ওমেগা ৩: কী, কেন?

আজকাল সুপারশপে বা ওষুধের দোকানে ওমেগা থ্রি ক্যাপসুলের কৌটা থরে থরে সাজানো দেখতে পাওয়া যায়। নিশ্চয় খেয়াল করবেন কেউ কেউ ও রকম কৌটা কিনে নিয়ে নিয়মিত ক্যাপসুল খান। আবার দেখবেন বাজারে কোনো কোনো ডিমের বাক্সে লেখা রয়েছে, এটা ওমেগা থ্রিসমৃদ্ধ ‘বিশেষ ধরনের’ ডিম। এ ধরনের কথা কখনো লেখা থাকে ভোজ্য তেলের বোতলের গায়েও। আর আমরা একটু বেশি দাম দিয়েই সেগুলো কিনে আনি। কেননা বলা হয় যে ওমেগা থ্রি হলো উপকারী চর্বি বা ফ্যাট, যা হৃদরাগ, স্ট্রোক ও ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি কমায়। এই ওমেগা থ্রি নিয়ে যে এত মাতামাতি চারদিকে, আসলে এটা কী? আর কেনই-বা এটাকে উপকারী বলা হচ্ছে?

আমরা যে চর্বি বা ফ্যাট খাই, তা আসলে নানা ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডের সমারোহ। ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হয় কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন অণু দিয়ে। এর মূল গঠনটা হলো একটা লম্বা কার্বন অণুর (সাধারণত জোড় সংখ্যার) শৃঙ্খল, যার এক প্রান্তে থাকে কার্বক্সিল যৌগ। প্রকৃতিতে নানা ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডে ২ থেকে ৩০টি পর্যন্ত কার্বন অণু দিয়ে তৈরি শৃঙ্খল দেখতে পাওয়া যায়। এই কার্বণ অণুর শৃঙ্খলের নানা ধরনের সমন্বয়ের কারণে তৈরি হয় নানা ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড। যে ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডে কার্বন অণুর শৃঙ্খলে কোনো দ্বৈত বন্ধন (Double bond) নেই, সেটা হলো সম্পৃক্ত চর্বি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট। যেটাতে একটি মাত্র দ্বৈত বন্ধন আছে, সেটা হলো মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। যদি দুই বা ততোধিক দ্বৈত বন্ধন থাকে, তবে সেগুলো হলো পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। যত অসম্পৃক্ত বা আনস্যাচুরেটেড, সেটা দেখতে তত আঁকাবাঁকা। সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড মূলত দেখতে সরল রৈখিক।

ওমেগা থ্রি ক্যাপসুলের কৌটা

আরেকভাবে ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোকে ভাগ করা যায়। কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড আমরা দেহের বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যান্য উত্স থেকে তৈরি করতে পারি। সেগুলোকে বলা হয় নন-এসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড। যেগুলো কোনোভাবেই দেহে উত্পন্ন করা যায় না, কেবল খাদ্যের মাধ্যমেই গ্রহণ করতে হয়, সেগুলো হলো এসেনশিয়াল বা দরকারি ফ্যাটি অ্যাসিড। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড হলো সেই ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি, যাতে অনেক দ্বৈত বন্ধন থাকে। প্রথম দ্বৈত বন্ধনটি শুরু হয় কার্বন শৃঙ্খলের শেষ মাথার ৩ নম্বর কার্বন অণু থেকে, তাই এর নাম ওমেগা থ্রি। এ ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড হলো এসেনশিয়াল গোত্রের, অর্থাৎ আমরা দেহে বিপাকক্রিয়ায় তৈরি করতে পারি না, তাই অবশ্যই খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়।

মানবদেহের জন্য তিন ধরনের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ: আলফা লিনোলিনিক অ্যাসিড, ইকোসা প্যান্টানোয়িক অ্যাসিড এবং ডেকোসা হেক্সানোয়িক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডগুলোর কার্বন শৃঙ্খলে যথাক্রমে ৩, ৫ ও ৬টি করে দ্বৈত বন্ধন রয়েছে। দেখা গেছে, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কার্যকলাপ, কোষের মেমব্রেনের গঠন, ধমনির স্থিতিস্থাপকতা সুরক্ষা, প্রদাহরোধী রাসায়নিক তৈরিসহ এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোর নানা ধরনের ভূমিকা রয়েছে আমাদের দেহে। তাই এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সঠিক অনুপাতে গ্রহণ করা জরুরি। যদিও ওমেগা থ্রি নিয়ে মাতামাতির শুরু সেই ত্রিশের দশক থেকে, কিন্তু ২০০৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রথম ঘোষণা দেয় যে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করলে হৃদরাগের ঝুঁকি কমে। ব্যস, এরপরই শুরু হয়ে যায় এই ওমেগা থ্রির মার্কেটিং। সারা পৃথিবীতে কেবল ওষুধের দোকানেই নয়, সুপারশপ বা মলে ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ হিসেবে বেচাকেনা শুরু হয় এই ওমেগা থ্রি ক্যাপসুলের। এটি কিনতে চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র লাগে না, তাই অন্যান্য ভিটামিন বড়ির মতো লোকে দেদার কিনে খেতে শুরু করে হৃদরাগ ঠেকানোর আশায়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে প্রমাণিত হয়েছে যে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করা ওমেগা থ্রি আসলে হৃদরাগ বা অন্যান্য রোগপ্রতিরোধে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না, বরং এটি গ্রহণ করতে হবে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা নানা ধরনের খাবারের মাধ্যমে। তাহলে আসুন দেখা যাক কোন ধরনের খাবারে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আছে।

ওমেগা থ্রির সবচেয়ে ভালো উত্স হলো তৈলাক্ত মাছ। স্যামন, সার্ডিন, হেরিং, ম্যাকারেল, ইলিশ, টুনাসহ সব ধরনের সামুদ্রিক মাছের তেলে এই ওমেগা থ্রি আছে। মজার ব্যাপার হলো, মাছেরা এই ওমেগা থ্রি পায় নানা ধরনের সামুদ্রিক আগাছা বা অ্যালজি থেকে। এ কারণেই মিঠা পানির মাছে অত বেশি ওমেগা থ্রি পাওয়া যায় না। যেসব মুরগি পরিবেশের নানা পোকামাকড়, আগাছা, প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে বাড়ে, তাদের ডিমেও পাওয়া যায় ওমেগা থ্রি। আজকাল বিভিন্ন ফার্মে তাই ওমেগা থ্রিসমৃদ্ধ বীজ বা মাছের তেল মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই মুরগির ডিমগুলোকে বলা হয় ওমেগা থ্রিসমৃদ্ধ ডিম। ঘাস খেয়ে বড় হওয়া গরুর দুধ থেকে তৈরি মাখনেও ওমেগা থ্রি বেশি। নানা ধরনের বীজ ও বাদামে পাওয়া যায় ওমেগা থ্রি। এর মধ্যে ফ্ল্যাক্সসিড তেল, ক্যানোলা তেল, কালোজিরার তেল বা ডুমুরের নাম বলা যায়। আখরোট ও হেজেল নাটে বেশ ভালো পরিমাণে ওমেগা থ্রি আছে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন হৃদরাগের ঝুঁকি কমাতে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন ওমেগা থ্রিসমৃদ্ধ তৈলাক্ত মাছ গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছে। সীমিতসংখ্যক রোগীর জন্য চিকিত্সা হিসেবে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী (দিনে ১০০০ মিলিগ্রামের বেশি নয়) ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে।

লেখক: চিকিত্সক ও সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, ঢাকা

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত