ধেয়ে আসছে সুপারবাগ

সুপারম্যানকে আমরা সবাই ভালোবাসি। কেননা, অতিমানবীয় ক্ষমতা নিয়ে সুপারম্যান মানবজাতির কল্যাণে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। জীবাণুজগতেও এ রকম সুপারবাগ আছে। কিন্তু তারা কল্যাণকামী নয়, বরং বিধ্বংসী। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আগামী দিনগুলোতে এই সুপারবাগই হয়ে উঠতে যাচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর এর সঙ্গে লড়ার অস্ত্রশস্ত্র ফুরিয়ে আসছে খুব দ্রুতই।

কী এই সুপারবাগ? সুপারবাগ হচ্ছে সেই জীবাণু, যার বিরুদ্ধে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না। অর্থাৎ, কোনো এক বৈশিষ্ট্যের কারণে এই জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিপরীতে বিপুল বিক্রমে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। এই সুপারবাগ জীবাণু হতে পারে ভাইরাস, হতে পারে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা পরজীবী প্রোটোজোয়া। যেকোনো ধরনের জীবাণুই এই ওষুধ প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে। ফলে সে পরিণত হতে পারে এক বিধ্বংসী শক্তিতে, যাকে ধ্বংস করার কোনো হাতিয়ার আমাদের হাতে নেই। কিন্তু কী করে একটি সাধারণ জীবাণু সুপারবাগ হয়ে ওঠে? সেটা বুঝতে হলে আগে জানতে হবে কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুকে ধ্বংস করে।

১৯২৮ সালে স্কটল্যান্ডের চিকিত্সাবিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং প্রায় আকস্মিকভাবেই আবিষ্কার করেন অ্যান্টিবায়োটিক। তিনি লক্ষ করেন, পেনিসিলিয়াম নোটেটাম নামের এক ছত্রাক থেকে তৈরি মোল্ড জুস স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার কালচার প্লেটে যোগ করলে সেই ব্যাকটেরিয়া আর বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে না। শুধু তা-ই নয়, এই জুস কালচার প্লেটে একটি ব্যাকটেরিয়ামুক্ত এলাকা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই জিনিসটির নাম তিনি দিলেন পেনিসিলিন। এভাবেই জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠল অ্যান্টিবায়োটিক। এই আবিষ্কারের জন্য ফ্লেমিং ১৯৪৪ সালে নাইট উপাধি পান, নোবেল পুরস্কার পান ১৯৪৫ সালে।

পরের বছরগুলোতে তাঁরই দেখানো পথ ধরে আবিষ্কৃত হয় আরও নানা অ্যান্টিবায়োটিক। এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো মূলত দুভাবে কাজ করে। কেউ কেউ ব্যাকটেরিয়া কোষের দেয়ালকে নষ্ট করে দিয়ে তাকে মেরে ফেলে, আবার কেউ কেউ ব্যাকটেরিয়াকে মারতে না পারলেও তার বিপাকক্রিয়াকে প্রতিহত করে ডিএনএ বিভাজনকে রোধ করে দেয়। ফলে ওই ব্যাকটেরিয়া আর বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে রোগজীবাণুর হাতে মানুষের মৃত্যু ছিল সাধারণ ঘটনা। কলেরা, ডায়রিয়া, প্লেগ, ঘা, নিউমোনিয়া ইত্যাদি সংক্রমণে উজাড় হয়ে যেত জনপদ। একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার এসব সংক্রামক ব্যাধিকে হটিয়ে দিতে শুরু করে। বাড়তে শুরু করে মানুষের আয়ু। মানুষ জয়ী হতে শুরু করে জীবাণুজগতের বিরুদ্ধে।

ওদিকে শত্রুও কিন্তু বসে নেই। জীবাণুরাও গোপনে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। নিজেদের ক্রোমোজোমে মিউটেশন ঘটিয়ে নিজেদের কোষের গঠন ও স্বভাবকেই পরিবর্তন করে ফেলে তারা। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক হারাতে থাকে তাদের কার্যকারিতা। একে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেসিসট্যান্স। সবচেয়ে বড় কথা, এই জীবাণুগুলো পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে এই জিন ট্রান্সফার করে দিতে পারে। ফলে পরের প্রজন্মে ওই মিউটেশন বাহিত হয়ে যায় ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে। তারা হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী, আরও অপ্রতিরোধ্য। কখনো তারা অ্যান্টিবায়োটিককে নষ্ট করে দেওয়ার মতো এনজাইম তৈরি করে শরীরে, কখনো অ্যান্টিবায়োটিক যেখানে কাজ করবে, সেই প্রোটিন বাইন্ডিং সাইটকেই পাল্টে ফেলে, কখনো নিজেদের বিপাকক্রিয়াকে পরিবর্তন করে, আবার কেউ কেউ অ্যান্টিবায়োটিককে শরীর থেকে ঠেলে বের করে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। এভাবেই তারা হয়ে ওঠে সুপারবাগ বা প্রবল ক্ষমতাধর জীবাণু।

মানবসমাজে ও পশুপাখির খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র অপরিণামদর্শী ও ভুল ব্যবহার সুপারবাগের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করছে। একের পর এক জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে। নতুন কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকেরও আবিষ্কার বন্ধ রয়েছে বহু বছর ধরে। ফলে আমরা আবার সেই অতীতে ফিরে যাচ্ছি, যখন রোগজীবাণুর সঙ্গে লড়াই করার কোনো রসদ ছিল না আমাদের হাতে। চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এসব সুপারবাগের হাতেই নিশ্চিত ও শোচনীয় পরাজয় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত