করোনার টিকা ও রক্ত জমাট বাঁধার তত্ত্ব

বিশ্বজুড়ে একযোগে চলছে টিকা প্রদান কর্মসূচী। কীসের টিকা তা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেও সবাই ঠিকই বুঝে যাবে। ব্লুম্বার্গের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ১৫৪টি দেশে প্রায় ৮৫ কোটিরও বেশি মানুষকে দেওয়া হয়েছে কোভিড-১৯-এর টিকা। কিন্তু এমন অভূতপূর্ব কর্মযজ্ঞের কিছু অতিবিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে, যা মোকাবেলা করতে আরেক দফা হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ইউরোপের কিছু দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর মানুষের শরীরে এক মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধা। যুক্তরাষ্ট্রে তখন পর্যন্ত এমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যায়নি। আর এই টিকা যেহেতু এফডিএ (যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) দ্বারা এখনও অনুমোদন পায়নি, তাই ইউরোপে এই টিকার ব্যবহারের বাধানিষেধ যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্রেও কিছু অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধার খবর পাওয়া যায়, তখন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের টনক নড়ে এবং দ্রুত জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা কার্যক্রমকে স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

ইউরোপে যে রক্ত জমাট বাঁধার খবর পাওয়া গিয়েছিল, তা সবই অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার ফলে হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি। সে পর্যন্ত প্রায় ২২০টির মত এমন অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধার কেস পাওয়া গিয়েছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার ফলে এমন ঘটনার সংখ্যা আধা ডজনের বেশি নয়। কিন্তু এদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা এখনও জানা যায় নি।

রক্ত নিয়ে এই সমস্যা এক বা একাধিক টিকা নেওয়ার ফলেই হোক না কেন, কোভিড-১৯ এর কারণে গগনচুম্বী মৃত্যুর হারের আমাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। এছাড়াও মনে রাখতে হবে কোভিড-১৯ আমাদের শরীরের রক্তসঞ্চালন তন্ত্রে বিশৃংঙ্খলার সৃষ্টি করে যার ফলস্বরূপ দেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। আর কোভিডের এই মারাত্মক প্রভাবের কারণেই ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও এর সর্বোপরি উপকারিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার ক্ষেত্রেও তাই। এই টিকার ফলে সারা বিশ্বে অগণিত মানুষের জীবন বাঁচছে।

কিন্তু তারপরেও টিকা সংক্রান্ত কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে তার জৈবিক কারণ জানা অতন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈশ্বিক টিকা প্রদান কর্মসূচি অনেক দিক থেকেই সর্বপ্রথম। প্রথম অনুমোদিত এমআরএনএ টিকা (ফাইজার ও মডার্না), সর্বপ্রথম বিশ্বব্যাপী টিকার জন্য অ্যাডিনো ভাইরাস ভেক্টরের ব্যবহার (অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন ও স্পুটনিক ফাইভ) এবং সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা। এ সবের পেছনে কেই বা সেই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী? আর কীভাবেই এটাকে হঠানো যাবে? আর সামনের দিনের টিকা তৈরির ক্ষেত্রে কী কী জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে?

এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীদের সেই বিরল রক্ত জমাট বাঁধার জৈবিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে- কী কারণে, কখন এবং কীভাবে এটি হচ্ছে। আর এই কারণ অনুসন্ধান কোনো সহজ কাজ না। এই রহস্যের সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণাদির পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। তারপরও কিছু তত্ত্ব পাওয়া গিয়েছে যা দিয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তত্ত্বগুলোর মাঝে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, যে কোনো একটি তত্ত্বই হতে হবে প্রধান সমাধান, বরং এর মধ্যে কিছু তত্ত্ব একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত। আর আমরা যত তাড়াতাড়ি এই কারণ খুঁজে বের করতে পারব তাতেই আমাদের লাভ। নিচে চারটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো:

অণুচক্রিকা সমস্যা

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের একটি কেস, যেখানে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার ফলে রক্তে অস্বাভাবিকতা দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে এই তত্ত্বের উদ্ভব। অস্ট্রিয়ার ৪৯ বছর বয়সী একজন নার্সের টিকা নেওয়ার পর তার শিরা ও ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে, একই সাথে তার রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায়। কিন্তু রক্ত জমাট বাঁধা এবং অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যাওয়া দুইটি বিপরীতধর্মী ঘটনা। কারণ আমাদের রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে অণুচক্রিকা। দেহে এই অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধারই কথা নয়।

বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিক কাই কাপ্পারস্মিথ ও গ্রেচেন ভোগল এর কিছু ব্যতিক্রম বর্ণনা করেন। ‘ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাসকুলার কোয়াগুলেশন’ নামে জটিলতায় অতিরিক্ত রক্ত জমাট বাঁধার কারণে অনুচক্রিকা সব ব্যবহার হয়ে যায়, ফলে এর পরিমাণ কমে যায়। হেপারিন নামক একটি জমাট প্রতিরোধী ওষুধ, যা যুক্তরাষ্ট্রে লাখো মানুষ নির্দিধায় ব্যবহার করে, এর সাথে বিক্রিয়ার ফলেও হিতে বিপরীত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত অণুচক্রিকা থেকে নির্গত প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪-এর সাথে যদি হেপারিন যুক্ত হয়, তাহলে আমাদের দেহ একে প্যাথোজেন হিসেবে বিবেচনা করে এবং দেহের ইমিউন সিস্টেম একে আক্রমণ করে বসে- ফলে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে।

সাবিনে আইচনার, একজন হেমাটোলজিস্ট, অস্ট্রিয়ার সেই নার্সের চিকিৎসা করেন। তার মনে হয়েছিল এই সমস্যা হেপারিন বিক্রিয়ার অনুরূপ। তাই তিনি জার্মানির গ্রাইফসোয়াল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ড্রিয়াস গ্রাইনাকার এর সাথে যোগাযোগ করেন, যিনি বিগত তিন দশকে এই বিষয়ের উপর বিস্তর গবেষণা করেছেন। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর এরকম আরও সমস্যা দেখা দিলে গ্রাইনাকার তাঁর দল নিয়ে কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়েন। দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ল্যাবে বসে তাঁরা রক্তের নমুনা বিশ্লেষণ করেন।

এপ্রিল মাসে গ্রাইনাকার ও তাঁর দল ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ তাদের গবেষণা নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তারা জানান, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রদান পরবর্তী রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত জটিলতা যাদের হয়েছে তাদের রক্ত বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেছেন। এদের সকলের দেহেই প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪ ও প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪-এর সাথে যুক্ত অন্য কোনো অণুর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি উপস্থিত।

একই দিনে নরওয়ের আরেকটি গবেষণা দল অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা গ্রহণ পরবর্তী জটিলতা নিয়ে ‌ ধরনের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। এর পর এটা নিয়ে একটা মিঠিং হয়। সেই মিটিংয়ে অ্যাডভাইজরি কমিটি অন ইমিউনাইজেশন প্রাক্টিসেস জানায়, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা গ্রহণের পর যাদের রক্ত জামাট বাঁধার জটিলতা দেখা গিয়েছিল, তাদের ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জনের দেহে প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪ এর এন্টিবডি পাওয়া গিয়েছে। অ্যাডভাইজরি কমিটি অন ইমিউনাইজেশন প্রাক্টিসেস হলো, সিডিসিকে টিকা সুপারিশ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে সহযোগিতে করে যারা।

গ্রাইনাকার এই জটিলতার একটি কাটখোট্টা নাম দেন- ভ্যাকসিন ইনডিউসড ইমিউন থ্রম্বোটিক থ্রম্বোসাইটপেনিয়া বা ভিট (VITT)। এই নিয়ে অনেক কিছু এখনো জানা বাকি। কিন্তু যদি এই তত্ত্ব সঠিক হয়, তাহলে বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করতে হবে শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকা নাকি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন উভয় টিকা আমাদের দেহে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।

গ্রাইনাকারে তত্ত্বের একটি অতন্ত্য গূরত্বপূর্ণ অর্থ রয়েছে। সাধারণত রক্ত জমাটজনিত জটিলতায় রোগীদের হেপারিন দিয়ে চিকিৎসা করে হত। কিন্তু যদি সেই রোগীর VITT থাকে, তাহলে এই চিকিৎসা হিতে বিপরীত হবে।

স্পাইক প্রোটিন সমস্যা

ওপরের তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তাহলে কোভিড-১৯ এর টিকার কিছু অজানা উপাদান, বিরল ক্ষেত্রে, দেহে প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪ এর বিরুদ্ধে অটোইমিউন বিক্রিয়ার উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। এর জন্য দায়ী (সম্ভাব্য) হলো স্পাইক প্রোটিন। যার দ্বারা করোনা ভাইরাস কোনো কোষকে আক্রমণ করে- যা প্রায় সকল টিকাতেই ইমিউন তন্ত্রের প্রশিক্ষণ টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর এই প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪-এর ভাঁজ ও খাঁজের গঠনের সঙ্গে স্পাইক প্রোটিনের গঠনের সাদৃশ্য রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের ইমিউন তন্ত্র যখন এই স্পাইক প্রোটিনকে আক্রমণ করা শিখছে, একই সাথে ভুলবশত এরা রক্ত জমাটজনিত প্রোটিনকেও আক্রমণ করে বসতে পারে। কারণ দুই ধরনের প্রোটিন দেখতে একই রকম।

গ্রাইনাকার এই তত্ত্বকে সঠিক বলে মনে করেন না। একটি অনলাইন আর্টিকেলে তিনি উল্লেখ করেন, ভিট আক্রান্ত রোগীর শরীরে উপস্থিত ‘ত্রুটিপূর্ণ’ অ্যান্টিবডি কোনো স্পাইক প্রোটিনকে আক্রমণ করছে, এমনটি তিনি ও তার দল খুঁজে পাননি। একটি সংবাদ সম্মেনলনে তিনি আরও জানান, এমন হলে অন্য টিকার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ থেকে যেত।

কিন্তু অন্যেরা মনে করেন স্পাইক প্রোটিনের ভূমিকা নিয়ে আরও গবেষণা করা উচিত। বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট ও ইউরোপ'স ইনোভেটিভ মেডিসিন্স ইনিশিয়েটিভের প্রাক্তন পরিচালক মিশেল গোল্ডম্যান জানান, কোভিডে আক্রান্ত যেসব রোগী কোনো টিকা গ্রহণ করেনি, তাদের অনেকেরই হেপারিন সংক্রান্ত অটোইমিউন সমস্যার দেখা গিয়েছে। তিনি মনে করেন স্পাইক প্রোটিন এই সমস্যার মূলে থাকতে পারে, কিন্তু এর জন্য প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪-এর সদৃশ গঠন দায়ী না।

তিনি বলেন, স্পাইক প্রোটিন হয়তো বা প্লেটলেটের সাথে সরাসরি বিক্রিয়া করে প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪ নিঃসরণে বাধ্য করে। চীনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, ইঁদুরের শরীরে এই স্পাইক প্রোটিন সেই সকল প্লেটলেটদের সক্রিয় করতে পারে, যাদের করোনাভাইরাসের সেল রিসেপ্টর বহন করার জন্য তৈরি। অন্যদিকে, ডিসেম্বরের এক গবেষণা দেখা গেছে, যেটি এখনও জার্নালে প্রকাশিত হয়নি-এই স্পাইক প্রোটিন আমাদের রক্তনালিকার কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। গোল্ডম্যান জানান, রক্তনালিকার কোষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এরা এমন পদার্থ নিঃসরণ করে যা প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪-এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। আর এই সংযুক্ত অণু ‘ত্রুটিপূর্ণ’ অ্যান্টিবডির টার্গেট হিসেবে কাজ করে। এই সব কিছুই ভিট রোগের লক্ষণ প্রকাশে ভূমিকা রাখে।

স্পাইক প্রোটিন আসলেই রক্ত জমাটজনিত সমস্যায় জড়িত কি না, তা এখনো গবেষণাধীন। আর এটি যদি সত্যি বলেও প্রমাণ হয়, তাও সকল কোভিড-১৯ টিকার জন্য তা হুমকি নয়। সকল টিকা করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করলেও একেক টিকায় একেক ভার্সন ব্যবহার করা হয়েছে। ফাইজার, মর্ডানা ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকায় এমন ভার্সন ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্পাইক প্রোটিনকে আরও স্থিতিশীল ও দীর্ঘ করেছে। গোল্ডম্যানের মতে, ইএমএ অনুমোদিত একমাত্র টিকা যাতে ‘অস্থিতিশীল’ স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হলো অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।

সন্দেহজনক সিকোয়েন্স

অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় করোনা ভাইরাসের একটি প্রতিলিপি ক্ষমতাহীন ভার্সন ব্যবহার করা হয়েছে। এটা যা মানুষের দেহে কোনো ক্ষতি করতে পারে না। পারে শুধুমাত্র স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে। এই পদ্ধিতে অ্যাডিনো ভাইরাস ভেক্টর ব্যবহার করা হয়। এটা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ছাড়াও জনসন অ্যান্ড জনসন ও রাশিয়ার স্পুতনিক ফাইভেও ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় ব্যবহৃত ভাইরাসের ভার্সন অন্যগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। কারণ, এ ক্ষেত্রে ভাইরাসের সিকোয়েন্সের ভেতরে টিস্যু প্লাসমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর (টিপিএ)-এর সিকোয়েন্সও অনর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেহে যখন স্বাভাবিকভাবে টিপিএ নিঃসৃত হয়, তখন এটি রক্ত জমাট প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে। কৃত্রিমভাবে তৈরি টিপিএ স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর রক্ত জমাট কমাতে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় এই টিপিএ জিনের কিছু অংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এটা স্পাইক প্রোটিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে এবং এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

ইউরোপের কিছু বিজ্ঞানীদের ধারণা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় এই টিপিএ এর আংশিক জিন অন্তর্ভুক্ত করার ফলে স্বাভাবিক রক্ত জমাট প্রক্রিয়ায় ব্যঘাত ঘটবে। কিন্তু এই তত্ত্ব প্রমানের জন্য এখনও পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছে ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি। আর যদি পিটিএ জিনের অংশের জন্যই রক্তে এমন অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, তাহলে যে সকল টিকায় এই জিন ব্যবহার করা হয়নি, যেমন জনসন অ্যান্ড জনসন, তাদের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা দেখা যাওয়ার কথা নয়।

হয়তো বা অ্যাডিনো ভাইরাস প্রযুক্তির অন্য কোনো দিক এই সমস্যার সৃষ্টি করছে। ফলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা দুই টিকায় একই রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অ্যাডিনো ভাইরাস রক্ত জমাটজনিত পদার্থ ক্ষরণের জন্য অণুচক্রিকাকে সংকেত দিতে পারে। কিন্তু আমাদের এটিও মাথায় রাখতে হবে, এখন পর্যন্ত জনসন অ্যান্ড জনসন টিকার সাথে রক্ত তঞ্চনজনিত সমস্যার কোনো সম্পর্ক এখনও নিশ্চিত করা হয়নি।

পাঁচমিশালি

এমনও হতে পারে আসলে অনেক কিছু একই সঙ্গে ঘটছে। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাঙ্গোনি হেলথের জরুরি মেডিসিন বিশেষঞ্জ ডেভিড লি বলেন, সব রোগীর ক্ষেত্রে যে একই কারণ থাকবে তা ভাবা ঠিক হবে না। আমরা যখন সব রক্ত জমাটজনিত সমস্যার রোগীদের একই কাতারে ফেলছি, তখন একটা পাঁচমিশালি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। লি ও তাঁর দল দেখিয়েছেন, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর দেহে নানা রকমের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যেগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেহের নিজের প্রোটিনকেই আক্রমণ করে বসে। এমনই একটি প্রোটিন হল অ্যানেক্সিন-২। প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪ যদি কোনো রোগীর অস্বাভাবিক রক্ত তঞ্চনের জন্য দায়ী হয়, তাহলে অন্য কোনো রোগীর ক্ষেত্রে অ্যানেক্সিন-২ বা অন্য কোনো ফ্যাক্টর দায়ী হতে পারে, বলে জানান লি। তিনি রক্ত জমাটে জড়িত ফিব্রিনোজেনের কথা উল্লেখ করেন। এই ফিব্রিনোজেন গুরুতর কোভিড-১৯ রোগী ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা পরবর্তী রক্ত সমস্যার রোগী, উভয়ের দেহেই অস্বাভাবিক পর্যায়ে পাওয়া গিয়েছে।

লির মতো আরও অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে আরো কারণ থাকতে পারে। নেদারল্যান্ডের র‍্যাডবোড বিশ্ববিদ্যলয় মেডিকেল সেন্টারের ভাস্কুলার ইন্টার্নিস্ট সাস্কিয়া মিডেলডর্প প্রথমে ভিট তত্ত্বকে সঠিক বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে যখন একজন ডাচ রোগীর, যে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা পরবর্তী রক্ত জমাটজনিত সমস্যায় ভুগছেন, রক্তের নমুনা পরীক্ষা করলেন তাতে প্লেটলেট ফ্যাক্টর ৪-এর বিপরীতে কোনো অ্যান্টিবডি খুঁজে পেলেন না। (গ্রাইনাকার এর মতে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য এমনটি হতে পারে।)

তারপরও বলা যায়, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগের দেহে এই অস্বাভাবিক রক্ত তঞ্চন সমস্যা অনেকগুলো কারণে হতে পারে। তাই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার চেয়ে টিকার মাধ্যমে সুস্থ্য হওয়া অনেক বেশি নিরাপদ বলে জানিয়েছেন সিয়াটলভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘প্যাথ’- এর এসেনশিয়াল মেডিসিন বিষয়ক সহসভাপতি ডেভিড কাস্লো। আমাদের দেহে যখন স্পাইক প্রোটিনের কিছু অংশ শনাক্ত হয়, তখন ইমিউন সিস্টেমের ক্রিয়ায় সামান্য ত্রুটি দেখা দিতে পারে। কিন্তু তাও এটি সম্পূর্ণ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ার থেকে বহু গুণে ভালো। স্বাভাবিকভাবে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে অনেক জটিলতা সৃষ্টির সু্যোগ থেকে যায়। যেমেন অনুচক্রিকার ক্ষতি থেকে অস্বাভাবিক রক্ত জমাট। কস্লো এর মতে, টিকায় যেহেতু ভাইরাসের টুকরো করা এক অংশ ব্যবহার করা হয়, তাই এ ক্ষেত্রে খারাপ কিছু হওয়ার সুযোগ খুব কমই থাকে।

ভ্যাকসিন সেফটি ডাটালিংক, যা সিডিসি ও নয়টি বৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বজুড়ে হাজারো বনামী রোগীর তথ্য সংগ্রহের জন্য, আগে থেকেই এমন জমাটজনিত সমস্যা খোঁজার চেষ্টা করছিল। এমন তথ্য জানিয়েছেন ওই প্রোগ্রামের একজন ইনভেস্টিগেটর ও উইস্কন্সিনের মার্শফিল্ড ক্লিনিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর ক্লিনিকাল এপিডেমিওলজি অ্যান্ড পপুলেশন হেলথের পরিচালক এড বেলঙ্গিয়া। তাঁর মতে যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য যে তিনটি টিকা অনুমোদিত হয়েছে, ভ্যাকসিন ডাটালিংকের তথ্যানুসারে তাদের একটিও কোনো হুমকি নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় জনের সেরেব্রাল ভেনাস সাইনাস থ্রম্বসিস সমস্যা দেখা দিয়েছিল, সেটি নিয়ে একটি সতর্কতা জারী করবে এই প্রোগ্রাম।

সারাবিশ্বে এই মহামারী এখনো তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। তাই অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণের পর যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তার সমাধান খুঁজে বের করা ও অন্য কোনো টিকা এমন হুমকি বয়ে আনবে কি না তা জানা অতি জরুরি। তবে বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা কোনো সমাধানে পৌছানোর আগ পর্যন্ত টিকা প্রদান কার্যক্রম চালু থাকবে না স্থগিত করা হবে তা নির্ভর করে স্বাস্থ্য কর্মকতাদের ওপর। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারীর সময় ইউরোপে প্যান্ডেম্রিক্স নামে টিকা দেওয়া হয়েছিল। তারপর ফিনল্যান্ড থেকে তথ্য আসে যে এই টিকা হয়তো নেক্রোলেসির সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত। (এই টিকা যুক্তরাষ্ট্রে আসেনি আর এখন এর উৎপাদন বন্ধ আছে।) যদিও অনেক বিজ্ঞানী এই টিকার সাথে নেক্রোলেপসির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত তা নিয়ে মতানৈক্য আছে।

কোভিড-১৯-এর মারণথাবা হয়তো সামনের আরো কয়েক বছর পর্যন্ত থাকবে। একই সঙ্গে বিস্তার করবে কোভিড-১৯-এর টিকা সম্পর্কিত ঝুঁকির বিতর্ক। ২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লুর স্ট্রেইন বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তেমনি বিজ্ঞানীদের ধারণা করোনা ভাইরাসও একদম বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। কিন্তু বর্তমান মহামারী আমাদের জীবদ্দশায় দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট। আর এর ‘সুবাদে’ আমরা বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেখতে পেয়েছি! ফলে আমরা খুব শিগগির রক্ত জমাটজনিত সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে, এ বলে আশা করাই যায়। আর যদি তা হয় তাহলে আমরা নতুন টিকা আবিষ্কারের পথে কী বাঁধা বিপত্তি আসতে পারে আর কীভাবে তার মোকাবেলা করা সম্ভব সেটিও জানা যাবে। আর জানা যাবে কেনই বা এমন অস্বাভাবিক রক্ত জমাট ঘটে।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র: দা আটলান্টিক-এ প্রকাশিত রক্সেন খামসির প্রবন্ধ অনুসারে।