তুখোড় শিকারি বাজ

মতিঝিলের সিটি টাওয়ারের শীর্ষদেশে চুপচাপ বসে আছে পাখিটি। সেটা ওখানে বসেই মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাসহ আশপাশের বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। চুপচাপ বসে আছে বটে পাখিটি, ঘাড়-মাথা বারবার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে—যোগ্য উড়ন্ত শিকার নজরে পড়ে কি না! শিল্পিত ভঙ্গিতে মাঝেমধ্যেই ঘাড়-মাথায় ‘খোঁট’ মারছে নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। মতিঝিলের আকাশে আয়েশি ভঙ্গিতে ঘুরপাক খাচ্ছে ভুবন চিলেরা, যদি অবেলায় নজরে পড়ে কোনো শিকার বা খাবার। শীতের গোধূলিবেলা দ্রুত সন্ধ্যার দিকে দৌড়াচ্ছে তো! ভুবন চিলেরা যেমন দেখতে পাচ্ছে সিটি টাওয়ারের পাখিটিকে, তেমনি এটাও দেখতে পাচ্ছে ওদের। ভুবন চিলেরা আকার ও ওজনে এটির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বড় হলেও সমঝে চলে এটিকেই। কেননা, দুর্দান্ত ডাইভ যেমন দিতে পারে এরা, তেমনি বুকভরা সাহস আর চোখভরা প্রচণ্ড রোষ নিয়ে তেড়ে যেতে পারে তিরের ফলার মতো। বাজ-ইগল বা কাকদেরও তোয়াক্কা করে না এরা।

পাখিটির দৃষ্টি এখন স্থির ঢাকা স্টেডিয়ামের মাথার ঊর্ধ্বাকাশে—ওখানে একঝাঁক আবাবিল পাখি (House Swift) বৃত্তাকারে উড়ে-ঘুরে আনন্দ-খেলায় মেতেছে, মিষ্টি সুরে গানও গেয়ে চলেছে একটানা। এই পাখিটি টান টান হলো, টার্গেট করল শিকার—তারপর আস্তে করে উড়াল দিয়ে সরলরেখায় স্টেডিয়ামের দিকে এমনভাবে উড়ে চলল যে, যেন সে আবাবিলের ঝাঁককে দেখতেই পাচ্ছে না! কিন্তু আবাবিলদের পিলে চমকে গেল দুর্ধর্ষ শিকারি পাখিটিকে আসতে দেখে, ভয়ার্ত ডাকাডাকি করতে করতে ঝাঁকটি আরও ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে যখন, তখন শিকারি পাখিটি ‘কিরে! কিরে! যাস কই!’ ধরনের ধমক মারতে মারতে কৌণিকভাবে ওপরের দিকে তিরের ফলার মতো ছুটে গিয়েই দলছুট একটি পাখিকে ঘিরে শূন্যেই একটি বৃত্ত যেন তৈরি করে ফেলল। আর বৃত্তবন্দী আবাবিলটি যেন সম্মোহিত হয়ে গিয়ে ওইটুকু অদৃশ্য বৃত্তের ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকল, তখন শিকারি পাখিটি ‘ঠোঁট-তিরে’ শিকার বিদ্ধ করে বাঁ দিকে পাক খেয়ে চলে গেল মতিঝিল-কমলাপুর পার হয়ে আরও পূর্ব দিকে। স্টেডিয়ামের আকাশে তখনো বাতাসে সাঁতার কাটছে আবাবিলটির খসে পড়া কিছু পালক।

ঢাকার পূর্ব প্রান্তের মান্ডার একটি সুউচ্চ বিদ্যুৎ টাওয়ারের মাথার বাসায় যখন ফিরে এল তুখোড় শিকারি পাখিটি, তখন বাসার তিনটি ক্ষুধার্ত ছানা খিদের কান্না জুড়ে দিল। পাখিটি অতটুকুন আবাবিলটাকে (ওজন মাত্র ২২ গ্রাম) পায়ের তলায় চেপে রেখে নির্দয়ভাবে ঠুকরে ঠুকরে পালক তুলে ফেলে টুকরো টুকরো মাংস কেটে ঠোঁটে এনে বাচ্চাদের খাওয়াতে শুরু করল। এ সময় জোড়ের অন্য পাখিটিও শিকার মুখে বাসায় এসে নামল। তার শিকারটি হলো একটি পরিযায়ী বাদামি কসাই পাখি। সেটিও ছোট পাখি।

এই যে টাওয়ারের বাসাটি, সেটা তৈরি করতে এই দম্পতির সময় লেগেছিল ৮ দিন। তারপরে ডিম পেড়েছিল ৩টি। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই ৪টি ডিম পাড়ে এরা। ডিমের রং হয় সাদাটে-লালচে। তার ওপরে লালচে-বাদামি ছোপ থাকে। ২৫-৩০ দিন তা দেওয়ার পরে ছানা ফোটে। ছানারা উড়তে শেখে ৪০-৫২ দিনে। তারপরও ছানারা ২০-২৫ দিন মা-বাবার ওপরে নির্ভরশীল থাকে। এদের বাসা বাঁধার মৌসুম হলো জানুয়ারি-জুন মাস। ঢাকা শহর ও শহরতলি তথা ঢাকার আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চলে নিয়মিত বাসা দেখা যায় এদের। এরা বাসা করে উঁচু টাওয়ার, উঁচুতে অবস্থিত পুরোনো আমলের পানির ট্যাংকির তলদেশ, উঁচু তাল-নারকেলগাছে। দাঁড়কাক-ভুবন চিল-কালো ডানা চিলের পরিত্যক্ত বাসাও ওরা নিজেদের বাসা করে নেয়। কেরানীগঞ্জের প্রাণিবিদ মো. ফয়সল ২০০৯ সালে একটি তুরমতির ছানা পুষেছিলেন। ছেড়েই পালতেন। তার বাড়িতে তখন আমি ৫–৬ বার যাই। সুযোগ পেয়ে একদিন ওটা পালিয়ে গিয়েছিল। যেহেতু এটি আমাদের বিরল আবাসিক শিকারি পাখি, সেহেতু সারা দেশেই নজরে কম পড়ে। তবে ঢাকা শহরে আমার পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা এই বলে যে, রাজধানী শহরে ওদের খাদ্য সুলভতা যেমন আছে, তেমনি আছে বাসা বানানোর জন্য জুতসই বহু স্থান।

এরা সুউচ্চ স্থানে বাসা করতে পছন্দ করে। তাই বহুতল ভবনের ছাদের মোবাইল টাওয়ার, স্টেডিয়াম ও কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকার লাইটিং টাওয়ারসহ অন্যান্য স্থান আছে রাজধানী ও আশপাশে। এদের প্রিয় খাদ্যতালিকায় আছে আবাবিল-বাতাসি-বাবুই-চড়ুই-ধানটুনি-ভরত-বাদামি কসাই ইত্যাদি ছোট পাখিসহ গিরগিটি-অঞ্জন-ছোট সাপ ইত্যাদি। প্রয়োজনে চামচিকাও খায়। সন্ধ্যায় যখন ঢাকা শহরের আকাশে চামচিকারা দলে দলে বেরিয়ে পড়ে, তখন চামচিকা শিকারের দৃশ্যও দেখা যেতে পারে ছাদে দাঁড়িয়ে। লেখার শুরুতে আমি যে অদৃশ্য বৃত্ত রচনার কথা বলেছি আবাবিলকে ঘিরে, চামচিকার ক্ষেত্রেও শিকারকে এ রকম বৃত্তবন্দী করতে আমি বহুবারই দেখেছি। উল্লেখ্য, ৫৪ পুরানা পল্টনের পাঁচতলাবিশিষ্ট হলুদ রঙের ভবনটিতে (বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটের ঠিক বিপরীতে) আমার কর্মস্থল ছিল ১৯৭৪ সাল থেকে টানা ২৭ বছর। ওই ২৭ বছরই আমি অফিসের দক্ষিণের প্রশস্ত বারান্দাগুলোতে দাঁড়িয়ে বা চেয়ারে বসে ওই ‘বৃত্তবন্দী’ শিকারের দৃশ্য দেখেছি। এ ক্ষেত্রে শিকার যেন স্থির হয়ে যায় শূন্যে, তখন শিকার ঠোঁটে ধরে গিয়ে বসেছে কোনো উঁচু ভবনের কার্নিশে। আগে মনে হতো—এখনো আমার তাই-ই মনে হয়, জাদুটোনা জানে ওরা। অথবা, বৃত্ত রচনা করায় শব্দতরঙ্গে ব্যাঘাত ঘটে, তাতে বেদিশা হয় চামচিকারা, কিন্তু আবাবিলরা কেন স্থির হয়ে যায়! মুখ দিয়ে কোনো অদৃশ্য বায়বীয় বিষাক্ত কিছু ছুড়ে দেয় শিকারি পাখিটি! নাকি ওরা সম্মোহিত হয়! বিষয়টি আজও আমার কাছে গোলকধাঁধা। ২০১৮ সালেও আমি বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে এ রকম দৃশ্য দেখে থাকি। শিকারি এই পাখি শহরের আকাশ পাড়ি দেয় মাস্তানির ভঙ্গিতে। ইচ্ছে করেই লেজ নাড়ায়, পাখা দোলায় অন্য ভঙ্গিতে, ওদের ছায়া দেখলেও পাতিঘুঘু-চড়ুই-বুলবুলি-আবাবিল-টুনটুনিদের পিলে চমকে যায়। ওরা ভয়ার্ত গলায় বিপৎসংকেত পাঠাতে থাকে আশপাশের পাখিদের। উড়ন্ত শিকারি চোখ রাখে নিচের দিকে। শিকার মেলে কি না!

লেখক: পাখিবিশারদ

ছবি: বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ ক্লাব