিচিত ব্যাখ্যা হলো টেলেমিয়ার্স তত্ত্ব। ক্রোমোজমের শেষ প্রান্তে টেলেমিয়ার অবস্থিত। কোষ বিভাজিত হয়ে বড় হওয়ার সময়ে এটি ক্রমেই ছোট হতে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে কোষটি ক্ষয়ে গিয়ে মরে যায়। এভাবেই একজন মানুষের মৃত্যু ঘটে। তবে কির্কউড নতুন আরেকটি ধারণার কথা বলেছেন। তিনি বলছেন, ডিএনএর বিভাজিত কোষের ত্রুটিগুলো ক্রমাগত সারার জন্য আমাদের শরীর শক্তি খরচ করে, তার বাইপ্রডাক্ট বা উপজাত হলো বয়স। কিছু কিছু প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জিন প্রাণীর জীবনকালের ওপর প্রভাব ফেলে, সেগুলো মেরামতের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়। এই কোষ বা টিস্যু একটু একটু করে আমাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

আর এখানেই বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক বয়সের ব্যাপার এসেছে। জৈবিক বয়স নির্ণয়ের মাধ্যমে আমরা জীবনকালের কোন অবস্থায় আছি, তা জানার চেষ্টা। তবে জৈবিক বয়স বের করা সহজ নয়। কারণ, কোনো পদ্ধতির মাধ্যমেই জৈবিক বয়সের পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় না। আবার কির্কউডও জানিয়েছেন, জৈবিক বয়স নির্ণয় করতে মানুষকে বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা তাকে বিপর্যস্ত করে।

তবে অনেক গবেষক বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড্যানিয়েল বেলস্কাই ও তাঁর দল। তাঁরা জৈবিক বয়স নির্ণয়ের জন্য ১৮টি মার্কার ঠিক করেছেন। এর মধ্যে রক্তের চাপ, কার্ডিওভাসকুলার ফাংশনও রয়েছে। তাঁরা এক হাজার লোকের ওপর গবেষণা করেন। গবেষণায় দেখা যায়, কিছু মানুষ জন্মতারিখের চেয়ে আরও দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছেন। কিছু মানুষ আবার কম হারে বুড়িয়ে যাচ্ছেন। এটা দেখেই তাঁরা জানান, কারও কাগুজে বয়স ৩৮ হলেও তাঁর জৈবিক বয়স ২৮ হতে পারে। আবার ৬৮ও হতে পারে।

অন্যদিকে কিংস কলেজ লন্ডনের জেমস টিমনস ও তাঁর সহকর্মীরা ১৫০ জনের জিন পরীক্ষা করে দেখতে পান যে ক্রনোলজিক্যাল বয়সের চেয়ে জৈবিক বয়সের সঙ্গে আলঝেইমার ও অস্টিওপোরেসিস রোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আবার সাংহাইয়ের চীনা একাডেমি অব সায়েন্সের জিং ডং জ্যাকি হান ও তাঁর সহকর্মীরা ১৭ থেকে ৭৭ বছর বয়সী ৩০০ মানুষের মুখের ত্রিমাত্রিক ছবি নিয়ে বয়স নির্ণয়ের একটি অ্যালগরিদম বের করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, একই বছরে জন্ম নিলেও মুখের চেহারাতে ছয় বছরের পার্থক্য রয়েছে। তবে ৪০ বছরের পর এই পার্থক্য আরও বেড়ে যায়।

হেলেন থমসনের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে হান জানিয়েছেন, শরীরের কিছু মলিকিউলারের পরিবর্তন আমাদের চেহারায় প্রতিফলিত হতে পারে। যেমন কারও যদি গাল কিংবা চোখের নিচে ফোলা থাকে, তাহলে এর সঙ্গে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলের সম্পর্ক রয়েছে। আবার কারও চোখের নিচে কালি জমলে, এর সঙ্গে রক্তসঞ্চালন অথবা কিডনির খারাপ অবস্থার সম্পর্ক রয়েছে। এসবের মানে হলো, আমাদের কাগুজে যে বয়স, তার চেয়ে বেশি বয়স দেখাবে। আর এসব কিছুই শরীরে ব্যাধি বাসা বাঁধার লক্ষণ।

আবার রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেও আসল বয়সের হদিস নেওয়া যায়। এই পদ্ধতি উন্নত করেছে চিকিত্সাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইনসিলিকো মেডিসিন। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা ৬০ হাজার নমুনা রক্ত নিয়ে পরীক্ষাটি করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, জন্মসনদের বয়সের চেয়ে যাদের রক্তের বয়স বেশি, তাদের স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি।

জৈবিক হোক কিংবা ক্রনোলজিক্যাল হোক, বয়স তো বাড়ছেই। কিন্তু একে কি কোনোভাবে থামানো যাবে? কিংবা বয়স হওয়ার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা যাবে? উত্তরে বিজ্ঞানীরা বলছেন—হ্যাঁ, যাবে! এই দলে আছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিভ হোরভাথ। ‘বিজ্ঞান কল্পকাহিনি মনে হলেও, তত্ত্বগতভাবে এটা সম্ভব!’ ‘তত্ত্বীয়ভাবে সব এপিজিনেটিক মার্কার ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে। তাই জীবনঘড়ির কাঁটাও আমরা উল্টে ফেলতে পারব।’ এমনটাই বলছেন তিনি।

অন্যভাবেও করা যাবে। যেমন আপনার তরুণ বয়সের রক্তের স্টেম সেল নিয়ে ফ্রিজিং করে রাখা হবে। এরপর আপনি যখন বুড়িয়ে যাবেন, তখন এটা ব্যবহার করে আপনার ইমিউন সিস্টেম পুনরায় নতুন করে তৈরি করা যাবে। তা ছাড়া অ্যান্টি-এজিং চিকিত্সারও উন্নতি ঘটছে। আমাদের জৈবিক বয়সের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অ্যান্টি এজিং চিকিত্সার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো যাবে। আর এই জন্যই আসল বয়স জানার এত তোড়জোড়।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট, জুলাই ২০১৭

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত