করোনা কি দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে?

একবার করোনাভাইরাস আক্রান্ত হলে কি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে ? করোনাভাইরাসের বিপরীতে তৈরি অ্যান্টিবডি কি আমাদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়? কিংবা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে? এতদিন এসব প্রশ্ন ছিল জনে জনে, সবার মনে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে একবার আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুবই কম, এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ হাতে ছিল না। এবার যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল থেকে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়া একদল জেলের রক্ত পরীক্ষায় এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া গেল।

এ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র এসপ্তাহেই প্রিপ্রিন্ট সার্ভার মেডরিক্সভিতে প্রকাশিত হয়েছে। এটা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার। এ গবেষণায় বেছে নেওয়া হয় ১২২ জন মৎসজীবীকে। মাছ ধরতে যাবার আগে ১২২ জনের দলটির ১২০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে আরটি-পিসিআর আর অ্যান্টিবডি টেস্ট দুটোই করা হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাগর পাড়ি দেবার পর পরই যাত্রীদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। তীরে ফেরার পর আবার পরীক্ষায় দেখা গেলো ১০৪ জন বা শতকরা ৮৫ ভাগ মৎসজীবী করোনাভাইরাস আক্রান্ত। এসব রোগীদের থেকে পাওয়া করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স করে প্রমাণিত হলো একজনের কাছ থেকেই অন্যদের মাঝে সংক্রমিত হয়েছে এই ভাইরাস। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য পাওয়া গেলো তা হলো, সাগর পাড়ি দিতে যাবার আগে যে তিনজন যাত্রী অ্যান্টিবডি টেস্ট পজিটিভ ছিল এবং যাদের শরীরে পরবর্তীতে ভাইরাকে নিষ্ক্রিয় করার মতো নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ছিল, তাদের মধ্যে এ রোগ সংক্রমিত হয়নি। তারা উপসর্গহীন ছিল এবং তাদের আরটি-পিসিআর টেস্ট এর ফলাফলও নেগেটিভ আসে। যেহেতু শতকরা ৮৫ ভাগ যাত্রী করোনাভাইরাস আক্রান্ত হবার পরেও, এই তিনজন সংক্রমিত হয়নি। কাজেই ধরে নেওয়া হয়েছে তাঁদের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি আছে বলেই তারা সুরক্ষিত ছিল।

খুব প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্য হলেও এ গবেষণার দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। প্রথমত, এ গবেষণা প্রমাণ করছে যে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি একজন রোগীকে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। আবার এসব তথ্য পরোক্ষভাবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে আশার আলো দেখাচ্ছে।

বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে

লেখক: ক্লিনিকাল মলিকুলার মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, সিদরা মেডিসিন ও সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ, দোহা, কাতার

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী দিব্যি সুস্থ হয়ে গেছেন কিন্তু তার আরটি-পিসিআর রেজাল্ট কিছুতেই নেগেটিভ হচ্ছে না, এমনকি দুসপ্তাহ পার হয়ে যাবার পরও! এমন অনেক কেস নিজের চেনা পরিচিতদের মধ্যে শুনতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই? এর ব্যাখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বেশিরভাগ দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হবার পর যারা কোয়ারেন্টাইন এ আছেন, বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে করোনামুক্ত ঘোষণা করার আগে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত দুবার টেস্ট নেগেটিভ হতে হবে। এর কারণ হলো রোগী যাতে অন্যদের মাঝে রোগ না ছড়ায় তা নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হওয়ার অনেক দিন পরেও বাধ্য হয়ে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হচ্ছে। আবার হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগীদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। রোগী সুস্থ হয়ে যাবার পরও তাকে রিলিজ দেওয়া যাচ্ছে না। অন্যদের সুযোগ দেওয়ার জন্য বেড খালি করা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো আরটি-পিসিআর টেস্ট পজিটিভ থাকা মানেই কি রোগী ছোয়াঁচে? সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় মনে হয়, এ ধারণায় পরিবর্তন আসছে। তবে এ নিয়ে কথা বলার আগে আরটি- পিসিআর এর মুলনীতিটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমারেজ চেইন রিএকশন বা আরটি-পিসিআর হলো এক ধরনের নিউক্লিইক অ্যাসিড এমপ্লিফিকেশন টেস্ট। অর্থাৎ এপদ্ধতির মাধ্যমে টেস্টটিউবে প্রথমে কোনো ভাইরাসের আরএনএ জেনোমকে অনুসরণ করে তার কপি-ডিএনএ তৈরি করা হয়। এরপর সেই কপি-ডিএনএ এর কোনো সুনিদৃষ্ট অংশ, কৃত্রিমভাবে সংখ্যায় বাড়িয়ে সেটাকে শনাক্ত করার পর্যায়ে নিয়ে আশা হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে আরটি-পিসিআর টেস্ট করে রোগীর শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনায় এভাবে ভাইরাসের আরএনএ শনাক্ত করার মাধ্যমে রোগী আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। পিসিআর নামে রাসায়নিক বিক্রিয়াটি ঘটানো হয় ধাপে ধাপে তাপমাত্রা ওঠা-নামা করিয়ে। একেকটি টেস্টে সাধারণত এরকম ৪০টি ধাপ বা সাইকেল থাকে। যত দ্রুত বা কম সাইকেলে ভাইরাসের আরএনএ শনাক্ত করা যাবে, তার মানে স্যাম্পলে তত বেশি ভাইরাসের আরএনএ রয়েছে। আর তা পরিমাপ করার ইউনিটটা হলো সাইকেল থ্রেশহোল্ড বা সিটি (CT) ভেল্যু। সিটি ভ্যালু যত বেশি, স্যাম্পলে ভাইরাস বা তার আরএনএ তত কম। কাজেই পিসিআর পদ্ধতিটি সেমি-কোয়ান্টিটিভ এবং এই টেস্ট করে আমাদের শ্বাসতন্ত্রে কী পরিমাণ ভাইরাস আছে বা ভাইরাসের সংখ্যা কত, তার সম্পর্কে একেবারে সঠিক না হলেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু এর পরেও টেস্ট রিপোর্টিং করার সময় সাধারণত সিটি ভ্যালু বা ভাইরাল লোড বা ভাইরাসের সংখ্যা প্রকাশ করা হয় না। টেস্ট পজিটিভ বা টেস্ট নেগেটিভ, এভাবেই রিপোর্ট করা হয়। এর কারণ হলো শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনায় স্যাম্পলে কী পরিমাণ ভাইরাস-আক্রান্ত মানবকোষ আছে তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। আবার যেহেতু বিভিন্ন স্থানে টেস্টের স্ট্যান্ডার্ডে তারতম্য আছে, তাই কোয়ালিটেটিভ রেজাল্টই দেওয়া হয়, কোয়ান্টিটিভ নয়।

একটা ব্যাপার জানা প্রয়োজন, আরটি-পিসিআর কিন্তু শুধু ভাইরাসের আরএনএ কেই শনাক্ত করে, পুরো ভাইরাসটাকে নয়। কাজেই আমাদের শ্বাসতন্ত্রে অবস্থান করা ভাইরাস সক্রিয় হোক বা নিষ্ক্রিয় হোক, ভাইরাসের আরএনএ থাকলেই ফলাফল পজিটিভ দেবে। ভাইরাস সক্রিয় না নিষ্ক্রিয়, তা জানতে প্রয়োজন ল্যাবরেটরিতে ভাইরাসের কালচার করা। কিন্তু ভাইরাসের কালচার করা বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া করোনাভাইরাসের কালচার করতে বিএসএল- ৩ লেভেলের ফ্যাসিলিটি দরকার হয়। রোগের রুটিন ডায়াগনোসিসের জন্য আজকাল কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না। বরং আরটি-পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে ভাইরাসের আরএনএ শনাক্ত করা গেলেই রোগী করোনাভাইরাস আক্রান্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের মাঝে রোগ ছড়াবে কিনা, তা নির্ভর করে রোগীর শ্বাসতন্ত্রে সক্রিয় ভাইরাসের সংখ্যার ওপর। সাধারণত রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর পর দুতিন দিন ধরে ভাইরাসের সংখ্যা থাকে সবচেয়ে বেশি, আর তখন যদি আরটি পিসিআর টেস্ট করা হয় তার সিটি ভ্যালু থাকে অনেক শক্তিশালী, যেমন ২৫ বা তার নিচে। এর পর রোগী সাধারণভাবে সুস্থ দেহের অধিকারী হলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধী শক্তির বলে ভাইরাস ক্রমেই তার বংশবৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং তার সংখ্যা কমতে থাকে। সেই সঙ্গে আরটি-পিসিআর টেস্ট করা হলে দেখা যায়, সিটি ভ্যালু ক্রমশই বাড়তে বাড়তে একসময় তা নেগেটিভ হয়ে যায়।

সমস্যা হলো কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবার পর, আরটি-পিসিআর টেস্টের ফলাফল দুর্বল হয়ে আসে। নেগেটিভ হতে অনেক সময় লেগে যায়। প্রশ্ন উঠছে এসব রোগী কি তখনও সংক্রামক? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় আরটি-পিসিআর এর পাশাপাশি ভাইরাসের কালচার করে দেখা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, আরটি-পিসিআর সিটি ভ্যালু যতই বাড়ছে সক্রিয় ভাইরাসের সংখ্যা ততই কমছে এবং সিটি ভ্যালু ৩৩ বা এর উপর উঠার পর থেকে কালচারে কোনো সক্রিয় ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে ফ্রান্স ও কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে একই ধরনের তথ্য আসছে। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়াতে ২৮৫ জন রোগীকে পরীক্ষা করা হয়ে। তাঁরা সুস্থ হওয়ার পর আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় আবারও পজিটিভ ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল। তাঁদের কারো ক্ষেত্রেই কালচার করে সক্রিয় ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। যদিও এসব রোগীদের সংস্পর্শে আসা ৭৯০ জন রোগীর মধ্যে ৩ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এসব গবেষণা ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে, আরটি-পিসিআর নেগেটিভ না হলেও সিটি ভ্যালু ৩৩ বা এর উপর হলেই, কোনো কোনো দেশ করোনা রোগীদের কোয়ারেন্টাইন থেকে বা হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ বিষয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন এবং বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থা এ নিয়ে এখনও নতুন কোনো নির্দেশনা দেয়নি , করোনা রোগীর সংখ্যা স্বাস্থসেবা বা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সাধ্যের বাইরে চলে গেলে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই হয়তো এধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

লেখক: ক্লিনিকাল মলিকুলার মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, সিদরা মেডিসিন ও সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ, দোহা, কাতার