কল্পবিজ্ঞানে ভবিষ্যতের শিশু

রেনেসাঁ ব্যান্ডের অসাধারণ সুন্দর একটি গান আছে—

আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।

আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, সেই শিশু বিশ শতকের কল্পবিজ্ঞানের কাছে ভবিষ্যতের শিশু, তাই না?

গানটির পরের কথায় যাই। আজ যে শিশু মায়ের হাসিতে হেসেছে—

থামুন, থামুন। ভবিষ্যতের শিশু মায়ের হাসিতে হাসবে!

গর্ভে শিশুকে দশ মাস দশ দিন কষ্ট করে লালন করে, অসহ্য গর্ভযাতনা সহ্য করে, শিশুর কোমল মুখ দেখে মায়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। শিশু হাসতে শেখে মায়ের মুখের হাসি দেখে। ভবিষ্যতের শিশুর গর্ভধারিনী মা থাকবে!

বিশ শতকের কল্পবিজ্ঞান ভেবেছিল, মায়ের গর্ভে নয়, অদূর ভবিষ্যতেই মানুষের তৈরি প্রযুক্তি শিশু জন্মের পুরো দায়িত্ব সামলে নেবে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে এরকম মাতব্বরি মোটেও পছন্দ করেনি বিশ শতকের মানুষ। এই একুশ শতকের আমরা কি পারি প্রযুক্তির এরকম ভূমিকা মেনে নিতে?

বিশ্বখ্যাত কবি ও দার্শনিক কাহলিল জিবরান বলেছেন, আমাদের সন্তানেরা আমাদের নয়। ওরা আসলে সময়ের সন্তান। আমাদের মধ্য দিয়ে আসলেও ওরা আসলে ওদের জীবনের দাবি মেটাতেই আসে। প্রাচীন কাল থেকে শিশুজন্মের রহস্য নিয়ে মানুষ ভেবেছে। প্রায় পরিপূর্ণভাবে তৈরি একটি মানব শরীর মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে এসে কেবলি বিস্ময় উপহার দিয়েছে। সেই মানুষ দিব্যি পূর্বপুরুষের নানা বৈশিষ্ট্য শরীরে-মনে ধারণ করে আসে। সতেরো শতকের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এই রহস্য সমাধানের কথা গুরুত্বের সাথে ভাবেননি। যখন ভাবলেন, প্রথমেই প্রশ্ন এলো—মায়ের ঋতুচক্রের রক্ত থেকে পুষ্টি নিয়ে যে ভ্রূণ বড় হতে থাকে, সেই ভ্রূণ সৃষ্টির জন্য ভূমিকা কার? মায়ের ডিম্বের, নাকি বাবার শুক্রাণুর? ভাগ হয়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা। কেউ হলেন ডিম্ববাদী বা ovist। তাঁদের মতে, ডিম্ব একাই এক শ। আবার কেউ হলেন শুক্রাণুবাদী বা spermist। তাঁদের জোর দাবি ছিল, শুক্রাণু একাই সন্তানের শুভ সূচনা করে। ১৬৯৪ সালে গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী নিকোলাস হার্টসোয়েকার স্ক্রু-ব্যারেলওয়ালা সরল মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার করেছিলেন। সেই প্রথম মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে শুক্রাণু দর্শন হলো।

কী কান্ড! ডিম্বাণু আর শুক্রাণুকে মিলেমিশে ভ্রূণ তৈরি করতে দেওয়ার জন্যও অপেক্ষা করতে হয়েছে! এই বাদানুবাদ পরের কয়েকশ বছর চলার পর ঊনিশ শতকের শেষের দিকে জার্মানীর অস্কার হার্টউইগ এবং ফ্রান্সের হারমান ফল নামের দুই জন বিজ্ঞানীর দেখা মিলল। এই দুই কীর্তিমান বিজ্ঞানী সাগরের তলদেশে বাস করা সাগর সজারুর (সজারুর মতো কাঁটাওয়ালা প্রাণী) উপর গবেষণা করে প্রমাণ করেন—ভ্রূণ গঠনে একটি ডিম্বাণু এবং একটি শুক্রাণু লাগে। কেবল ডিম্বাণু কিংবা কেবল শুক্রাণু ভ্রূণ তৈরি করতে পারে না।

মানুষের জন্মরহস্য এর পরও এক আজব বাজির কারখানা হয়ে ছিল। স্বাভাবিকভাবে ভ্রূণ উত্পাদনে অক্ষম কত কত ডিম্ব আর কত শুক্রাণু! একশ বছর আগেও সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতিদের আশার বাণী শোনাতে পারেনি বিজ্ঞান। কৃত্রিমভাবে দাতার শুক্রাণুর সাহায্যে গর্ভধারনের চেষ্টাকে ১৯২১ সালে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছিল। সামাজিকভাবে এই কাজ ব্যভিচারের সমতুল্য বলে মনে করা হত। গ্রিক দেবতা জিউস যেমন প্রচণ্ড রেগে প্রমিথিউসকে শাস্তি দিয়েছিলেন, সৃষ্টিকর্তা ঠিক সেভাবে শাস্তি দেবেন বলে ভয় দেখানো হতো। এইসব বিধিনিষেধ সন্তানহীন দম্পতিদের মাঝে যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল, তার সাথে তাল মিলিয়ে কল্পনায় বিজ্ঞানের দৌড়কে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও মিলল। বিজ্ঞান যখন অসহায়, তখনই তো ডানা মেলে দেয় কল্পবিজ্ঞান।

১৯২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পেপার পাঠ করলেন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জে বি এস হালডেন। ‘ডেডলাস, অর সায়েন্স অ্যান্ড দ্য ফিউচার’ শিরোনামের সেই পেপারে এক ফিকশন ভাবনা প্রকাশ করলেন তিনি। প্রজনন সম্ভাবনা সৃষ্টিতে কাজ করা বিজ্ঞানীদের কাছে প্রমিথিউসের পাপের ব্যাখ্যা করলেন। কী করেছিল প্রমিথিউস? আগুন আবিষ্কার করেছিল। পৃথিবীর মানুষকে সেই আগুনের ব্যবহার শিখিয়েছিল। অর্থাৎ ভৌত ও রাসায়নিক উদ্ভাবনের ঘটনা এটি।

হালডন ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এভাবে বললেও তিনি কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের ডানায় হাওয়া লাগিয়ে দিলেন। গর্ভের বাইরে সন্তান জন্ম দেওয়া যেতে পারে, এই ফিকশন ভাবনার খোরাক জুগিয়েছিলেন তিনি। কিছু কিছু কিন্তু সত্যিই নাড়া দেওয়ার মতন। কী রকম? বলছি।

হালডন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, বিশ্বের প্রথম মানব শরীরের বাইরে বেড়ে ওঠা শিশু জন্ম নেবে ১৯৫১ সালের মধ্যে। এভাবে শিশু জন্মদানের প্রক্রিয়াকে বলা যায় এক্টোজেনেসিস। এভাবে জন্ম নেওয়া শিশুকে বলা যায় এক্টোজেনিক শিশু। কীভাবে জন্ম নেবে এই রকম শিশু? হালডন সম্ভাবনার যে গল্প শুনিয়েছিলেন, তা এরকম—

বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া কোনো এক নারীর তরতাজা থাকা জরায়ু সংগ্রহ করবেন দুজন কাল্পনিক বিজ্ঞানী ড্যুপো এবং বিজ্ঞানী শুয়্যার্জ। বিজ্ঞানীদ্বয় গবেষণাগারে সেই জরায়ুকে ব্যবহার করতে থাকবেন একের পর এক শিশু জন্মের কাজে। পাঁচ বছরের ভেতর জরায়ুটি কার্যক্ষম ডিম্বাণু উত্পাদন করবে। সেই ডিম্ব সংগ্রহ করবে বিজ্ঞানীদ্বয়ের টিম। ডিম্বাণু নিষিক্ত করার কাজটি চলবে নিয়মিত ভাবে। অর্থাৎ, নিষিক্ত করার উপযোগী ডিম্বাণু উত্পাদনের কারখানা হয়ে যাবে গবেষণাগার। পর্যাপ্ত পুষ্টির যোগান দিয়ে ভ্রূণকে লালন পালন করবেন বিজ্ঞানী ড্যুপো এবং শুয়্যার্জ। কৌশল আয়ত্বে আসার পর যে কোনো জীবিত নারীর জরায়ু অপসারণ করে বিশ বছর পর্যন্ত গবেষণাগারে সংরক্ষণ করা যাবে। প্রতি মাসে প্রতিটি জরায়ু থেকে একটি করে নতুন ডিম্বাণু সংগ্রহ করে কিছু শুক্রাণু (এগুলো কোথা থেকে মিলবে, তা তিনি কখনো বলেননি) দ্বারা ডিম্বাণুগুলোর সাফল্যজনক নিষিক্তকরণের হার হবে একশ তে নব্বই।

ভ্রূণ নয় মাস প্রযুক্তির গর্ভে লালনপালন করে বাইরের আলোতে আনা হবে—নিয়মিত শিশু জন্মদানের এই ধারণাটা সত্যিই বৈপ্লবিক। হালডেন কল্পনায় যে ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন, সেখানে প্রতি বছর ৬০ হাজার শিশুকে আলোতে আনা হবে। তিনি ভেবেছিলেন, ১৯৬৮ সালের মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করবে ফ্রান্স। এর কিছুদিনের ভেতর এক্টোজেনিক শিশুরা হয়ে উঠবে বৈশ্বিক। স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া শিশুর চেয়ে এদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। তিনি হিসেব দিয়েছিলেন—বিশ্বের মাত্র ত্রিশ ভাগ শিশু জন্ম নেবে নারীর গর্ভে!

নারীর শরীর থেকে জরায়ু বের করে এনে সেটাকে প্রজনন যন্ত্র হিসেবে কাজে লাগানোর বুদ্ধিটা বিজ্ঞান বাস্তবে করতে পারেনি। হালডেনের এই ভাবনাকে এখনো ভুলের খাতায় রাখলেও বিজ্ঞানীরা যে জীবিত নারীর শরীর থেকে জরায়ু অপসারণ করতে পারবেন—এই ভাবনাটি কিন্তু সঠিক হয়েছে। নারীর শরীর থেকে জরায়ু সরিয়ে গবেষণাগারে রেখে লম্বা সময় ধরে ডিম্বাণু উত্পাদনের উত্স হিসেবে তরতাজা রাখার কাজ কিন্তু হচ্ছে। সেই ২০০১ সালে শুরু হয়েছিল এই কাজ।

উর্বরতার চিকিত্সক কুটরুক ওকটের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েই মেডিসিন কলেজ এক নারীর জরায়ুর টিস্যু সরিয়ে হিমায়িত পরিবেশে সংরক্ষণ করেছিল, কেননা সেই নারী শিশু জন্মদানের কাজটি ইচ্ছেমত সময়ে করতে চেয়েছিলেন। জরুরি কাজ শেষ করে সেই নারী বছর খানেক পর যখন নিজেকে গর্ভধারনের উপযুক্ত বলে মনে করলেন, তখন তার জরায়ুর টিস্যু ফেরত চেয়ে গবেষণাগার কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন। আবেদন মঞ্জুর হলো। নারীর জরায়ুতে আবারও বসানো হলো তরতাজা সেই টিস্যু। কয়েক মাস পর নারীর জরায়ু আবার আগের মতো নিয়মিত হারে হরমোন নিঃসরণ করতে শুরু করল, নিয়মিত মাসিক চক্র শুরু হতেই ডিম্বাণু উত্পাদন হতে থাকল। আজকাল এরকম জরায়ুর টিস্যু সরিয়ে আবার জরায়ুতে বসিয়ে সন্তান জন্মদানের সংখ্যা শত শত। আর স্বাভাবিক জন্মদান প্রক্রিয়ায় কাজ না হলে নানা বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিশু জন্মের ঘটনা এখন লাখ লাখ।

কাজেই, বিজ্ঞানী হালডনকে স্যালুট জানাতে চাই। এরপর মনে করতে চাই বৃটিশ লেখক আলডস হাক্সলিকে। তিনিও গবেষণাগারে জন্ম দেওয়া শিশুর ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ভাবনায় প্রযুক্তির সাহায্যে যে শিশু জন্ম নেবে, তারা হবে দুই রকমের। একদল মানুষ আরেকদল মানুষের দাস। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ লেখক আলডস হাক্সলির লেখা উপন্যাস ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এ আছে, সাবধানতার সাথে ডিম্ব এবং শুক্রাণু নির্বাচন করে কাঁচের পাত্রে মিশিয়ে কৃত্রিম জরায়ুতে বড় হতে দেওয়া হচ্ছে। একদল নিষিক্ত ভ্রূণকে পরিপূর্ণপুষ্টি দিয়ে বুদ্ধিমান ও স্বাস্থ্যবান মানুষের জন্ম দেওয়া হচ্ছে। একই সময়ে আরেক দল নিষিক্ত ভ্রূণকে দেওয়া হচ্ছে নির্ধারিত মাত্রায় বিষ। এতে এরা কম বুদ্ধিমান ও কম স্বাস্থ্যবান হয়ে জন্ম নিয়ে বুদ্ধিমান ও স্বাস্থ্যবান মানুষের সেবা করছে।

নিজের ভবিষ্যদ্বাণী কতখানি নির্ভুলভাবে ফলবে, তা জানতে দারুণ কৌতুহলী ছিলেন হাক্সলি। লেখক বলে কথা। আর তাই ১৯৫৮ সালে আমরা দেখি হাক্সলিকে, আরেকটি উপন্যাস নিউ ব্রেভ ওয়ার্ল্ড রিভিজিটেড-এর মাধ্যমে প্রথম টেস্ট টিউব শিশুকে নিয়ে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডে। সে সময় তিনি ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা। শিশু তৈরি কারখানা আর কৃত্রিম জরায়ু নিয়ে নিজের ভাবনা কোনো কাজে আসছে না ভেবে খুব হতাশ ছিলেন। লিখেছিলেন, বোতলের ভেতর শিশু আর কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রজনন হয়তো সম্ভব নয়। আরও লিখেছিলেন, আরও অনেক লম্বা সময় ধরে আমরা এলোমেলোভাবে জন্ম নেওয়া জরায়ুজ প্রজাতি হয়েই থাকব, তা বেশ বুঝতে পারছি।

কল্পবিজ্ঞান হতাশ হলেও বিজ্ঞান হাল ছেড়ে দেয় না, এইটাই আশার কথা। তাই তো হাক্সলির নতুন উপন্যাস লেখার ঠিক বিশ বছর পর সত্যি সত্যি জন্ম নেয় বিশ্বের প্রথম টেস্ট টিউব শিশু লুইস জয় ব্রাউন। আর হাক্সলির উপন্যাস লেখার পর ষাট বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, এখনো মানুষ জরায়ুজ-ই রয়ে গেছে। মায়ের জরায়ু ছাড়া জন্মদানের আর কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করা যায়নি। সেও এক প্রকার এলোমেলোভাবেই, কেননা মায়ের জরায়ুতে শিশু জন্মদানের কোনো ধাপকেই পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্বাভাবিক জন্মদানে ব্যর্থ হলে গবেষণাগারের সাহায্য নিয়ে বাবা-মা হওয়ার যে চেষ্টা এখন সামাজিকভাবে স্বীকৃত, তার ভাবনা ভাবতে পারেননি হাক্সলি কিংবা হালডন।

ক্রিসপার নামে একটি প্রযুক্তি এসে গেছে, যা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের যে কোনো ডকুমেন্টের মতো ভ্রূণের জেনেটিক কোড বদলে দিতে পারে। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গাট্টাকা’ চলচ্চিত্রের রিভিউতে রজার এবার্ট লিখেছিলেন, ভ্রূণের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং যেন হয়ে গেছে গতানুগতিক কাজ, অনেকটা আগেভাগে করা প্ল্যাস্টিক সার্জারির মতো। এই ভাবনা তাঁরা ভাবতে পারেননি, অথবা ভাবতে চাননি। ১৯২৩ সালে হালডন যেমন সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, আমরা ইতোমধ্যে প্রাণী প্রজাতির অনেককে বিলুপ্তির পথে পাঠিয়েছি। একই কাজ আমরা আমাদের নিজেদের উপর করব কি না, সেটা মনে হচ্ছে স্রেফ এক সময়ের প্রশ্ন।

লেখক: সম্পাদক, নবারুণ