নিখুঁত ব্যক্তিগত ওষুধ

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেকখানি। তার পরও এর মধ্যেই আছে বিশাল এক ব্লাইন্ড স্পট। প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন আবিষ্কার, আরও বেশি ‘কর্মক্ষম’ ওষুধ চিকিৎসকদের হাতে আসছে। সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। এই যে এত এত ওষুধ, তারপরও চিকিৎসকেরা জানেন, এই ওষুধ সবার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।

শ্বাসকষ্ট, বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন, ডায়াবেটিসের মতো রোগের  চিকিৎসার জন্য সাধারণ কিছু ওষুধ ব্যবহৃত হয়। সমস্যা হলো ৩০-৪০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব ওষুধ যেমনটা কাজ করার কথা, তেমনটা করছে না। আবার খুব কঠিন রোগ—যেমন আর্থ্রাইটিস বা আলঝেইমার্সের মতো রোগে দেখা যাচ্ছে শতকরা ৫০-৭০ জন রোগী প্রচলিত চিকিৎসাপ্রণালিতে ঠিক উপকার পাচ্ছে না।

সমস্যাটা কিন্তু ওষুধে নয়, গলদটা চিকিৎসাপ্রণালিতেই। সাধারণত নতুন ওষুধ প্রয়োগের আগে কিছু পরীক্ষা করা হয়। একই ধরনের উপসর্গে আক্রান্ত বেশ কিছু লোককে প্রয়োগ করা হয় নতুন ওষুধ। এটাকে ড্রাগ ট্রায়াল বলে। যদি ট্রায়ালে কোনো ওষুধ বেশি লোকের ওপর ভালো কাজ করে, তাহলে সেই রোগের চিকিৎসায় ওষুধটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ট্রায়ালে যাদের ওপর ওষুধটা কাজ করেনি, কেন কাজ করেনি—সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হয় না।

ড্রাগ ট্রায়াল তো করা হয় কিছুসংখ্যক লোকের ওপরে। ধরা যাক ১ হাজার লোক। সেই ট্রায়ালে যদি ১০ জন লোকের শরীরেও ওষুধটা ঠিকঠাক কাজ না করে, এই একই ওষুধ যখন কয়েক কোটি মানুষকে দেওয়া হবে, ওষুধ কাজ করছে না এ রকম লোকের সংখ্যাটাও হবে বিশাল। তার মানে কোনো ট্রায়ালে যদি কোনো ওষুধ মিরাকল ড্রাগ হিসেবেও প্রমাণিত হয়, সেই ওষুধটিও সবার ক্ষেত্রে কাজ করে না।

বিংশ শতাব্দীতে ‘ওয়ান সাইজ ফিটস ফর অল’ তত্ত্বটি অসাধারণ কিছু ওষুধের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, এই তত্ত্ব অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে বিপদের কারণও হয়ে উঠছে। কারণ ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে গড়পড়তা হিসেবে আর ওদিকে প্রতিটি ভোক্তা বা রোগী হচ্ছে স্বতন্ত্র, তাদের জেনেটিক সিকোয়েন্স স্বতন্ত্র, আবার যেকোনো রোগে শরীরের ভেতরের প্রতিক্রিয়ায়ও মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে।

মজার বিষয় হচ্ছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বা ওষুধের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, গবেষণার পরিমাণ তত বাড়ছে। আমরা জানতে পারছি আসলে দেখতে একই রকম হলেও জেনেটিকালি একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের কত পার্থক্য! আর তাই জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন, এমন মানুষগুলো এখন আর আমজনতার জন্য না ভেবে, চিকিৎসাপদ্ধতি প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা করে করার কথা ভাবছেন।

এই গোটা প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ডিএনএ সিকোয়েন্সিং টেকনোলজির অবিশ্বাস্য অগ্রগতিকে।

২০০৩ সালে যখন প্রথম মানুষের জিন ডিকোড করা হয়, এ কাজ করতে প্রায় এক দশক সময় লেগে গিয়েছিল এবং তাতে ছিল আন্তর্জাতিক নানা রকম সংস্থার অনুদান। খরচ হয়েছিল প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। এর মাত্র ১৫ বছর পর একজন মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সিং কয়েক ঘণ্টায় করে ফেলা যায় এবং খরচ হয় আগের খরচের কয়েক হাজার ভাগের এক ভাগ। এর মানে হচ্ছে জেনেটিক ইনফরমেশন এখন গবেষকদের কাছে অনেক বেশি সহজলভ্য এবং তাঁরা সেই সিকোয়েন্সিং দেখে চিকিৎসার চিন্তাভাবনা করেন।

ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

নির্ভুল ওষুধের ধারণাটি সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে ক্যানসারের ক্ষেত্রে। বছরের পর বছর ডাক্তাররা শুধু ভেবেছেন, ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল ওষুধটিও টিকেআই (টাইরোসিন কাইনেজ ইনহিবিটর্স) কেন মাত্র ১০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে ঠিকঠাক কাজ করছে! বাকিদের ক্ষেত্রে কেন কাজ করছে না?

২০০০ সালের শেষ নাগাদ, গবেষকেরা রোগীদের টিউমারের ডিএনএ দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখলেন, যে ওষুধ তাঁরা ক্যানসারের ওষুধ হিসেবে প্রয়োগ করছেন, শুধু সেটা জিনের একটি নির্দিষ্ট মিউটেশন EFGR-এর ক্ষেত্রে কাজ করছে। মিউটেশনের কারণে ক্যানসার কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং টিকেআই সেই অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন বন্ধ করে টিউমারের আকৃতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসে। কিন্তু যে রোগীর টিউমারের জেনেটিক উৎস আলাদা, সে ক্ষেত্রে টিকেআই কোনো কাজ করছে না, শরীরে শুধু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছে। সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও খুব খারাপ ধরনের।

এভাবেই যখন জানা গেল ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য একটি নয়, বিভিন্ন ধরনের জিন দায়ী, তখন রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে গোটা চিকিৎসা–পদ্ধতিটাই গেল বদলে। ক্যানসারকে এখন তাই শুধু কোষের বৃদ্ধি দেখে কিংবা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে কোষের গঠন দেখে আলাদাভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে না। শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে টিউমারের জিন মিউটেশন দেখে। এ থেকে চিকিৎসাপ্রণালিও ঠিক করা হচ্ছে। এমনকি চিকিৎসা চলাকালীন যখন কোষের জিনের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধে প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়, তখন চিকিৎসকেরা এ জেনেটিক মিউটেশন বদলের সূত্র ধরে চিকিৎসার পদ্ধতিও বদলে ফেলেন।

এখন অবশ্য আরও সংবেদনশীল ও ‘ব্যক্তিগত ওষুধ’ ক্যানসারের চিকিৎসায় চলে এসেছে, যেমন ইমিউনোথেরাপি। এ ক্ষেত্রে রোগীর নিজের শরীরের ইমিউন কোষ নিয়ে তারই রি-প্রোগ্রাম করা হয় এবং সেই কোষগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয় সেই রোগীর শরীরেই ক্যানসার কোষকে আক্রমণের জন্য। এই ইমিউন কোষগুলো CART কোষ নামে পরিচিত। এদের রোগীর শরীর থেকে বের করে ল্যাবের ভেতর জেনেটিক্যালি মডিফাই করা হয়। ফলে এরা রোগীর ক্যানসার কোষের একদম ঠিকঠাক মলিকিউলার মার্কার চিহ্নিত করতে পারে। এরপর আবার তাদের রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ইউনাইটেড স্টেটস ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে এই চিকিৎসা–পদ্ধতির স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য এর আগে বেশ কিছু সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এই সিদ্ধান্তের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

‘ব্যক্তিগত ওষুধ’–এর ধারণা মানুষের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখন প্রায় দেখাই যায় না। উত্তর আমেরিকায় মানুষের মৃত্যুর শতকরা ৭ ভাগ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হতো। এখন সেই সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে খুব সহজেই। ব্যক্তিগত ওষুধের কারণে।

একেবারে সাধারণ ডু-ইট-ইওরসেলফ জেনেটিক পরীক্ষা একজন মানুষের ভবিষ্যতে হতে পারে, এ রকম সম্ভাব্য রোগের একটা তালিকা দিতে পারে। আবার পরীক্ষাগুলো যদি একেবারে পেশাদার মানুষ দিয়ে খুব সূক্ষ্ম ও গভীর মনোযোগ দিয়ে করানো যায়, তাহলে একজন মানুষের ভেতরের একেবারে সুনির্দিষ্ট ঝামেলার জিনটি বের করে ফেলা সম্ভব। জিনটি হয় কোনো নির্দিষ্ট ওষুধের ক্ষেত্রে পার্শ্বপতিক্রিয়া দেখায় কিংবা কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা যায় সেই জিনটির কারণে চিকিৎসায় ব্যবহার করা ওষুধটি খুব দ্রুত মেটাবোলাইজ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে উপায় একটাই থাকে, সেই মানুষটির ক্ষেত্রে ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে। গোটা প্রক্রিয়াটিকে বলা হচ্ছে ফার্মাকোজিনোমিকস। যদিও প্রক্রিয়াটি কার্যকরী করতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন।

আশার কথা হচ্ছে এ ক্ষেত্রে আলাদা করে নতুন নতুন সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, কাজটাও এগোচ্ছে অসম্ভব দ্রুতগতিতে। এ রকম সফটওয়্যার এসে গেলে প্রেসক্রিপশন লিখতে, ওষুধের মাত্রা সম্পর্কে জানতে বা কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ রোগীর জন্য ক্ষতিকারক হবে কি না, তা জানা যেমন সহজ হবে, তেমনি দেখা যাবে ফার্মাসিস্টরাও রোগীর হাতে ওষুধ তুলে দেওয়ার আগে রোগীর জেনেটিক প্রোফাইল দেখে নিচ্ছেন!

ডেটা ড্রিভেন

ব্যক্তিগত ওষুধের এই ধারণা যে শুধু জেনেটিকসের ওপর নির্ভর করবে, ব্যাপারটা তেমন সহজ কিন্তু না। ভবিষ্যতের ‘ব্যক্তিগত ওষুধ’ প্রতিটি আলাদা মানুষের শরীরের ভেতরের বিবিধ প্রকারের মলিকিউলার লেভেলের ডেটা নিখুঁতভাবে নিয়ে সেই অনুযায়ী তৈরি হবে।

এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার অধ্যাপক পিটার কালিসের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমাদের হাতে এখন যে প্রযুক্তি আছে, তা দিয়ে একজন মানুষের জিনোম, প্রোটিওমিক প্রোফাইল (প্রোটিনের মাত্রা), মেটাবোলিক প্রোফাইল এবং স্বতন্ত্র মাইক্রোবায়োম বিস্তারিতভাবে জানা যাচ্ছে খুবই সামান্য খরচে। জিন অ্যানালিসিস বিষয়টা বেশ তথ্য দিলেও সময়ের সঙ্গে তো আর জিনের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। তাই এখান থেকে সেই মানুষটার কোনো নির্দিষ্ট রোগ আছে কি না বা সেই রোগে দেওয়া ওষুধ ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।

একজন মানুষের শরীরের সামান্য পরিমাণ রক্ত থেকে শরীরে রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার বহু আগেই অনেক রোগের কেমিক্যাল ক্লু শনাক্ত করা যায়, এদের বলা হচ্ছে ‘বায়োমার্কার’। যেমন প্যানক্রিয়াটিক শরীরে প্রথম যখন উপসর্গ মাত্র দেখা দেয়, তত দিনে ক্যানসার কিন্তু সারা শরীরে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে এই ক্যানসার কিন্তু শরীরে ১৫ বছরের বেশি সময় কোনো রকম উপসর্গ ছাড়াই থাকতে পারে। কিন্তু শরীর থেকে রক্ত নিয়ে যদি বায়োমার্কার বা অন্যান্য মলিকিউলার পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়, তাহলে ক্যানসারের বিষয়টা ধরা যায় সঙ্গে সঙ্গেই। ১৫ বছর অপেক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রফেসর কালিসের মতে, জেনেটিক ও বায়োমেডিকেল ডেটার এক বিশাল ডেটাবেইস, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার আর বেশ কিছু দক্ষ জেনেটিসিস্ট যদি একসঙ্গে, একই হেলথকেয়ার সেটিংয়ে কাজ করে, তাহলে ওষুধশিল্পে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে যাবে। সে ক্ষেত্রে রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা দেওয়ার বা রোগের প্রতিকারের চেয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা হবে রোগ প্রতিরোধমূলক। রোগ হওয়ার আগেই বা রোগের একেবারে শুরুতেই তখন চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হবে।

এ ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থাকেই বলা হচ্ছে ‘ক্যানসার ভ্যাকসিন’। একজন মানুষের শরীরের জিনোমিক সিকোয়েন্স দেখে তার শরীরে যে ক্যানসারটি হতে পারে, তা জেনে সেই ক্যানসারের বিরুদ্ধে তার শরীরে প্রতিরোধব্যবস্থা বা ইমিউনিটি তৈরি করে দেওয়া সম্ভব। এখন এই চেষ্টাটুকু আর শুধু ক্যানসারেই আটকে নেই, অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রেও একইভাবে চিন্তা করা হচ্ছে।

শুধু ক্যানসার নয়, অন্য রোগের ক্ষেত্রেও পার্সোনাল ড্রাগ বা ব্যক্তিগত ওষুধ ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশা করছেন, পার্সোনাল ড্রাগের ধারণাটা আগামীতে চিকিৎসাপদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া

সূত্র: ড্রাগ অ্যান্ড ভ্যাকসিনস