কার হাতে উঠবে এবারের চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেল

দেশের বাইরে দেশ বইতে মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছিলেন, অক্টোবর মাস আসলেই নাকি ক্যালটেকের কিছু অধ্যাপকের মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। খিটখিটে এই ভাব সহসা কাটত না। এর কারণ আর কিছু না, নোবেল পুরস্কার।

বছর ঘুরে আবার এসেছে অক্টোবর। আজ (৪ অক্টোবর) দুপুর সাড়ে তিনটার সময় চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। কে বা কারা পাবেন এবারের এ নোবেল পুরস্কার? অনুমান করা বড় কঠিন। আমরা কেউই তো জ্যোতিষী নই। কাজেই, অনুমানের ভিত্তি আগের বছরগুলোর তথ্য। কারা পাচ্ছেন, কেন পাচ্ছেন। সমস্যা হলো, কোন বছর যে নোবেল কমিটি কোন দিকে যাবে, সেটা আগে থেকে আন্দাজ করা শক্ত। গবেষণার দিক তো আর একটা না!

এই লেখাটি তাই যতটা না নোবেল অনুমান, তারচেয়ে বেশি বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে বিষয়গুলো অনেক গুরুত্ব পাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা।

এমআরএনএ প্রযুক্তি

এমআরএনএ (mRNA) মানে, ম্যাসেঞ্জার আরএনএ। এক ধরনের রাইবোনিউক্লিক এসিড। মজা করে বলা যায়, ডিএনএর ছোট ভাই। ডিএনএতে নাইট্রোজেন ক্ষার হিসেবে থাকে এডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) এবং থাইমিন (T)। আরএনএতে থাইমিনের জায়গায় থাকে ইউরাসিল (U)। আরেকটি বড় পার্থক্য, ডিএনএ দ্বিসূত্রক। দুটো সুতো মইয়ের মতো প্যাঁচানো। আরএনএ এক সূত্রক, মানে, এতে সুতো একটাই।

বিভিন্ন ধরনের আরএনএ আছে। তার একটি এই ম্যাসেঞ্জার। বার্তাবাহক বা দূত। ডিএনএ দূত আরএনএকে পাঠায় রাইবোসোমের কাছে। রাইবোসোম দেহের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করে। কিন্তু কীভাবে এটা প্রোটিন বানাবে? গঠন কী হবে? এসব তথ্য ডিএনএর কাছ থেকে জেনে নিয়ে রাইবোসোমকে জানিয়ে দেওয়ার কাজ দূত আরএনএর।

এই আরএনএকে চাইলে দেহের প্রতিরক্ষা কাজে ব্যবহার করা যায়। ২০০৫ সালের একটি গবেষণাপত্রে এটা প্রথম উঠে এসেছিল। গবেষক—ক্যাটালিন কারিকো, মিখায়েল বাকস্টেইন, হুপিং নি এবং ড্রু ওয়েইসম্যান। তাঁরা দেখিয়েছিলেন, এমআরএনএতে নির্দিষ্ট তথ্য ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে কোষে পাঠানো সম্ভব। নির্দিষ্ট তথ্য মানে, নির্দিষ্ট কোনো রোগ-জীবাণুর তথ্য। কোষ তখন সে হিসেবে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।

মানবদেহ কাজ-ই করে এভাবে। বাইরে থেকে কোনো রোগ-জীবাণু ঢুকলে, সে অনুসারে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিবডি রোগ-জীবাণুকে নিজেই মেরে ফেলে, বা দেহের রোগ প্রতিরোধী অন্যান্য অংশগুলোকে জানায়, কী করতে হবে। একবার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেলে দেহ সেই রোগ-জীবাণুর কথা মনে রাখে। তাই পরে একই রোগের জীবাণু আবার ঢুকলে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। এখন কথা হলো, বাইরে থেকে রোগ-জীবাণু ঢোকার আগে শরীরকে সেই জীবাণুর ব্যাপারে জানানোর উপায় কী? এখানেই আসছে এমআরএনএ।

গবেষক ক্যাটালিন কারিকো ও ড্রু ওয়েইসম্যান

সাধারণত টিকার ক্ষেত্রে, কোনো রোগের দুর্বল বা মৃত জীবাণু দেহে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এর বিকল্প হিসেবে কারিকো ভাবলেন এমআরএনএর কথা। এতে দেহে সে রোগের জীবাণু আর ঢোকাতে হচ্ছে না আগের মতো। সরাসরি কোষকে জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে জীবাণুরোধে কী ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হবে।

১৫ বছর আগে প্রকাশিত এ গবেষণাপত্র তখন খুব একটা সাড়া পায়নি। কোভিড-১৯ এসে বদলে দিয়েছে সে পরিস্থিতি। কারিকো ও ওয়েইসম্যানের গবেষণার ওপর নির্ভর করে ফাইজার, বায়োএনটেক এবং মডার্না তৈরি করেছে করোনাভাইরাসের সবচেয়ে কার্যকর ভ্যাকসিন। আর, এমআরএনএ ভ্যাকসিন বলেই এটা তৈরি করা গেছে এত দ্রুত।

এ গবেষণার জন্য তাঁরা অনেকগুলো বড় পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। লস্কর-ডিবাকি ক্লিনিক্যাল মেডিক্যাল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড ২০২১ও গেছে তাঁদের ঝুলিতে। এই পুরস্কার যাঁরা পান, মজা করে বলা হয়, তাঁদের নোবেল পুরস্কার মোটামুটি নিশ্চিত। তবে, কিন্তু আছে একটা। সাধারণত কোনো গবেষণার কার্যকর প্রয়োগের পর এত দ্রুত নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। আরেকটি সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়, গবেষণাটির ক্ষতিকর কোনো দিক আছে কি না বা কোনো সমস্যা আছে কি না। সেক্ষেত্রে, এই গবেষণাটি এবার নোবেল পুরষ্কার নাও পেতে পারে। তবে সম্ভাবনা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে এটি নোবেল পুরস্কারের অন্যতম দাবীদার।

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুটো অংশ

ইমিউন সিস্টেম বা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণত লিম্ফোসাইট নামের রোগ প্রতিরোধক কোষের ওপর নির্ভরশীল। লিম্ফোসাইট এক ধরনের শ্বেতকণিকা। মেরুদণ্ড ও দেহের থাইমাস কোষে এদের উৎপত্তি। রক্ত ও দেহের লিম্ফ টিস্যু জুড়ে ছড়িয়ে থাকে এ কোষগুলো। বিজ্ঞানী ম্যাক্স ডি কুপার এবং জ্যাকুয়ে মিলার তাঁদের গবেষণার শুরুর দিকে প্রাণিদেহে এই কোষগুলোর কাজ ও এদের উৎপত্তি কীভাবে হয়, তা নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁরা দেখলেন, নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গে সমস্যা হলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কিছু অংশ-ই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তাঁরা গবেষণা করছিলেন মুরগি নিয়ে। ১৯৬০ সাল। মুরগির দেহে বুরসা অব ফ্যাব্রিকাস নামে এক ধরনের থলে থাকে। কুপার দেখলেন, এই থলি ফেলে দিলে মুরগি অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না। কিন্তু তবু ভিন্ন কোনো মুরগির দেহ থেকে চামড়া কেটে এনে লাগালে সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে। একে বলে স্কিন গ্র্যাফট। আবার, যেসব মুরগিতে বুরসা আছে কিন্তু থাইমাস নেই, এরা অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে ঠিকই, কিন্তু স্কিন গ্র্যাফটকে প্রত্যাখ্যান করে না। ততদিনে বিজ্ঞানীরা জানতেন, থাইমাসে রোগ প্রতিরোধ কোষ তৈরি হয়।

মিলারের একটা গবেষণার ওপর ভিত্তি করে কুপার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রথম দুই অংশবিশিষ্ট রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ধারণা দেন। একটি অংশে আছে অ্যান্টিবডি উৎপাদক বি-কোষ। আরেকটি অংশে আছে টি-কোষ। যার কাজ মূলত জীবাণুর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখানো এবং ব্যবস্থা নেওয়া। এই গবেষণা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের জগতে একটা বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। গত এক যুগে আবিষ্কৃত নতুন প্রায় সব ক্যানসার চিকিৎসা গড়ে উঠেছে এই ধারণার ওপর। কোভিড-১৯ এবং পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলা বিভিন্ন নতুন রোগের সংক্রমণের এই সময়ে এ আবিষ্কারটিও নোবেল পুরস্কারের অন্যতম দাবীদার।

বিজ্ঞানী ম্যাক্স ডি কুপার এবং জ্যাকুয়ে মিলার
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানী ম্যারি কিং

১৯৭০ এর দিকে ক্যানসার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্তন ক্যান্সার গবেষণা

গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল ভাইরাল ইনফেকশন। এ ধরনের ইনফেকশন থেকে কীভাবে ক্যানসার হতে পারে, তা-ই ছিল এসব গবেষণার মূল লক্ষ্য। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানী ম্যারি কিং নতুনভাবে ভাবলেন। তাঁর মনে হলো, বেশিরভাগ মানুষ হয়তো উত্তরাধিকারসূত্রে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ক্যানসার ইন্সটিটিউট থেকে প্রাপ্ত বিশাল ডাটাসেট (ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের তথ্যভাণ্ডার) ও গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে তিনি দেখান, বাবা-মা থেকে সন্তানের দেহে ক্যানসারের জিন আসতে পারে।

শেষপর্যন্ত ১৯৯০ সালে কিং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ক্যানসারের জিন শনাক্ত করেন। বিআরসিএ১। ক্রোমোসোম ১৭তে এর অবস্থান। এখন তাঁর এ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে স্ক্রিনিং ও টেস্ট পদ্ধতি। অর্থাৎ চিকিৎসকরা আগে থেকেই শনাক্ত করতে পারেন, কাদের দেহে এ জিন আছে। এবং সে অনুসারে ক্যানসার প্রতিরোধের ব্যবস্থাও নিতে পারেন।

এ গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে কিং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মেডাল অব সায়েন্স পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি নিঃসন্দেহে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক ড. অ্যান্থনি ফাউচি

এছাড়াও উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেতে পারেন ড. অ্যান্থনি ফাউচি, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক। গত ৫৪ বছর ধরে এইডস থেকে শুরু করে সার্স, মার্স, ইবোলা হয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও লড়েছেন তিনি। যদিও এ ধরনের কাউকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার নজির কম, তবু তাঁর নাম এ তালিকায় উল্লেখ না করলে তালিকাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

এছাড়াও নিউরোবায়োলজি, ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, বিভিন্ন নতুন ধরনের রোগের ভ্যাকসিন গবেষনা, ক্যানসার চিকিৎসাসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আরও দারুণ সব কাজ হচ্ছে। নোবেল পুরষ্কার পেতে পারেন সেসব গবেষকদের যে কেউ। এ লেখার সবই অনুমান। আসলে কী হবে, তা জানা যাবে আর কিছুক্ষণ পরেই।

এখন শুধু অপেক্ষা।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, ইনসাইড সায়েন্স, উইকিপিডিয়া