ডাইনোসরের ঘরসংসার

আমরা জানি, ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা ২৩ কোটি বছর থেকে নিয়ে ৬.৬ কোটি বছর পর্যন্ত ডাইনোসর সারা পৃথিবীতে সদর্পে বিচরণ করেছিল। শ্রেণিগত পরিচয়ে এগুলো সরীসৃপ। তাই এই সময়কে বলা হয় ‘সরীসৃপের সোনালি যুগ’।

পৃথিবীতে ডাইনোসরের অবস্থানকে আমরা অনেক সময় হিংস্র ভয়াল ড্রাগন, রূপসী মত্স্যকন্যা (মারমেইড) বা বুদ্ধিদীপ্ত এলিয়েনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি। কিন্তু ড্রাগন, মত্স্যকন্যা, এলিয়েন মানুষের কল্পনাবিলাসের এক উত্কৃষ্ট উদাহরণ। বাস্তবে এসবের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাইনি। কিন্তু ডাইনোসর বা এই টেরিবল লিজার্ড দলের অস্তিত্ব এক বাস্তব সত্য। এর অসংখ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণাদি আমাদের হাতে রয়েছে। প্রকৃতি বিজ্ঞানের মিউজিয়ামগুলোতে বিলুপ্ত এই প্রাণীর সংশোধিত সংরক্ষিত যেসব কঙ্কাল বা জীবাশ্ম আমরা দেখি, তা যে কেবল বৃহদাকারের হয়ে থাকে তা-ই নয়, বরং ছোট মুরগি বা কবুতরের আকারেরও এ-জাতীয় অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। এসব প্রাণীর জীবাশ্ম বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের আংশিক কঙ্কালের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ফরাসি প্রকৃতিবিদ জর্জ কুভিয়ের প্রাচীন জীবাশ্মের তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে আধুনিক প্রত্নজীববিদ্যাকে প্যালিয়ন্টলজি প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বিজ্ঞানের আঙ্গিকে তা উপস্থাপন করতে শুরু করেন। তা মূলত ছিল পরিণত বয়সের পাওয়া বিলুপ্ত প্রাণীদের ওপর। তাঁরা সেই সময়কার প্রকাশিত লেখালেখিতেও তাঁদের সংগৃহীত জীবাশ্ম বা ফসিল নমুনার বাইরের তেমন কিছু বলতে পারেননি। এর সংগত কারণও রয়েছে। কেননা, সেগুলো যে কোটি কোটি বছর আগেকার এক অজানা অধ্যায়। কারণ, বিজ্ঞানের জগতে কোনো অদেখা, অজানা বিষয় নিয়ে কল্পনাপ্রসূত কিছু বলতে গেলেও এর কতগুলো নিয়মকানুন বা হিসাব ‘গোল্ডেন রুল’ মেনে তবে এগিয়ে যেতে হয়। যেমন সেই সময়কার প্রত্নজীববিদেরা মূলত ডাইনোসরের জীবাশ্ম কঙ্কালের যেসব গবেষণা করে যাচ্ছিলেন, তাতে এদের ডিম, ডিমের রক্ষণাবেক্ষণ, ডাইনোসর মা-বাবার আচরণ বা পরবর্তী সময়ে এদের প্রতিনিধিদের বেড়ে ওঠা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।

ডাইনোসরের ডিম, বাসা ও শাবক পালন

প্রত্নজীববিদেরা ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ফ্রান্সে প্রথম ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্মের সন্ধান পান। সেই ডিমটি ছিল একটি ভলিবল আকারের, যার ব্যাস ছিল ১৪ ইঞ্চি। কিন্তু তখনকার বিশেষজ্ঞ মহল এগুলো কিসের ডিম, তা শনাক্ত করতে পারেনি। পরে আমেরিকার ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অ্যান্ড্রে ১৯২৩ সালে মঙ্গোলিয়ায় ডিমসহ ডাইনোসরের বাসার সন্ধান পান। সেই ডিমগুলো ছিল ৮ ইঞ্চি লম্বা। সেই বাসায় আরও নানা ধরনের ডাইনোসরের অবশিষ্টাংশের অস্তিত্ব খুঁজে পান তিনি।

পরে রাশিয়ার গবেষক মিখাইলভ (১৯৯০) অ্যানড্রের এই পর্যবেক্ষণের বিরোধিতা করে বলেন যে এই ডিমগুলো আধুনিক কোনো পাখির ডিমের মতো। এই মতবাদেরও বৈজ্ঞানিক মূল্য রয়েছে। কেননা, পাখিগোষ্ঠী ডাইনোসর-জাতীয় সরীসৃপ দল থেকে বিবর্তিত ধারা অনুসরণ করে উদ্ভব হয়েছে।

পরবর্তী পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা ফ্রান্স, ভারত, চীন, মঙ্গোলিয়া, আর্জেন্টিনা এবং পশ্চিম আমেরিকার অনেক জায়গায় ডাইনোসরের ডিম খুঁজে পান। সবচেয়ে পুরোনো ডাইনোসরের ডিম পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনায়। সেগুলো ২৪ থেকে ২৫ কোটি বছরের পুরোনো।

প্রত্নজীববিদেরা প্রাচীন প্রাণী পরিণত ডাইনোসরের দেহাবশেষ ও জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণায় যথেষ্ট এগিয়ে গেলেও এদের ডিম বা শিশু অবস্থার তেমন কোনো অস্তিত্বের সন্ধান দিতে পারেননি। সেই পর্যায়ের খবরাখবর জোগাড় করতে প্রায় শত বছর লেগে গিয়েছিল। এর সংগত কারণও রয়েছে। কেননা, পরিণত সরীসৃপের হাড়গোড় ছিল পরিপক্ব ও মজবুত। অন্যদিকে এদের ডিম ও শিশু প্রাণীর গঠন-আকৃতি ছিল যথেষ্ট দুর্বল ও ভঙ্গুর। কালের গতিধারায় সেসব অতি সহজে প্রকৃতিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে মিশে গেছে।

যাহোক, সেসব প্রাচীন অতিকায় ও ভয়ংকর সরীসৃপগুলোর বংশবিস্তারের রহস্য নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে মতবিরোধ থাকলেও একসময় তাঁরা মত প্রকাশ করেন, মেসোজেয়িক যুগের (২৫.২ কোটি থেকে ৬.৬ কোটি বছর) ডাইনোসরগুলো আধুনিক সরীসৃপ ও পাখির মতো ডিম দিত। এরা রক্ষণাবেক্ষণ ও শাবক লালন-পালন করত যত্নসহকারে।

বিজ্ঞানীদের মতে, ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসরের ডিমের রং, আকার-আকৃতির ভিন্নতা ছিল। এসব ডিমের শেলে (খোলস) স্থলভাগে বাড়তে থাকা ভ্রূণের প্রয়োজনীয় প্রানি ও খাদ্য সংরক্ষিত থাকত বলে সহজে ধরে নেওয়া যায়।

আমাদের জানামতে, প্রায় সব ডিম দেওয়া সরীসৃপ ও পাখি এদের ডিম রক্ষার জন্য বাসা বানায়। কাজেই আমরা অতি প্রাচীন ডাইনোসর গোষ্ঠীর ডিম দেওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে ধরে নিতে পারি, এই প্রাণীগুলোও বাসা বানাত। এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণাদি বিজ্ঞানীদের হাতে না থাকলেও একেবারে যে নেই, তা-ও নয়।

জীবাশ্মবিজ্ঞানী জ্যাক ও রবার্ট ১৯৭৯ সালে মন্টানায় মাইয়াসরাস ডাইনোসরের একাধিক বাসার সন্ধান পান। বাসাগুলো মা ডাইনোসরের দৈর্ঘ্যের (৩০ ফুট) সমান বলে তাঁরা বলেন। তাঁরা আরও বলেন, এই বাসাগুলো পুরোনো পাথরে করা হতো এবং আকারে-প্রকারে তা গাঙচিলের (সিগাল) বাসার সঙ্গে তুলনীয়। মা ডাইনোসররা একই বাসা প্রতিবছর ব্যবহার করত বলে জানা যায়।

সাধারণত বাসা বানানোর উদ্দেশ্য হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি যে প্রাণীগুলো সেখানে ডিম দেবে, তা ফোটাবে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে গেলে সেই মা বা বাবা খাদ্য ও নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। ডাইনোসরের ক্ষেত্রেও এমনটা হওয়ার কথা। তবে এখানে ভিন্নমতও রয়েছে। কেননা, তৃণভোজী ডাইনোসরের বেলায় তা সহজতর। এগুলো জন্মের পরই আশপাশের গাছগাছালির সন্ধান পেয়ে যায়। কিন্তু মাংসভোজী প্রজাতির শাবকের জন্মের পরপরই অন্য কোনো প্রাণী ধরে খেতে পারবে, তা মনে হয় না। অন্যদিকে এদের ভ্রূণাবস্থায় যে মাংস কাটার মতো দাঁত গজায়, এরও যথেষ্ট প্রমাণাদি নেই। সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায়, এসব শাবক জন্মের পরপরই অন্য ডাইনোসরের শিকারে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় খুব কমসংখ্যক শাবক পরিণত ডাইনোসর হয়ে ওঠে। এ কারণে মা ডাইনোসর পাখির মতো দু-চারটি ডিম না দিয়ে ২০-৩০টি ডিম পাড়ে। এই অবস্থা প্রকৃতিধারার সাধারণ নিয়মেই নিয়ন্ত্রিত হয়।

কিছু কিছু জীবাশ্ম গবেষক দাবি করছেন যে কোনো কোনো ডাইনোসর মা ও বাবা উভয়েই ডিম দেওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে ডিমে তা দেওয়া, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিপালনে অংশগ্রহণ করে, যা কেবল উন্নত বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায়। যেকোনো জীবপ্রজাতির বংশের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন। অন্যদিকে কতগুলো বিরাটাকার ডাইনোসর ডিম দিয়ে তা ফেলে রেখে যেত। পরবর্তী পর্যায়ে সেগুলোকে খোঁজখবর রাখত না।

ডাইনোসরের প্রজননবিষয়ক পর্যালোচনায় দেখা যায়, যথেষ্ট জীবাশ্ম বা কঙ্কাল নমুনা না পাওয়ায় এই অধ্যায় কিছু দুর্বল হয়ে রয়েছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও জানতে পারব।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত