চিপে বসানো মানব অঙ্গ

কোনো রোগ নিরাময়ে একটি নতুন মেডিসিন বা ওষুধ আবিষ্কার করা বেশ খরচ ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। একটি নতুন মেডিসিন বাজারে আসতে গড়ে খরচ হয় প্রায় ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আর সময় লাগে গড়ে ১০ বছর। এই সময়ের সিংহভাগই লাগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে। ছয়-সাত বছরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে একটি ওষুধ মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর অনেক মেডিসিনের প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়। মূলত বারবার এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যর্থতার কারণেই একটি কার্যকর ওষুধ ডেভেলপমেন্টের খরচ ও সময় অনেক বেড়ে যায়।

জেনে রাখা দরকার, প্রতিটি মেডিসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আসার আগে আরও কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে আসে। যেমন ওষুধটির ডিজাইন, রাসায়নিকভাবে সংশ্লেষণ, বিভিন্ন প্রাণীর দেহে প্রি–ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, মানুষের বিভিন্ন ধরনের কোষ পেট্রিডিশে (গবেষণাগারে ব্যবহৃত বিশেষ কাচের প্লেট) কালচার বা চাষ করে সেখানে প্রয়োগ ইত্যাদি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অন্যান্য প্রাণী ও কোষ কালচারের ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে এলেও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এসে ওষুধগুলো ফেল করে কেন? কারণ, মানবদেহ অন্যান্য প্রাণিদেহ থেকে আলাদা ও জটিল। ফলে একই মেডিসিনে মানবদেহ ও অন্যান্য প্রাণিদেহ ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়। আর পেট্রিডিশে যে কোষ কালচার করা হয়, তা দ্বিমাত্রিক। আর মানবদেহে কোষগুলো যেমন অবস্থায় থাকে, ঠিক তেমন পরিবেশ পায় না। ফলে কোষগুলোও একই ওষুধে আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখায়।

তাহলে আমাদের দরকার এমন একটি মডেল, যেটির মানবদেহের সঙ্গে অনেক বেশি মিল থাকবে এবং মেডিসিন প্রয়োগে মানবদেহের একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রযুক্তিবিদেরা উদ্ভাবন করেন অর্গান অন আ চিপ প্রযুক্তি। মাইক্রোফেব্রিকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছোট্ট একটি চিপ বানানো হয়, যেখানে মানবদেহের কোষ ব্যবহার করা হয় এবং এই কোষের জন্য মানবদেহের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করা হয়। ছোট্ট চিপটি রক্ত সঞ্চালন, কোষে পুষ্টি পাঠানোর কাজ করে। পাশাপাশি দেহে থাকা অবস্থায় নির্দিষ্ট কোষটি যে ধরনের পরিবেশে (তাপমাত্রা, চাপ) থাকে, তার ব্যবস্থা করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো এই প্রযুক্তিকে পেট্রিডিশে কালচার করা কোষ থেকে এগিয়ে রাখে। এই চিপগুলো মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকর একক হিসেবে কাজ করে এবং একধরনের জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া তৈরিতে সহায়তা করে।

ধরা যাক, ফুসফুসের একটি চিপ বানাতে চান। তাহলে আপনাকে ফুসফুসের কোষ নিয়ে চিপটিতে বসাতে হবে। চিপে রক্ত সঞ্চালনের জন্য ক্ষুদ্র চ্যানেল রাখতে হবে। ফুসফুস যেভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়, ভ্যাকুয়াম চ্যানেল ব্যবহার করে বাতাস প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য তৈরি করতে হবে তেমন পরিবেশ। ফলে কোষটি বুঝতে পারবে না, সে ফুসফুসের ভেতরে আছে, নাকি চিপে আছে। তাই ওষুধ প্রয়োগের ফলে দেহে থাকা কোষ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, চিপের কোষগুলো ঠিক সেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

এই প্রযুক্তি কীভাবে প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ব্যবহার করা যায় এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার আগেই একটি ওষুধের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সঠিকভাবে জানাতে পারে। পাশাপাশি একটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস মানবদেহে কীভাবে রোগ ছড়ায়, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে আমাদের দেহের কোষগুলো কীভাবে কাজ করে ইত্যাদিও জানা যাবে এই পদ্ধতির সাহায্যে।

কীভাবে এই প্রযুক্তিকে পারসোনালাইজড মেডিসিন চর্চায় ব্যবহার করা যায়, কীভাবে আরও নির্ভুলভাবে এই চিপকে তৈরি করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা যায় এবং কীভাবে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের চিপকে একীভূত করে ইন্টেগ্রেটেড হিউম্যান অন আ চিপ হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে বিস্তর কাজ হচ্ছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ওইস হার্ভার্ড

*লেখাটি ২০২১ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত