দ্বিতীয় মস্তিষ্কের খোঁজে

কেউ যদি বলে মস্তিষ্ক থাকে আপনার পেটে? কথাটা শুনতে যতই অবৈজ্ঞানিক লাগুক না কেন, বিজ্ঞানীরা কিন্তু বলছেন এমন এক মস্তিষ্কের কথা। যদিও একে সরাসরি মস্তিষ্ক বলা যায় কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমরা কী করি? অনেক চিন্তাভাবনা করি। এ চিন্তার কাজটা করে আমাদের মস্তিষ্ক মহাশয়। কিন্তু অতিরিক্ত মানসিক চাপে পড়লে অথবা কোনো জটিল সিদ্ধান্ত নিতে গেলে পেটের ভেতর যে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে যায়! এটা কি পুরোই কাকতালীয়? কাকতালীয় বলে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এমনই এক মস্তিষ্কের কথা। যার বাস পেটের মধ্যে, মানে খাদ্য পরিপাকতন্ত্রে।

মানুষের পরিপাকতন্ত্রের আসল কাজ খাদ্য পরিপাক করা। কিন্তু এটুকুই সব নয়। মস্তিষ্কের মতো পরিপাকতন্ত্রও নিউরন ও নিউরোট্রান্সমিটারের এক বিশাল কাঠামো। এর গালভরা বৈজ্ঞানিক নাম এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেম। এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেমের সঙ্গে মস্তিষ্কের সেতুবন্ধ করে ভেগাস স্নায়ু (নার্ভ)। পরিপাকতন্ত্রে কিছু হলে ভেগাস নার্ভ জানিয়ে দেয় মস্তিষ্ককে। মস্তিষ্ক প্রতিক্রিয়া দেখায় সে অনুযায়ী। তাই পাকস্থলীতে কী খাদ্য গেল, তার প্রভাব মস্তিষ্কে পড়ে। এর বাইরে আছে নানা জীবাণু—ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস। এদের উদ্দীপনাও পৌঁছে যায় মস্তিষ্কের কাছে। তাই খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আমাদের আচরণ, মানসিক অবস্থা। এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেমকে তাই বলা চলে অবচেতন মন বা স্বয়ংক্রিয় মস্তিষ্ক।

বহুকাল আগে থেকে গাট (অন্ত্র) ইনসটিংক্ট বলে ইংরেজিতে যে একটা কথা আছে, তার মানে সহজাত বুদ্ধি। এখন দেখা যাচ্ছে, গাট ইনসটিংক্টের একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও আছে। এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেম শুধু সহজাত বুদ্ধি বা অবচেতন মনের কাজ করে তা নয়, এর ভারসাম্য নষ্ট হলে হতে পারে স্থূলতা, অবসাদ, আর্থ্রাইটিস, এমনকি পারকিনসনস রোগ।

এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেমের কাজ নানাবিধ। সুস্থ এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেম ভেগাস স্নায়ুর মাধ্যমে ইলেকট্রিকাল ইমপালস পাঠায় মস্তিষ্কে। এই পালস নিউরোট্রান্সমিটারে সেরোটেনিনের ব্যবহার বাড়ায়, যা মানসিক অবসাদ কমাতে ভূমিকা রাখে।

এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেম যেমন মস্তিষ্কে তথ্য পাঠায়, মস্তিষ্কও তেমন একই কাজ করে। এই ঘটনা ঘটে মূলত মস্তিষ্ক যখন বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয় বা প্রবল মানসিক চাপে থাকে। তখন ভেগাস স্নায়ুর মাধ্যমে সেই সিগন্যাল আমাদের এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেমে আসে। এ জন্যই পেটের ভেতর পাকস্থলীত অস্বস্তি অনুভূত হয়। যাকে আমরা বলি ইঁদুর দৌড়।

মস্তিষ্ক আর পাকস্থলীর এই সংযোগ একবিংশ শতাব্দীর চিকিত্সাবিজ্ঞানে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। যদিও এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয় এক শতাব্দী আগে। তখন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা প্রাণীর পাকস্থলী শরীর থেকে কেটে আলাদা করে ফেলার পরও দেখেন, তা খাদ্য পরিপাক করতে পারে। তারপর থেকে গবেষণা হয় কীভাবে পাকস্থলী বা অন্ত্র আসলে কাজ করে।

মানুষের শরীরে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ দেহকোষের ১০ গুণ। যদিও নতুন গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দেহকোষের সমান। যাহোক, পরিপাকতন্ত্রে এদের উপস্থিতি যে একটু বেশিই, সে তো জানা কথা। ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে আছে ভাইরাস এবং আরও নানা জীবাণু। এগুলো কিন্তু বেশির ভাগই আমাদের জন্য ক্ষতিকর নয়। আর পরিপাকে অংশ নেয় এদের অনেকগুলোই। তারপরও সেগুলো যেহেতু ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস, এদের গতিবিধি তো লক্ষ রাখতেই হবে। এ কাজটাই করে এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেম। সর্বক্ষণ লক্ষ রাখে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের গতিবিধি। ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসদের গতিবিধির খবর আবার পাঠায় মস্তিষ্কের কাছে। এ জন্যই এই নার্ভাস সিস্টেমকে মস্তিষ্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়।

এনটেরিক নার্ভাস সিস্টেম কিন্তু যুক্তিসংগত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এর নেই সচেতনতাও। তাই একে দ্বিতীয় মস্তিষ্ক বললেও বলা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এর কাজ পুরোপুরি মস্তিষ্কের মতো নয়।

তবু এই অবচেতন মন-মস্তিষ্কের প্রভাব যে আমাদের ওপর আছেই, প্রচণ্ড চাপের মুহূর্তে পেট যেন সে কথাই জানান দেয় মাঝেমধ্যে।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: বিবিসি ফোকাস

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত