ক্যানসার দমনে ভাইরাস

ক্যানসার কোষ ধ্বংসকারী ভাইরাসফাইল ছবি

ক্যানসার আমাদের জন্য এক আতঙ্কের নাম। যুগে যুগে মানুষ ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়ছে। কত রকম চিকিত্সাপদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই ঠিক মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠতে পারেনি। তবে সম্প্রতি এক ব্রহ্মাস্ত্রের কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। ভাইরাসের কাঁটা দিয়ে তুলতে চাইছেন ক্যানসারের কাঁটা। সম্প্রতি এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এমন এক ভাইরাস, যা দিয়ে কিছু ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব।

আমাদের শরীরে আমাদের নিজেদের কোষগুলো চরম শৃঙ্খলা মেনে চলাফেরা করে ও বেড়ে ওঠে। শরীরে কোষের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে তার কাজ। যেমন রক্তে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহন করা একধরনের কোষের কাজ, তেমনি ইনসুলিন, লালা ইত্যাদি নিঃসরণ আরেক ধরনের কোষ। আবার ক্ষতস্থানের নিরাপত্তা ও সেটাকে সারিয়ে তোলার জন্য শরীরে বিশেষ ধরনের প্রতিরক্ষা কোষ নিয়োজিত।

প্রায় সব ধরনের কোষ সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনে বিভাজিত হয়। আবার নিজেদের অহেতুক অপ্রয়োজনীয় বিভাজনকে নিজেরাই থামিয়ে রাখে। শরীরের কোথাও ক্ষত তৈরি হলে সেটি পূরণ হয়ে ঠিক আগের মতোই হয়ে যায়, অপ্রয়োজনে বেড়ে ফুলেফেঁপে ওঠে না। শরীরের কোষগুলো যদি কখনো তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে, তখন তাকে বলে টিউমার। এই টিউমার আরও সম্প্রসারিত হয়ে ক্যানসারে রূপ নেয়। ক্যানসার কোষগুলো দেখতে সাধারণ কোষের মতো হলেও আদতে ওরা পুরোই পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের মতো। এদের কাজই হলো গণ্ডি পেরিয়ে টই টই করে দেহময় ঘুরে বেড়ানো, একে-তাকে (অন্য কোষদের) উত্ত্যক্ত করে তাদের সম্পদে (পুষ্টি) ভাগ বসানো। আবার এরা দুর্বল কোষগুলোকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিজেদের দল ভারী করে।

শরীরের প্রতিরক্ষা কোষগুলো দেহের সব জায়গায় টহল দেয় আর ক্ষতিকর জীবাণুদের ধ্বংস করে। কিন্তু তারা ক্যানসার কোষগুলোকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। এগুলোর চেহারা সাধারণ কোষের মতো বলেই টহলদার কোষগুলো আলাদা করে চিনতে পারে না এদের। ফলে ক্যানসার কোষগুলো বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো শরীরে।

ভাইরাস আকারে ব্যাকটেরিয়ার থেকেও ক্ষুদ্র। এদের ঠিক জীব বা জড়—কোনোটাই বলা যায় না। ব্যাকটেরিয়ার মতো ভাইরাস কোষের বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই এরা আমাদের কোষের ভেতরে লুকিয়ে থাকে ঘাপটি মেরে।

কিছু ভাইরাস আমাদের কোষের ভেতরে লুকিয়ে কোষগুলোকে ধ্বংস করতে থাকে। ফলে শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম রোগবালাই। ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে পারে আমাদের শরীরে। কিছু ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়তে অনেক সময়ের দরকার হয়। ধীরে ধীরে শরীরে বিস্তার লাভ করে এবং সুযোগ বুঝে আমাদের কাবু করে। সব ভাইরাস আবার সব ধরনের কোষকে আক্রমণ করে না। যেমন হেপাটাইটিস ভাইরাসরা আক্রমণ করে আমাদের লিভার বা যকৃতের কোষকে, এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় আমাদের প্রতিরক্ষা কোষ। তবে অনেক ভাইরাস প্রতিরক্ষা কোষের ভয়ে ঘাপটি মেরে আমাদের শরীরের কোষে লুকিয়ে থাকে। এরা অনেকটা সময় নিয়ে চুপিসারে আমাদের প্রতিরক্ষা কোষগুলোকে ফাঁকি দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে।

সুস্থ্য ও ক্যানসার কোষের তুলনা
ফাইল ছবি

মানবদেহের প্রতিরক্ষা কোষগুলোকে যদি কোনোভাবে চাঙা করে তোলা যায়, তাহলে ক্ষতিকর ক্যানসার কোষ অথবা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হবে। আশ্চর্যজনক হলেও অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসগুলোর চেহারা ও কাজ ল্যাবরেটরিতে বদলে ফেলা সম্ভব। ভাইরাসের মধ্য থেকে খারাপ ও ক্ষতিকর অংশ কেটে বাদ দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় সহায়ক গুণ যুক্ত করে কাইমেরিক বা ইঞ্জিনিয়ার্ড ভাইরাস বানানো সম্ভব। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা সে চেষ্টাই করেছেন। প্রস্তুত করেছেন একটি ইঞ্জিনিয়ার্ড ভাইরাস (টি-ভেক), যেটা দিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা কোষগুলোকে অনায়াসে লেলিয়ে দেওয়া যাবে মেলানোমা বা ত্বকের ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে।

এ জন্য বিজ্ঞানীরা কাজে লাগিয়েছেন আমাদের অতিপরিচতি জ্বরঠোসার ভাইরাস (হারপিস সিমপ্লেক্স ওয়ান)। ২০১৭ সালে বিশ্বের প্রথম ক্যানসারনাশক ভাইরাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদন লাভ করেছে টি-ভেক। এই ভাইরাস দিয়ে সফলতার সঙ্গে স্কিন ক্যানসার উপশম সম্ভব হয়েছে। আপাতত টি-ভেক সরাসরি টিউমার অথবা ক্যানসার কোষের উত্পত্তিস্থলে সঞ্চারিত করা হচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন একে সরাসরি রক্তে সঞ্চালনের উপযোগী করে গড়ে তোলার। শরীরে টি-ভেক অনেকটা গুপ্তচরের মতো কাজ করে। এরা চুপিচুপি সুস্থ কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু সেখানে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অথচ ক্যানসার কোষের ভেতরে গিয়েই আমাদের প্রতিরক্ষা কোষগুলোকে জাগিয়ে তোলার সিগন্যাল পাঠায় (চিত্র দ্রষ্টব্য)। ফলে প্রতিরক্ষা কোষগুলো সুনির্দিষ্টভাবে ক্যানসার কোষগুলোকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। সেই দিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যখন বিজ্ঞানীরা সব ধরনের ক্যানসারনাশক ভাইরাস আমাদের উপহার দেবেন। ক্যানসার চিকিত্সা হয়ে উঠবে অনেক সহজ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সুত্র: নেচার, নেচার রিভিউস ড্রাগ ডিসকভারি