কৃষক বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী

হরিপদ কাপালী। একজন স্বশিক্ষিত কৃষি বিজ্ঞানী। সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় উদ্ভাবন করেছেন উচ্চ ফলনশীল একটি ধানের জাত। তাঁর নামেই ধানটির নামকরণ করা হয় হরিধান। ২০১৭ সালের ৬ জুলাই ৯৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। সে বছর বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় এই কৃষিবিজ্ঞানীকে নিয়ে লিখেছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। আজ তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে এই কৃষিবিজ্ঞানীর প্রতি বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে, হরিপদ তাঁর ধানখেতে একটি গোছাকে আলাদা করেন। এটির ছড়ায় ধানের সংখ্যা বেশি মনে হলো, গাছটিও পুরুষ্টু। এরপর তিনি তা-ই করলেন, যা তাঁর পূর্বসূরি বাংলার কৃষক-বিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে করেছেন। ওই গোছাকে তিনি আলাদা করে লালন-পালন করলেন। পরের বছর সেই গোছার ধান দিয়ে একটুখানি জায়গায় বীজতলা করলেন। আর সেই চারা লাগালেন খানিক জায়গায়। ফলনের পর দেখলেন তাঁর জমিতে যে বিআর-১১ ধানের চাষ করেন তার চেয়ে এর ফলন বেশি। আশপাশে আলাপ-আলোচনা করলেও ব্যাপারটা কেউ বেশি আমল দিলেন না। কিন্তু হরিপদ ভাবলেন, পরেরবার তাঁর জমিতে কেবল নতুন ওই ধানের চাষই করবেন। করলেন। আর পেয়ে গেলেন বিআর-১১ কিংবা স্বর্ণার চেয়ে উচ্চ ফলনশীল ধান। বিঘাপ্রতি বিআর-১১-এর ফলন ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ২০ মণ। কিন্তু তাঁর নতুন ধানের ফলন ছাড়িয়ে গেল ২২ মণকেও। সারও লাগল কম।

হরিপদ কাপালীকে (বাঁয়ে) ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি

সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে আমি যত সহজে লিখলাম কাজটা ঠিক ততটা সহজ ছিল না। প্রথমত মাঠে ধানের ছড়াকে আলাদা করার জন্য বিশেষ পর্যবেক্ষণশক্তি লাগে। সেটি সবার থাকে না, কেবল বিজ্ঞানীদের থাকে। হরিপদ এরপর প্রথম নিজের পর্যবেক্ষণকে একটি তত্ত্বে খাড়া করার চেষ্টা করলেন। সেটি করার জন্য তাঁর বীজতলা আর ছোট্ট জায়গায় আবাদের পরীক্ষা। সেটা পাস করার পর নিজের জমিতে চাষ। আর তাতেই তাঁর নতুন জাতের ধানটি আলাদা হয়ে পড়ে। হরিপদর জমির নতুন জাতের ধান নজর কাড়ল আশপাশের এবং তাদের মাধ্যমে দূরদূরান্তের কৃষকদের। অনেকেই এলেন নতুন ধানের বীজ নিতে। হরিপদর কিন্তু মনেই হয়নি এই ধানের বীজ দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব! তিনি পরম মমতায় অন্যদের হাতে তুলে দিলেন বীজ। সঙ্গে অনুরোধ, ভালো লাগলে অন্যকেও দেবেন। এভাবে ঝিনাইদহ থেকে আশপাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ল ‘হরির দান’। তত দিনে ‘হরির ধান’ হয়ে এই ধানের নামকরণ হয়ে গেছে ‘হরিধান’।

২০০৫ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় আমি প্রথম হরিপদ কাপালী আর হরিধানের কথা জানতে পারি। পত্রিকা পড়েই বুঝতে পারি, আমরা এক নতুন আবিষ্কারের সামনে। ঠিক করি, যশোর গণিত উত্সবে হরিপদ কাপালীকে আমরা সম্মানিত করব, সংবর্ধিত করব। খবর দেওয়া হলো প্রথম আলোর প্রতিবেদক আজাদ রহমানকে। আর জানালাম জিনবিজ্ঞানী, ধান গবেষক আবেদ চৌধুরীকে। গণিত অলিম্পিয়াডের মঞ্চকে আলোকিত করে হরিপদ বললেন তাঁর ধানের কথা। হাজার খানেক কচি মুখের সামনে তিনি তুলে ধরলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের আপ্তবাক্য: ‘চোখ-কান খোলা রাখো। প্রকৃতিই তোমাকে তোমার সমস্যার সমাধান তুলে দেবে।’ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির পক্ষ থেকে হরিপদ কাপালীর হাতে ফুল দিয়ে বরণ করেন আবেদ চৌধুরী। মঞ্চে আর মঞ্চের সামনে হাজার খানেক লোক আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম হরিপদ কাপালীর সম্মানে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজের তত্ত্বাবধানে রোকাইয়া বেগম ও অন্যরা গবেষণা করে বের করেন হরিধান আসলেই একটি নতুন জাতের ধান।

সেই অনুষ্ঠানেই আমার প্রথম হরিপদর সঙ্গে কথা। ফিরে এসে বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতা থেকে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ নবী ও জাবেদ সুলতানকে পাঠিয়ে দিই হরিপদ কাপালীর বাড়িতে। সারা দিন কাটিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতার পুরোটাই আমরা নিবেদন করি কৃষক-বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালীর এক দিনের বর্ণনায়।

এরই মধ্যে আমরা কানাঘুষা শুনতে পাই। অনেকেই বলতে থাকেন, হরিধান আসলেই বিআর-১১ বা স্বর্ণারই সামান্য হেরফের, মোটেই নতুন জাত নয়। দ্রুত ব্যাপারটা জানালাম আবেদ স্যারকে। কয়েক দিন পর স্যার জানালেন, স্বর্ণা আর হরিধানের জিনগত বিশ্লেষণ করতে রাজি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ। ১০ কেজি স্বর্ণা আর ১০ কেজি হরিধান জোগাড় করে আনা হলো। পাঠিয়ে দেওয়া হলো রাউজান-১ আর রাউজান-২ কোড নাম দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে। কোডিং করার ব্যাপারটা আমার মাথায় ছিল না। কিন্তু আবেদ স্যার আমাকে বললেন গবেষকদের কোনটি কোন ধান বলার দরকার নেই। আমার মাথায় কেবল আমার নিজের উপজেলার নামই এল। কাজে আমি তাত্ক্ষণিকভাবে দুই ধানের কোড দিয়ে দিলাম রাউজান-১ আর রাউজান-২।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজের তত্ত্বাবধানে রোকাইয়া বেগম ও অন্যরা গবেষণা করে বের করেন হরিধান আসলেই একটি নতুন জাতের ধান। মোটেই বিআর-১১ নয়। গবেষণার ফলাফলে জানা গেল, মাঠেই বদলে গেছে বিআর-১১। কয়েক প্রজন্মে বদলে যাওয়া ধানের সঙ্গে অন্য কোনো ধানের প্রাকৃতিক সংকরায়ণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে হরিধানের। গবেষণার ফলাফল ছাপা হলো আন্তর্জাতিক জার্নালে। অবসান হলো বিতর্কের। হরিধান আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে আমাদের কৃষককুলের ঐতিহ্যের কথা। হাজার জাতের ধানের সৃষ্টি আমাদের এই কৃষকদের হাতে। আর গণিত অলিম্পিয়াডের মঞ্চে হরিপদ কাপালী যা বলেছিলেন সেটাই মূল কথা। প্রকৃতি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাতের সৃষ্টি করে। এগুলোতে প্রকৃতি তার সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত রসদ দিয়ে দেয়। ইরি-ব্রি যুগের আগে এ রকম নতুন জাতগুলো মাঠের নানা পরীক্ষায় টিকে যেত, কৃষকের হাতে। ষাটের দশক থেকে পরীক্ষাগারের ব্যাপারটা আমাদের সরিয়ে আনে এখান থেকে এবং ব্যাপারটা হয়ে ওঠে উল্টোমুখী। মানে ল্যাবরেটরি থেকে মাঠে। ফলে প্রকৃতির নিজের উদ্ভাবনটা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। হরিধানের আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানীদের সামনে প্রকৃতিকেই ল্যাবরেটরি হিসেবে পুনরায় হাজির করেছে। এই ধারাতেই এখন আমাদের দরকার হরিপদ কাপালীদের সঙ্গে ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের মিলন ঘটিয়ে দেওয়ার। যে উচ্চ ফলনশীল বন্যা-খরারোধী ‘জাদুধান’-এর খোঁজ করছে মানবজাতি, সেটি হয়তো বিকশিত হচ্ছে কোনো এক হরিপদ কাপালীর ঘরের পেছনের বীজতলায়। তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিয়ে আসতে হবে সামনে। দিতে হবে স্বীকৃতি। মাঠের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁর প্রাপ্য সম্মান।

আগামী দিনগুলোতে কোনো দেশই আর খাদ্যশস্য রপ্তানিতে আগ্রহ দেখাবে না। এই বদ্বীপের মানুষকে তাই খুঁজে ফিরতে হবে হরিপদ কাপালীদের। কারণ, তাঁরাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেন, প্রতিনিয়ত! ২০০৬ সালে হরিপদ কাপালী চ্যানেল আই কৃষি পদক লাভ করেন।

নতুন করে মাঠের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আর নজর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হে হরিপদ কাপালী, আপনাকে জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। ৯৫ বছরের নশ্বর দেহ আপনি ছেড়ে গেছেন বটে, কিন্তু যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আপনার ধানের মধ্যে, কৃষকের মাঠে, বিজ্ঞানীর পরীক্ষাগারে।

৬ জুলাই আপনার দেহাবসানের খবর পাওয়ার পর থেকেই আপনাকে ‘স্যার’ সম্ভাষণ করব বলে ঠিক করেছি বাকি জীবন।

আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন, স্যার হরিপদ কাপালী।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত