জিন প্রকৌশলে ক্রিসপার
মানুষ প্রথম যখন জানল জীবদেহ কোষ দিয়ে তৈরি, নিশ্চয় চমত্কৃত হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে বহু বছর। কোষের গঠন নিয়ে কত কাজ হয়েছে। কোষের গঠন ভালো করে জানার আগেই ১৮ শতকের মধ্যভাগে মেন্ডেল জিনতত্ত্বের মূল সূত্রগুলো আবিষ্কার করে ফেলেছেন পরিসংখ্যান ব্যবহার করে। কোন জীবের বংশধর কেমন হবে মেন্ডেলের সূত্র ব্যবহার করে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় প্রায় নিখুঁতভাবে। অথচ ১৯৫৩ সালের আগে জানাই হয়নি কীভাবে এক জীবের বৈশিষ্ট্য বাহিত হয় তার সন্তানের মধ্যে, বংশধরেরা ধরে রাখে পূর্বপুরুষের চালচলন।
১৯৫৩ সালে ওয়াটসন আর ক্রিক ডিএনএ ডাবল হেলিক্স গঠন আবিষ্কার করেন। এক জীবের বৈশিষ্ট্য কীভাবে পরের প্রজন্মে চলে যায়—এ আবিষ্কার সেই পথ দেখিয়েছিল। এ বিষয়ে পরের মাইলফলকটা ২০০৩ সালে। মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে। তারপরও আধুনিক জীববিজ্ঞান গবেষণা প্রায় প্রাথমিক পর্যায়েই আছে বলা যায়। কারণ, ওই ডিএনএর গঠনে কিছু করার মতো সক্ষমতা এখনো আয়ত্তে আসেনি মানুষের। তবে কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের ডিএনএ পরিবর্তন করে ক্লোনিং ও প্রতিষেধক তৈরির কাজে লাগাতে পেরেছে মানুষ।
মানুষ বা যেকোনো জীবের কোন কোষের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে ডিএনএর গঠন। একজন লম্বা না খাটো হবে, চোখের রং বাদামি না কালো হবে, দাঁত কয়টা হবে, সেগুলোর আকৃতি কেমন হবে—এমন সব বৈশিষ্ট্যই ডিএনএর মধ্যে প্রোগ্রাম করে লেখা থাকে। সেই প্রোগ্রামে যদি হাত দেওয়া যায় বা পরিবর্তন আনা যায়, তাহলে পরিবর্তন হবে ওই জীবের বৈশিষ্ট্যই। হয়তো পূর্ণ হবে সায়েন্স ফিকশনের অতিমানব বানানোর আশাও।
ডিএনএর গঠনে পরিবর্তন আনার নানা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল গবেষণাটি কিন্তু হঠাত্ পাওয়া। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে একদল গবেষক কাজ করছিলেন ব্যাকটেরিয়া কীভাবে ভাইরাসের আক্রমণের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাঁরা লক্ষ করলেন, ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণের পর ব্যাকটেরিয়া নতুন একটি জেনেটিক পদার্থ তৈরি করে। Cas9 নামের একটি প্রোটিন সহযোগে ওই জিন ভাইরাসের ডিএনএতে যুক্ত হয়ে যায়। তারপর ভাইরাসের ডিএনএ ভেঙে ফেলে অথবা অসাড় করে ফেলে।
এ থেকে তাঁরা আবিষ্কার করেন এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পছন্দমতো জিন অন্য কোনো জিনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সম্ভব। অর্থাত্, একটি নির্দিষ্ট ডিএনএর অংশ অন্য কোনো ডিএনএর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সম্ভব। এমনকি তা কেটে ফেলা অথবা কোনো কারণে নষ্ট হওয়া ডিএনএতেও জোড়া লাগানো সম্ভব।
এই পদ্ধতির আসল নাম Clustered regularly interspaced short palindromic repeats (CRISPR)। সংক্ষেপে ক্রিসপার। ২০১২ সালে পদ্ধতিটি আবিষ্কারের পর সারা বিশ্বেই এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। একটা পদ্ধতির সাফল্যের পেছনে যে গুণগুলো থাকা লাগে, ক্রিসপারের তা আছে। ক্রিসপার সহজে করা যায়, খরচও অল্প। ক্রিসপারের ব্যবহার যে নানামুখী হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রথমেই আলোচনায় আসছে ক্যানসার। ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোকে মেরে ফেলে বা এডিট করে সারিয়ে তোলা সম্ভব এই পদ্ধতিতে। বিভিন্ন বায়োটেক ফার্মে এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে জোরেশোরেই। সবার চেয়ে এগিয়ে আছে সম্ভবত চীন।
চীনের সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার গবেষক লু ইউর দল ক্রিসপারের মাধ্যমে এডিট করা কোষ ঢুকিয়ে দিয়েছে ফুসফুসে ক্যানসার হওয়া এক রোগীর শরীরে। তারা ক্রিসপার পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগীর রক্তকোষ নিয়ে তাতে কিছু পরিবর্তন আনে। রক্তকোষের একটি জিনকে অকার্যকর করে দেয়। সেই জিনটি মূলত PD-1 নামে একটি প্রোটিন তৈরি করত। PD-1 প্রোটিনটি কোষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। আর এই সুযোগটা নেয় ক্যানসার। নেচার সাময়িকীতে ২৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ফলাফল এখনো জানানো হয়নি, রোগীর গোপনীয়তার স্বার্থে। মানুষের শরীরে ক্রিসপারের ব্যবহার এই প্রথম। বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭-এর মার্চে ব্ল্যাডার, প্রোস্টেট ও কিডনির কোষের ক্যানসারের রোগীদের শরীরে ক্রিসপারের মাধ্যমে এডিট করা কোষ প্রয়োগ করে দেখা হবে।
একই বিষয়ে গবেষণা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের নানা বিশ্ববিদ্যালয়েও। ২০১৬ সালের জুনে ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অনুমতিও পেয়েছেন মার্কিন গবেষকেরা মানুষের শরীরে ক্রিসপার পদ্ধতি প্রয়োগে। এ বছর শেষ হওয়ার আগেই এ পদ্ধতি ব্যবহারের আশা করছেন। অনেক বিজ্ঞানী একে দেখছেন যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের বৈজ্ঞানিক গবেষণার লড়াই হিসেবে। ক্রিসপার নিয়ে গবেষণারত পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কার্ল জুন একে আখ্যায়িত করছেন স্পুটনিক ২.০ হিসেবে। পঞ্চাশের দশকে রাশিয়া স্পুটনিক মহাকাশে পাঠানোর পর যে মহাকাশে রকেট পাঠানোর গবেষণা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল একে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় কি না, তা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু ক্রিসপার যে ভবিষ্যতে বহু চমক আনতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানীদের আশা, এই পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে অচিরেই এইচআইভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই গড়ে তোলা যাবে। এমনকি মানুষের ভ্রূণকে ক্রিসপারের মাধ্যমে পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের বানানো সম্ভব। জন্মের আগেই হয়তো কোনো রোগের আভাস থাকলে তা জিন প্রকৌশল করে সারিয়ে তোলা যাবে।
কিন্তু এই গবেষণা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো সেই নীতিগত প্রশ্ন আবারও আসছে। জিন প্রকৌশল করে এভাবে মানুষের বা প্রাণীর পরিবর্তন আনা নীতিসিদ্ধ হবে কি না। কারণ, এই গবেষণা করতে গিয়ে তৈরি হতে পারে অসম্পূর্ণ কোনো মানবশিশু। আর দানব আকৃতির সুপারম্যান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেও তো কেউ বাদ দিতে পারছে না। যা-ই হোক, বিজ্ঞান গবেষণা এসব ভয় আর সম্ভাবনা সঙ্গে নিয়েই হয়েছে নানা সময়। এভাবেই ইতিহাস এগিয়েছে। ক্রিসপারও এগিয়ে যাবে। অথবা এর চেয়েও হয়তো আরও কার্যকর কোনো পদ্ধতি আবিষ্কৃত হবে।
সূত্র: নেচার সাময়িকী, প্রিন্সিপলস অব জেনেটিকস/এলডন জন গার্ডনার