ঊনিশটি উদ্ভিদের ডিএনএ বারকোডিং করলেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানীরা

কেশরদামআবদুল গাফফার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি ১৯টি ভেষজ উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন। পরে সেই সিকোয়েন্স থেকে ডিএনএ বারকোডিংও করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষক দলটি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা দপ্তরের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দীন, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক এবং শিক্ষার্থী খালিদ মুশ্বান ও মো. শহিদুল হাসান । গবেষণাটিতে প্রতক্ষ্য সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএমএএম জুনায়েদ সিদ্দিকী।

চার গবেষক। বাঁ থেকে শেখ বখতিয়ার উদ্দীন, মোহাম্মদ ওমর ফারুক এবং খালিদ মুশ্বান ও মো. শহিদুল হাসান ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

গবেষক দলটি ১৯টি ভেষজ উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করে প্রত্যেকটি নমুনার তিনটি জিনের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচিত করেছেন প্রথমে। তারপর সেগুলোর ডিএনএ বারকোডিং সম্পন্ন করেছেন। ডিএনএ বারকোডিং হলো একটি নির্দিষ্ট জিন থেকে ডিএনএ এর একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যবহার করে প্রজাতি শনাক্ত করার পদ্ধতি।

এ গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ইথনোবোটানি ও ফার্মাকোগনসি ল্যাব এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবে। এ গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের ডিএনএ বারকোডিং করে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা। উদ্ভিদের শনাক্তকরণ, পৃথকীকরণ এবং শ্রেণীবিন্যাসে এই ডাটাবেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া বিপন্ন উদ্ভিদের তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো সংরক্ষণে সাহায্য করবে এই ডাটাবেজ।

উদ্ভিদের ভেষজ উপাদান ভেজালমুক্ত করা গোটা বিশ্বেই কঠিন কাজ বলে বিবেচিত হয়। গতানুগতিক পদ্ধতিতে উদ্ভিদের শনাক্তকরণ বেশ সময় সাপেক্ষ ও জটিল ব্যাপার। এক্ষেত্রে একটি উদ্ভিদ শনাক্তকরণে গবেষকের দক্ষতা, প্রশিক্ষিত জনবল, উদ্ভিদের ফুল/ফল ধারণের সময় ইত্যাদি অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। অন্যদিকে ভেষজ উদ্ভিদ সাধারণত প্রক্রিয়াজাত করে সরবরাহ করা হয়। ফলে এদের শ্রেণীবিন্যাসতত্ত্ব অনুসরণ করে উদ্ভিদের শনাক্ত করা অসম্ভব। আণুবীক্ষণিক, রাসায়নিক ও অন্যান্য পদ্ধতিতে ভেষজ উদ্ভিদের শনাক্তকরণ বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল। সংশ্লিষ্ট কর্মীর দক্ষতা ছাড়া ভুল হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য ডিএনএ বারকোডিং নামে এই শাখাটির জন্ম। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোনো স্থানে খুব সহজে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ভেষজ উদ্ভিদ উদ্ভিদের শনাক্ত করা সম্ভব। সাধারণ উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি সমান কার্যকর। এর ফলে উদ্ভিদের যে কোনো অংশ ব্যবহার করে শনাক্তকরণের মাধ্যমে সঠিক ভেষজ উদ্ভিদ চিহ্নিত করা, ভেজাল রোধ, মান নিশ্চিত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উন্নত বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। সর্বোপরি ডিএনএ বারকোডিং ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেষজ উদ্ভিদের প্রমাণীকরণ ও সম্পত্তি অধিকার নিশ্চিত করা যাবে।

বারকোডিংয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ নমুনা চট্টগ্রামের হাজারিখিল, ধোপাছড়ি অভয়ারণ্য এবং বান্দরবান সদর উপজেলার বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৯ টি উদ্ভিদের অধিকাংশই এন্ডেমিক প্রজাতির। এর আগে বাংলাদেশ থেকে এদের কোনো বারকোডিং করা হয়নি।

বারকোড করা ১৯ টি উদ্ভিদ প্রজাতি হলো, শিলছড়ি (Mussaenda roxburghii ), মরিচ্যা (Maesa indica), জলজি (Pouzolzia hirta), অংকিলতা (Dalbergia volubilis), গন্ধবিকচু (Homalomena aromatic), লৌহা কাঠ (Xylia dolabriformis), কেশরদাম (Ludwigia adscendens), হরিনা লতা (Tetrastigma leucostaphylum), হাড়জোড়া লতা (Byttneria pilosa),খাড়া গাইত (Floscopa scandens), হুর উদাল (Firmiana colorata), নাইন্ন্যা বিচি (Macaranga peltata), সুখ মুরালী (Eranthemum pulchellum), পাপরা (Gardenia latifolia), সিভিট (Swintonia floribunda), ঢেওয়া (Artocarpus lakoocha), ললনা (Premna esculenta), মেলা মরিচ্যা (Pilea melastomoides) এবং বন বেলী (Jasminum sp.)। এদের প্রত্যেকটির ঔষধি গুণাগুন রয়েছে। ১৯ টি উদ্ভিদ প্রজাতির ৩ টি জিনের ৪১ টি সিকোয়েন্স ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ডাটাবেজের জিনব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে।