প্রাণীর জীবনের নীলনকশা লুকিয়ে থাকে এর জিনোমের মধ্যে। এখন যদি ডিএনএ নকশা করে করে পুরো জিনোমটাই তৈরি করে ফেলা যায়, সেটাকে কি একটা কৃত্রিম প্রাণী বলা চলে? ঠিক এ কাজটি করেছেন লন্ডনের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল অব মলিকুলার বায়োলজির গবেষকেরা। তাঁরা একটি এসকেরিয়া কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ পুরো নতুন করে ডিজাইন করে তৈরি করেছেন। ব্যাকটেরিয়া থেকে পুরোনো জিনোম বের করে নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন কোষের ভেতর। এর আগে সবচেয়ে দীর্ঘ যে ডিএনএ তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিমভাবে, এটি তার প্রায় চার গুণ বড়। তাই একে কৃত্রিম জীববিদ্যায় বড় একটি মাইলফলকই বলা চলে।
কৃত্রিম জিনোমের যে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হলো, সেটি কিন্তু দিব্যি বেঁচে আছে। যদিও সেগুলো সাধারণের চেয়ে দেখতে একটু আলাদা এবং বংশবৃদ্ধি করে সাধারণ ই. কোলাইয়ের চেয়ে অনেকটা ধীরগতিতে। এই কৃত্রিম ডিএনএ–সংবলিত ই. কোলাই অনুসরণ করে নতুন ধাঁচের সব নিয়ম। কারণ এর ডিএনএ তৈরি করা হয়েছে সাধারণের চেয়ে একটু ভিন্নভাবে। তবু সাধারণ ই. কোলাইয়ের মতো প্রোটিনই তৈরি করে থাকে এটি।
ডিএনএ সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি করতে পারা কেন এত বড় অর্জন? কারণ এর মাধ্যমে আমরা তৈরি করতে পারব প্রয়োজনীয় মেডিসিন কিংবা এনজাইম তৈরিকারী জীবাণু। এসব জীবাণুকে বলা যেতে পারে জীবন্ত কারখানা। যেমন ধরুন এই ই. কোলাই-ই ব্যবহার করা হয় ইনসুলিন তৈরি করতে। এভাবে যদি একটা জীবাণুর পুরো জিনোম তৈরি করে ফেলা যায় এবং প্রয়োজন অনুসারে নির্দিষ্ট কিছু অংশ বদলে ফেলা যায়, তাহলে আমরা এই জীবাণুকে ব্যবহার করে উৎপাদন করে ফেলতে পারব নতুন সব মেডিসিন বা প্রয়োজনীয় উপাদান।
জীবন্ত কারখানার একটা চ্যালেঞ্জ আছে। কখনো কখনো ভাইরাসের আক্রমণে নষ্ট হয়ে যায় সব ব্যাকটেরিয়া। জিনোমের একটা অংশ বদলে দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে নতুন ব্যাকটেরিয়া, যেগুলো ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারবে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে তথ্য পাওয়া যেতে পারে, পৃথিবীতে জীবের উদ্ভবের একদম প্রথম দিকে ডিএনএ কীভাবে বংশগতির ধারক হয়ে উঠেছিল, সে ব্যাপারে।
ই. কোলাইয়ের জিনোম তৈরি প্রায় চার মিলিয়ন ক্ষারকের জোড় দিয়ে। এত দীর্ঘ জিনোম কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি আগে। আগের সবচেয়ে বড় সফলতা বলা যেতে পারে এক মিলিয়ন ক্ষারকের জোড় তৈরি করাকে। যেটি করা হয়েছিল প্রায় সাত বছর আগে, মাইকোব্যাকটেরিয়ামের ওপর।
ডিএনএর মধ্যে চার ধরনের ক্ষারক—অ্যাডিনিন, থাইমিন, গুয়ানিন ও সাইটোসিন থাকে। এগুলো জোড়ায় জোড়ায় কয়েক হাজার থাকতে পারে একটা জিনে। লেখার সময় জেনেটিক কোডকে শুধু এদের অদ্যাক্ষর (A, T, G, C) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন, A=T দ্বারা বোঝানো হয়ে থাকে অ্যাডিনিন ও থাইমিনের জোড়। ডিএনএতে পরপর তিনটি ক্ষারকের জোড় নিয়ে তৈরি হয় একেকটা অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরির সংকেত। অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি হয় প্রোটিন। আর প্রোটিন শরীরের নানা রকম কাজ করে। রক্তে অক্সিজেন পরিবহন থেকে শুরু করে নড়াচড়া পর্যন্ত সবই প্রোটিন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের শরীর। কোনো একটা জীবে কোন প্রোটিনটি তৈরি হবে, সেটি নিয়ন্ত্রিত হয় জিনের এই জোড়গুলোর সিক্যুয়েন্স দ্বারা।
আমাদের শরীর ২০টি অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে প্রয়োজনীয় সব প্রোটিন তৈরি করে। ডিএনএতে পরপর তিনটি ক্ষারক নিয়ে একটি কোডন তৈরি হয়। প্রতিটি কোডন আসলে নির্দিষ্ট একটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের সংকেত। পরপর অ্যামাইনো অ্যাসিড জুড়ে তৈরি হয় প্রোটিন। জিনের ভেতর কোডন তৈরি হয় ৬৪ ধরনের। এর মধ্যে তিনটি কোডন সংকেত দেয় প্রোটিন তৈরি থামাতে হবে, সে ব্যাপারে। এগুলোকে বলে স্টপ কোডন। আর বাকি ৬১টি কোডন সংকেত দেয় মাত্র ২০টি অ্যামাইনো অ্যাসিড সংযোজনের। সেরিন নামের অ্যামাইনো অ্যাসিডের জন্যই আছে ছয়টি আলাদা কোডন!
কেন একটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের জন্য প্রাণীর কোষ একাধিক কোডন ব্যবহার করে, সেটা বিজ্ঞানীদের অজানা। এই গবেষকেরা ভাবলেন, কয়েকটি কোডন বাদ দিয়ে দেওয়া যায় কি না ই. কোলাই থেকে। সে জন্য তাঁরা কম্পিউটারে ই. কোলাইয়ের ডিএনএ ডিজাইন করতে শুরু করলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা পুনরাবৃত্তি কমিয়ে দিলেন। সেরিন তৈরির ছয়টি কোডন থেকে তাঁরা দুটি বাদ দিয়ে দিলেন। তিনটি স্টপ কোডনের একটি বাদ দিয়ে দিলেন। যেসব ক্ষেত্রে কোডন বাদ দেওয়া হয়েছে, সেখানে সেরিনের অন্য একটি কোডন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু। এভাবে পুনরাবৃত্তি কমিয়ে প্রায় ১৮ হাজার কোডন বদলে দেন বিজ্ঞানীরা। এরপর দীর্ঘ এই জিনোমটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করেন ল্যাবরেটরিত। এটি এখন তিন ধরনের কোডন ছাড়াই আগের মতো সব প্রোটিন তৈরি করতে পারবে।
তৈরি করা জিনোম ই. কোলাইয়ের কোষে প্রবেশ করানো একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এত লম্বা জিনোম প্রবেশ করানো কঠিন। তাই খণ্ড করে কৃত্রিম জিনোমের খানিকটা অংশ জুড়ে দেওয়া হয় ই. কোলাইয়ের কোষের ভেতর প্রাকৃতিক জিনোমে। এবং প্রাকৃতিক জিনোম থেকে একটা অংশ কেটে বের করে নেওয়া হয়। এ রকম বারবার একটু অংশ জুড়ে দিয়ে, একটু অংশ বের করে নিয়ে শেষে দেখা যায়, পুরো কৃত্রিম জিনোমকে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে কোষের ভেতর। এবং তখন আর কোষের ভেতর প্রাকৃতিক জিনোম অবশিষ্ট নেই। এরপর সেই কৃত্রিম জিনোমযুক্ত ব্যাকটেরিয়াকে কালচার করতে দেওয়া হয়। সেগুলো ধীরগতিতে বংশবৃদ্ধি করে তৈরি করে নতুন প্রজন্মের ই. কোলাই, যাদের ডিএনএ ৬১টি কোডন দিয়ে তৈরি।
এই যে কিছু কোডন খালি করতে পারা, এটা বড় একটা সাফল্য। এই গবেষকেরা চেষ্টায় আছেন আরও কম কোডন ব্যবহার করেই ২০টি প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি করার, যে ২০টি অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে শরীরের প্রোটিন তৈরি। এর বাইরে আরও বহু অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে। যদি ডিএনএর ৬৪টি কোডনের অনেকগুলো খালি করা যায় পুনরাবৃত্তি কমিয়ে, তবে সেখানে অন্য অ্যামাইনো অ্যাসিডের কোডন ব্যবহার করা সম্ভব হবে। আর এর মাধ্যমে প্রাণীর কোষে উৎপাদন করা যাবে নতুন সব প্রোটিন, যা একে সক্ষম করবে নতুন সব কাজ করায়।
এভাবে কৃত্রিমভাবে যদি জিনোম ডিজাইন করে তৈরি করা সম্ভব হয়, তবে এর মাধ্যমে উন্মোচিত হতে পারে একদম নতুন ধাঁচের রসায়নের দুয়ার। আমরা তৈরি করতে পারব প্রয়োজনীয় সব যৌগ। আর সেই সঙ্গে হয়তোবা বোঝা সম্ভব হবে ডিএনএতে কোডনের পুনরাবৃত্তির রহস্য।
সূত্র: সায়েন্স এলার্ট