কত্ত কোষ আমাদের শরীরে!

গেস্টিমেশন। শব্দটা কি আপনার পরিচিত? পরিচিত না হলেও নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন। গেস আর এস্টিমেশন মিলেই তৈরি হয়েছে এমন গালভরা নাম। ব্যাপারটা অনুমানের, তাই নামটা দেখে আপনি যা অনুমান করছেন, তা-ই ঠিক। অনুমান করে কোনো কিছু পরিমাপ করাই গেস্টিমেশন।

ব্যাপারটা কেমন? ধরুন, খুব কঠিন একটা প্রশ্ন করলাম আপনাকে। আপনার শরীরে মোট কোষের সংখ্যা কত? প্রশ্নটা কঠিন বটে। তবে একটুখানি গুগল করতে দিলে আপনি হয়তো নিমেষেই বের করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু যদি বলি, গুগল করা চলবে না। আপনার জানা তথ্য দিয়েই হিসাব-নিকাশ করে বের করতে হবে, খুব কি কঠিন হবে কাজটা? আসলে কিন্তু তত কঠিন নয়। একটু চেষ্টা করলেই আপনি বের করে ফেলতে পারবেন সংখ্যাটা। তবে এ জন্য চাই একটু গেস্টিমেশনের অভ্যাস। অভ্যাসটা গড়ে উঠবে চর্চায়। চর্চাটা কেমন হবে, তার একটা উদাহরণই না হয় দেখানো যাক।

শুরু করা যাক ওই কোষের সংখ্যা বের করার চেষ্টা করেই। প্রথমে জানা দরকার আপনার শরীরের আয়তন কত। আপনার আয়তন যেহেতু এখন জানা সম্ভব নয়, তাই অনুমান করে নেওয়া যাক। কিন্তু অনুমান হতে হবে বাস্তবসম্মত। আয়তন অনুমান করার চেয়ে বরং আপনার ভর অনুমান করা সহজ। কিন্তু একদম কোনো তথ্য ছাড়া একজনের ভর অনুমান করা বড্ড কঠিন।

ধরে নিই আপনি একজন সুস্থ-সবল তরুণ। তাহলে আপনার ভর কমপক্ষে ৫০ কেজি। সর্বোচ্চ ওজন হতে পারে ১২২ কেজি। আমার এক বন্ধুর ভর ১২২ কেজি, এর চেয়ে বেশি ভরের কাউকে আমি চিনি না বলে এটাকেই ধরে নিচ্ছি একজন তরুণের ভরের ঊর্ধ্বসীমা। এখন এ দুটো ভরের গড় নিলে পাওয়া উচিত সাধারণ একজন তরুণের ভর। তবে নিতে হবে জ্যামিতিক গড়। সাধারণ গড় নিলে ভুলের আশঙ্কা থাকবে বেশি।

আপনি নিশ্চয় জানেন কীভাবে জ্যামিতিক গড় বের করতে হয়। সংখ্যা দুটোর গুণফলের বর্গমূল নিলেই পাওয়া যাবে জ্যামিতিক গড়। একটা ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাবটা করলে দেখবেন আপনি পাচ্ছেন ৭৭.৪৫৯৬৬৬৯ কেজি। আমরা যেহেতু কাজটা করছি অনুমান করে, তাই দশমিকের পর এতগুলো ঘর নিয়ে কাজ নেই। তাতে এমন কোনো শুদ্ধতা আসবে না, উল্টো হিসাব করা কঠিন হবে। তাই দশমিকের পরের সংখ্যাগুলো ফেলে দিয়ে সংখ্যাটা নেওয়া যায় ৭৭। চাইলে রাউন্ডিং করে ধরা যেতে পারে ৮০ কেজি। এটাই কাজ চালানোর জন্য বেশি সুবিধার।

আমরা যেহেতু আপনার ভরটা জানি না, তাই সাধারণ একটা ভর নিলাম। আপনি যেহেতু আপনার ভর জানেন, আপনি নিতে পারেন সে হিসাব করেও। এবার আয়তনটা বের করা যাক। ভর থেকে আয়তন বের করতে হলে জানা দরকার ঘনত্ব। মানুষের শরীরের ঘনত্ব কত? আমরা যেহেতু গুগল করব না, তাই অন্য কোনো বুদ্ধি করতে হবে। খেয়াল করলে দেখবেন, মানুষের শরীর পানিতে ডুবুডুবু হয়ে ভাসে, সাঁতার কাটতে গেলেই ব্যাপারটা টের পাবেন। অর্থাৎ পানির ঘনত্ব আর আমাদের শরীরের ঘনত্ব প্রায় সমান। তাহলে আমাদের শরীরের ঘনত্ব দাঁড়ায় ১ হাজার কেজি/ঘনমিটার। ঐকিক নিয়ম ব্যবহার করে খুব সহজেই এখন বের করা যাবে ৮০ কেজির আয়তন। ১ হাজার কেজির আয়তন যদি হয় ১ ঘনমিটার, তাহলে ৮০ কেজির আয়তন হবে ০.০৮ ঘনমিটার।

এখন আমাদের শরীর পুরোটাই কিন্তু কোষ দিয়ে তৈরি নয়। প্রায় ৬০ শতাংশ পানি। আবার প্রায় অর্ধেক পানি কোষেরই অংশ। বাকিটা তরলপ্রবাহী পানি হিসেবেই আছে আমাদের দেহে। তাহলে অন্তত ৩০ শতাংশ আয়তন পানির দখলে। কোষের আয়তন হবে ৭০ শতাংশের মতো। তাহলে আপনার দেহের সব কোষের আয়তন দাঁড়ায় ০.০৮´৭০/১০০ বা ০.০৫৬ ঘনমিটার।

আপনার দেহের সব কোষের আয়তন পাওয়া গেল। এবার একটা কোষের আয়তন জানা দরকার। একটা কোষ কত বড়? আমার জানা নেই। হয়তো আপনিও জানেন না। কিন্তু আমরা তো অনুমান করতে পারি, বুদ্ধি খাটিয়ে অনুমান করলে আসল মানের খুব কাছাকাছি একটা মানই পাওয়া উচিত।

খালি চোখে আমরা কোষ দেখতে পাই না। অর্থাৎ আমরা খালি চোখে যতটুকু দেখতে পাই, তার চেয়ে আমাদের শরীরের কোষ ছোট। কতটুকু ছোট হলে আমরা দেখতে পাই না? একটা স্কেল হাতে নিলে দেখবেন সেখানে মিলিমিটার (১০-৩ মিটার) পর্যন্ত দাগ দেওয়া আছে। এক মিলিমিটারের ১০ ভাগের ১ ভাগ দিব্যি দেখা সম্ভব। অর্থাৎ ০.১ মিলিমিটার ১০-৪ মিটারের চেয়ে কোষগুলো ছোট হবে।

এবার জানা দরকার, ঠিক কতটা ছোট হতে পারে। যদ্দুর মনে পড়ে, যে বিজ্ঞানী (তাঁর নাম মনে নেই, কিন্তু আমরা গুগল করতে চাই না) কোষ আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি একটা সাধারণ অণুবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। তার বিবর্ধন ক্ষমতা ছিল ১০ থেকে ১০০ গুণ। তার মানে হলো ১০-৬ মিটার বা ১ মাইক্রোমিটারের কোনো কণাকে ১০০ গুণ বড় করে আমাদের চোখের দেখার সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ একটা কোষের আকার কমপক্ষে ১০-৬ মিটারের বেশি।

আমরা কোষের আকারের একটা ঊর্ধ্বসীমা আরেকটা নিম্নসীমা পেলাম। সর্বনিম্ন ১০-৬ মিটার, সর্বোচ্চ ১০-৪ মিটার। এ দুই সীমার জ্যামিতিক গড় করলে আমরা পাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত দৈর্ঘ্য, ১০-৫ মিটার। যদিও কোষ ঘনক আকৃতির নয়, তবু ঘনক হিসেবেই কল্পনা করা যেতে পারে।

যদিও কোষকে গোলক কল্পনা করলেই বেশি শুদ্ধ হবে, তবু কোষের অভ্যন্তরে যে দুই কোষের মাঝের ফাঁকা জায়গা, তাতে তা বাদ পড়ে যাবে। যা-ই হোক, ঘনকাকৃতির কোষের এক ধারের দৈর্ঘ্য ১০-৫ মিটার হলে আয়তন হবে (১০-৫) বা ১০-১৫ ঘনমিটার।

আবার একটু ঐকিক নিয়ম ব্যবহার করা যাক। ১০-১৫ ঘনমিটার জায়গা লাগে ১টা কোষের। তাহলে ০.০৮ ঘনমিটার জায়গা লাগে ০.০৫৬/১০-১৫ বা ৫.৬´১০১৩ টা কোষের। এককথায়, আপনার শরীরে কোষের সংখ্যা ৫.৬´১০১৩ টা। অর্থাৎ ৫৬ ট্রিলিয়ন। সংখ্যাটা কত বড়? আমাদের ছায়াপথ তথা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে তারার সংখ্যা ১০১১ বা ১০০ বিলিয়ন। অর্থাৎ আপনার শরীরে কোষের সংখ্যা আমাদের গ্যালাক্সির তারার সংখ্যার চেয়ে প্রায় ৫৫০ গুণ বেশি!

এই হিসাব কতটা ঠিক? একদম ঠিক হিসাব হয়তো এটা নয়। কিন্তু অনুমান করে কাজ চালানোর পক্ষে যথেষ্ট। আমরা যদি আরেকটু শরীরতত্ত্ব জানতাম, যেমন মানুষের শরীরে কী পরিমাণ অকোষীয় পদার্থ থাকে, তাহলে আমাদের হিসাবটা হতো আরও ঠিক।

আপনি যদি এই বুদ্ধি ব্যবহার করে কোনো কিছু এস্টিমেট করতে চেষ্টা করেন এবং বারবার ব্যবহার করেন, তবে আপনার অনুমান হবে আরও যুক্তিসংগত, আরও বাস্তব। এবার একটা সমস্যা দেওয়া যাক আপনাকে। বাংলাদেশের সব মানুষ এক দিন দুপুরে কয়টা ভাত খায়? নিজেই হিসাব করে বের করুন।

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত