দেজা ভু

২০১৪ সালের শরত্কাল। স্পেনের দক্ষিণে প্রাচীন গ্রানাদা শহরের এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয় খেতে বসেছি। ঘন কালো কোঁকড়ানো চুলের ভারি মিষ্টি এক তরুণী ওয়েট্রেস হাসিমুখে এসে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে স্প্যানিশ ভাষায় স্বাগত জানাল, ‘হ্যাল্লো। আমি সুমাইয়া। কী করতে পারি তোমাদের জন্য?’ মেয়েটার কথার জবাব না দিয়ে আমি কিছুক্ষণ আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কারণ আমার মনে হলো, এইখানে, এ রকম একটা ছোট্ট জমজমাট রাস্তার ধারের রেস্তোরাঁয় ঠিক এই রকম কালো কোঁকড়া চুলের একটি মেয়ে, ঠিক এইভাবে কোনো একদিন আমাকে ঠিক এ কথাটাই জিজ্ঞেস করেছিল—হ্যাল্লো, আমি সুমাইয়া। কী করতে পারি তোমার জন্য? কিন্তু আদতে ব্যাপারটা অসম্ভব। কারণ এর আগে আমি কোনো দিন স্পেনে যাইনি আর সুমাইয়া নামের এই আধা আরব আধা স্প্যানিশ মেয়েটার সঙ্গে আগে কখনো দেখা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে এমন অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি কেন হলো?

বিজ্ঞানীরা বলেন, এর নাম হলো দেজা ভু! দেজা ভু একটা ফরাসি শব্দ, যার অর্থ হলো অলরেডি সিন বা ইতিমধ্যে দেখা। এটা এমন এক অতিপ্রাকৃতিক অনুভূতি, যাতে আপনার মনে হবে বর্তমান এই দৃশ্য আপনি আগেই দেখেছেন বা এমন ঘটনা আগেই ঘটেছে আপনার জীবনে। অথচ আপনি নিশ্চিত যে এমনটা হতে পারে না। ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের জীবনেই নাকি এমন অনুভূতি কদাচিৎ হয়েছে। দেজা ভুর সঠিক কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, জানা নেই এর কার্যকারণও। বিজ্ঞানে যেসব বিষয় নিয়ে একটা অস্বস্তি বা রহস্য ঘিরে রয়েছে, দেজা ভু তার একটা।

দেজা ভু নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের রয়েছে নানা তত্ত্ব। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্বটি হচ্ছে, এটি আসলে আমাদের মস্তিষ্কের তৈরি স্মৃতির প্রতারণা। স্মৃতি সংরক্ষিত হয় আমাদের মস্তিষ্কের মিডিয়াল টেমপোরাল লোব নামের একটি জায়গায়। বিশেষ করে এর রাইনাল কর্টেক্স নামের এলাকাটি পুরোনো স্মৃতির সঙ্গে নতুন ঘটনার সাদৃশ্য তুলনা করতে সাহায্য করে। টেমপোরাল লোব এপিলেপসি নামের মৃগীরোগীদের প্রায়ই খিঁচুনি ওঠার আগমুহূর্তে দেজা ভু হতে দেখা যায়। গবেষণাগারেও মানুষের দেজা ভু করানো সম্ভব হয়েছে, টেমপোরাল লোবের রাইনাল কর্টেক্সে অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা দিয়ে। ধারণা করা হয়, এই এলাকা নিউরনের বৈদ্যুতিক ডিসচার্জের অস্বাভাবিকতাই দেজা ভুর জন্য দায়ী। কিন্তু মৃগীরোগী ছাড়া সাধারণ মানুষেরও কেন মাঝে মাঝে দেজা ভু হয়, তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বলা হয়, আমাদের মস্তিষ্ক কখনো কখনো সাম্প্রতিক কোনো ঘটনার স্মৃতির সঙ্গে বর্তমান ঘটনাটিকে গুলিয়ে ফেলে। এ রকমই কোনো ঘটনার স্মৃতি, যা ভাসা ভাসা অবস্থায় মস্তিষ্কে সংরক্ষিত ছিল, তার সঙ্গে খানিকটা মিল থাকার কারণে সে হুবহু এ রকমই ঘটেছিল বলে আমাদের ভুল তথ্য দেয়।

দেজা ভু নিয়ে দ্বিতীয় প্রচলিত তত্ত্বটি হচ্ছে প্রিকগনিটিভ ড্রিম থিওরি। যে ঘটনা নিয়ে দেজা ভু হচ্ছে, সে রকম কোনো ঘটনা এর আগে হয়তো আমরা স্বপ্নদৃশ্যে দেখেছি এবং তা ভুলেও গেছি। কিন্তু এইমাত্র ঘটনাটি স্বপ্ন খুঁড়ে সেই স্মৃতি বের করে আনে এবং আমাদের চমকে দেয়। এর বাইরে আরও কিছু তত্ত্ব আছে। অবশ্য সেগুলোকে বিজ্ঞানীরা স্রেফ গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। যেমন ঘটনাটি হয়তো প্যারালাল বা সমান্তরাল কোনো দুনিয়ায় ঘটেছিল কিংবা ঘটেছিল পূর্বজন্মে!

তবে ব্যাখ্যা থাক বা না থাক, দেজা ভু সাহিত্য ও সিনেমায় একটি প্রিয় বিষয়। ভীষণ জনপ্রিয় ম্যাট্রিক্স সিনেমায়ও আছে দেজা ভুর ব্যাপারটা। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, একটি ভবনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় নিও (কিয়ানো রিভস) দরজার বাইরে করিডর দিয়ে একটি কালো বিড়ালকে হেঁটে যেতে দেখে। নিও থমকে দাঁড়ায় এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে উচ্চারণ করে—দেজা ভু। মানে এই কালো বিড়ালটিকে এভাবে হেঁটে চলে যেতে সে যেন আগেও দেখেছে। আর এতেই সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেননা, ম্যাট্রিক্স দুনিয়ায় দেজা ভু তখনই ঘটে, যখন মারাত্মক কোনো পরিবর্তন হয়। দেজা ভু নামেই একটা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল হলিউডে। সেই সিনেমায় একজন ভয়ংকর অপরাধীকে ধরতে দেজা ভু টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া হ্যারি পটার, টোয়াইলাইট ও গেম অব থর্নস সিরিজের চলচ্চিত্রে দেজা ভুর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। দেজা ভু ব্যবহৃত হয়েছে অনেক কবিতা ও সাহিত্যেও। রহস্যময় বলেই শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছে বিষয়টি এত সমাদৃত।

কোনো এক বিকেলে পার্কের রাস্তায় হাঁটার সময় একটি শিশুকে লাল বল নিয়ে খেলতে দেখে বা ট্রেনে চেপে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় হঠাৎ জানালায় একজন বুড়ো ভিখিরিকে টোকা দিতে দেখে কখনো যদি হঠাৎ চমকে যান, যদি ভাবেন, কী আশ্চর্য, এ ঘটনা আগেও ঘটেছিল জীবনে, ঠিক এই রকম; এ-ও কি সম্ভব; তখন অবাক হবেন না। কেননা, দেজা ভু মানবমস্তিষ্কের এক জটিল খেলা, এই খেলার ধাঁধা পুরোপুরি মেলেনি। কিন্তু বিজ্ঞান নিশ্চয় কোনো একদিন এর সামাধান দেবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ