করোনা ভাইরাস: ডেলটা ভেরিয়েন্ট ও ভ্যাকসিন

করোনাভাইরাসের ডেলটা ভেরিয়েন্ট এখন বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেরয়টার্স

করোনাভাইরাসের ডেলটা ভেরিয়েন্ট এখন প্রায় ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দুই মাসের মধ্যেই এই ভেরিয়েন্ট বিশ্বব্যাপী প্রধান ভেরিয়েন্ট হিসেবে ছড়িয়ে পড়বে। ডেলটা ভেরিয়েন্টটি আগে ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট বা বি.১.৬১৭.২ নামে পরিচিত ছিল। এই ভেরিয়েন্টের প্রথম আবির্ভাব ভারতে। পরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্য ও নেপালে। ভারতে কোভিড মহামারির ভয়ংকর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মূল কারণই ছিল এই ডেলটা ভেরিয়েন্ট। ডেলটা ভেরিয়েন্টের তাণ্ডব দেখা গেছে নেপালেও।

বাংলাদেশে মূলত ১ জুন থেকেই মহামারির তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এই ঢেউয়ে ৮০ শতাংশ সংক্রমণই হচ্ছে অতিসংক্রামক ডেলটা ভেরিয়েন্ট দিয়ে। দেশে তৃতীয় ঢেউয়ের সূত্রপাত ভারতের সীমান্তবর্তী উত্তর-পশ্চিম জেলাগুলো থেকে শুরু হয়। জুনের শেষ ভাগে এসে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রতিদিন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ৫ জুলাই সারা দেশে এক দিনে কোভিডে মারা গেলেন ১৬৪ জন ও আক্রান্ত প্রায় ১০ হাজার। মৃত্যু ও দৈনিক আক্রান্তের দিক দিয়ে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। তাই সহজেই অনুমান করা যায় যে দেশ একটা বড় ঢেউয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মহামারি বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার অবশ্য দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন আরোপ করেছে ১ জুলাই থেকে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডেলটা ভেরিয়েন্ট এত মারাত্মক রূপ ধারণ করল কীভাবে? বর্তমানে যে ভ্যাকসিনগুলো রয়েছে, সেগুলো কি ডেলটা ভেরিয়েন্টের বিপরীতে কার্যকর?

ডেলটা ভেরিয়েন্টের উৎপত্তি ভারতে হলেও এর ওপর গবেষণা বেশি হয়েছে যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যে এখন ৯৯ শতাংশ সংক্রমণই হচ্ছে এই ইন্ডিয়ান ডেলটা ভেরিয়েন্ট দিয়ে। এ বছরের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যে ডেলটা ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয় বোল্টন শহরে। দুই মাসের মধ্যেই কেন্ট বা ইউকে ভেরিয়েন্টকে (বি.১.১.৭) পেছনে ফেলে প্রধান ভেরিয়েন্টে পরিণত হয় এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাজ্যে এখন তৃতীয় ঢেউ চলছে ডেলটা ভেরিয়েন্ট দিয়ে।

ডেলটা ভেরিয়েন্টটি (বি.১.৬১৭.২) হচ্ছে ইন্ডিয়ান ‘ডাবল মিউট্যান্ট’খ্যাত বি.১.৬১৭-এর তিনটি সাবটাইপের একটি। গত ডিসেম্বরে ভারতে শনাক্ত হয়েছে। ডেলটা ভেরিয়েন্টটির স্পাইক প্রোটিনে দুটি উল্লেখযোগ্য মিউটেশন ঘটেছে। একটি এর রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে (এল৪৫২আর) এবং অন্যটি ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটে (পি৬১৮আর)। স্পাইক প্রোটিনের এই দুই অংশ ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুগপৎ দ্বৈত মিউটেশনের কারণেই ডেলটা ভেরিয়েন্ট ‘ইউকে বা আলফা ভেরিয়েন্ট’–এর (বি.১.১.৭) তুলনায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ দ্রুতগতিতে সংক্রমণ বিস্তার করতে পারে। এই বিশেষ মিউটেশনই বি.১.৬১৭.২ ভেরিয়েন্টকে মানুষের ভেতরে টিকে থাকার জন্য একটি ‘বেস্ট ফিট’ ভাইরাসে পরিণত করেছে।

ডেলটা ভেরিয়েন্টের এল৪৫২আর মিউটেশনটি এর আগে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভেরিয়েন্টে। ২০ এপ্রিল ২০২১–এ প্রকাশিত সেল জার্নাল-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এল৪৫২আর মিউটেশনের উপস্থিতি রূপান্তরিত ভাইরাসটির কোষ সংক্রমণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে জীবাণু ছড়ানোর প্রবণতাও মূল ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ এই বিশেষ মিউটেশন নতুন ভেরিয়েন্টকে অতিসংক্রামক ভাইরাসে পরিণত করে। এ ছাড়া ওই গবেষণায় আরও দেখানো হয়, নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি এই ভেরিয়েন্ট ভাইরাসকে তেমন দক্ষতার সঙ্গে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। অর্থাৎ এই রূপান্তরিত ভাইরাসের ভ্যাকসিনবিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুই মিউটেশন ছাড়াও ডেলটা ভেরিয়েন্টে আরও ১১টি বিভিন্ন ধরনের মিউটেশন রয়েছে।

ডেলটা ভেরিয়েন্টের ওপরে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজারের ভ্যাকসিন কেমন কাজ করে, তা দেখার জন্য চলতি বছরের ৫ এপ্রিল থেকে ১৬ মে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড একটা সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষাটি চালানো হয় ১১ হাজার ৬২১ জন ইউকে ভেরিয়েন্টে ও ১ হাজার ৫৪ জন ডেলটা ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত মানুষের ওপরে। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে অক্সফোর্ড বা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ডেলটা ভেরিয়েন্ট দিয়ে সিম্পটোম্যাটিক কোভিড হওয়া থেকে সুরক্ষা দেয় মাত্র ৩৩ শতাংশ এবং ইউকে ভেরিয়েন্টের বিপরীতে ৫১ শতাংশ।

অন্যদিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ টিকা দিলে এর কার্যকারিতা বেড়ে দাঁড়ায় ডেলটা ভেরিয়েন্টের বিপরীতে ৬০ শতাংশ এবং ইউকে ভেরিয়েন্টের বিপরীতে ৬৬ শতাংশ। একইভাবে ফাইজার ভ্যাকসিনের দুই ডোজের কার্যকারিতা ডেলটা ভেরিয়েন্টের বিপরীতে ৮১ শতাংশ এবং ইউকে ভেরিয়েন্টের বিপরীতে ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ ডেলটা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ রোধে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ অত্যাবশ্যকীয়।

আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ভ্যাকসিন কি ডেলটা ভেরিয়েন্টের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে পারে? এটা দেখার জন্য পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড সম্প্রতি আরেকটি সমীক্ষা চালায় ডেলটা ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত ১৪ হাজার রোগীর ওপর। এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে ১৪ জুন তাদের ওয়েবসাইটের একটি প্রি-প্রিন্টে। এতে দেখা যায়, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ সিভিয়ার কোভিড এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা করে ৯২ শতাংশই। আর একটি ডোজের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৭১ শতাংশে। ফাইজার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ফলাফল দেখা গেছে। অর্থাৎ যাঁরা ফাইজারের দুটি ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাঁদের ৯৬ শতাংশ মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর যাঁরা একটি ডোজ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ মারাত্মক কোভিড থেকে মুক্ত ছিলেন।

এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ১৪ হাজার ডেলটা ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে যে ১৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের কেউই কোভিডে মারা যাননি। অর্থাৎ অক্সফোর্ড বা ফাইজার ভ্যাকসিন কোভিড থেকে মৃত্যু রোধ করেছে শতভাগ। তবে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের ভাষ্যমতে, ভবিষ্যতে মৃত্যু প্রতিরোধের পরিসংখ্যানটিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে। এই ‘রিয়েল লাইফ এভিডেন্স’ থেকে এটা নিশ্চিত, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ ডেলটা ভেরিয়েন্ট দিয়ে সংঘটিত মারাত্মক বা সিভিয়ার কোভিড থেকে সুরক্ষা দেয় গড়ে ৯৪ শতাংশ। আর যাঁরা ভ্যাকসিনের একটি ডোজ নিয়েছেন, তাঁরা মারাত্মক কোভিড থেকে রক্ষা পাবেন ৭৫ শতাংশ।

বাংলাদেশে বর্তমানে গড়ে প্রতি চারজনে একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ভাইরাসের বর্তমান রিপ্রোডাকশন রেট (আর-নট) হলো ১.৪ এবং ডাবলিং টাইম ১৪ দিন। অর্থাৎ প্রতি দুই সপ্তাহে কোভিড রোগীর সংখ্যা বেড়ে হচ্ছে দ্বিগুণ। প্রতি ১৫ দিনে কোভিডে মারা যাচ্ছেন এক হাজারের ওপরে। সংক্রমিত হচ্ছেন প্রায় ৬০ হাজার। সেই হিসাবে তৃতীয় ঢেউয়ে গড় মৃত্যুহার ১ দশমিক ৭। অন্যদিকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় প্রতি ৩০ দিনে মৃত্যু হচ্ছিল এক হাজার (১০ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল) এবং ৩০ দিনে আক্রান্ত হচ্ছিলেন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। সেই হিসাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৮৩। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দেশে কোনো ডেলটা ভেরিয়েন্ট ছিল না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় ঢেউয়ের মৃত্যুহার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মৃত্যুহারের দ্বিগুণ। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যুহার বাড়ার পেছনে কি ডেলটা ভেরিয়েন্ট দায়ী? এর উত্তর নিশ্চিত করে দেওয়া কঠিন। এটা হতে পারে ডেলটা ভেরিয়েন্ট মারাত্মক। তবে আরেকটি কারণও থাকতে পারে। তা হলো, তৃতীয় ঢেউয়ের শুরুটা কিন্তু সীমান্তঘেঁষা জেলাগুলোতে, যেখানে দৈনিক সংক্রমণের হার আকাশছোঁয়া এবং হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল। আর এ কারণেই হয়তো মৃত্যুহার দ্বিগুণ বেড়েছে। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে সরকারকে কোভিডের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বেশ পরিবর্তন আনতে হবে। রাজধানী শহরের বাইরের জেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে হবে দুই থেকে তিন গুণ। এ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যুহার ঠেকানো সম্ভব হবে না।

তবে কোভিড মহামারি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পন্থা হলো ভ্যাকসিন। কোভিড মহামারিকে পরাভূত করে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হলে দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে কোভিড টিকার আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত টিকার একটি ডোজ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষকে।

কোভিড-১৯ মহামারি এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে না। আগামী বছরেও থাকবে এই মহামারি এবং একটি ঢেউয়ের পর আরেকটি ঢেউ আসবে কয়েক মাস পরপরই। লকডাউন দিয়ে হয়তো সাময়িক সংক্রমণ কমানো যায়, কিন্তু এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নয়। মহামারি থেকে বের হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হলে যত দ্রুত সম্ভব দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। যেহেতু টিকার স্বল্পতার কারণে এই বছরই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই বৃদ্ধ এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দিতে হবে। এতে এই মহামারিতে অনেক জীবন বেঁচে যাবে। করোনাভাইরাসের ভেরিয়েন্ট যেটাই হোক, ভ্যাকসিন সব ভেরিয়েন্টের বিপরীতেই কমবেশি কার্যকর এবং জীবন বাঁচায় প্রায় শতভাগ।

লেখক: সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য