পাঁচটি নতুন ধানের জাত

গেল বছরের শেষটা সুখবর দিয়ে শেষ করলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা। কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় বীজ বোর্ডের বছরের শেষ সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে ব্রি উদ্ভাবিত পাঁচটি নতুন ধানের জাত। জাতগুলো হলো ব্রি ধান ৮২, ব্রি ধান ৮৩, ব্রি ধান ৮৪, ব্রি ধান ৮৫ ও ব্রি ধান ৮৬। ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকে সবচেয়ে সফলতম বছর পার করল গবেষণা সংস্থাটি। এই পাঁচটি নতুন জাতসহ ২০১৭ সালে উচ্চফলনশীল ধানের মোট আটটি জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ছয়টি হাইব্রিড ও ৮৫টি ইনব্রিড জাতসহ এখন ব্রি উদ্ভাবিত মোট জাতের সংখ্যা ৯১টি।

নতুন জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ধান ৮২ একটি স্বল্প জীবনকালীন জাত। উগান্ডা থেকে আমদানি করা নেরিকা ১০ থেকে রোপা আউশ মৌসুমের জন্য বাছাই করা বিশুদ্ধ সারি হলো এই ব্রি ৮২। ব্রি ৮২-তে রোপা আউশ মৌসুমের আধুনিক উফশী ধানের সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গাছের উচ্চতা ১১০ সেমি। কাণ্ড শক্ত, তাই ঢলে পড়ে না। স্বাভাবিক অবস্থায় গাছপ্রতি গুচ্ছের সংখ্যা ১০-১২টি। জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন। দানার আকৃতি মাঝারি মোটা। ১০০০টি ধানের ওজন ২৩.৮৪ গ্রাম। দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৮.০ ভাগ। দানায় প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৭.৬ ভাগ। ভাত খুবই ঝরঝরে হয়। উপযুক্ত পরিবেশে এ জাতটি রোপা আউশ মৌসুমে হেক্টরে ৪.৫-৫.৫ টনেরও বেশি ফলন দিতে সক্ষম। জীবনকাল রোপা আউশ মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান ৪৮-এর চেয়ে চার-পাঁচ দিন কম। এ জাতটির জীবনকাল স্বল্প হওয়ায় রোপা আউশ মৌসুমে আবাদ করার পর আমন ধান আবাদের সুযোগ তৈরি হবে।

নতুন উদ্ভাবিত ব্রি ধান ৮৩ বোনা আউশ মৌসুমের উপযুক্ত মধ্যম মাত্রার খরা সহনশীল জাত। এ জাতে আধুনিক উফশী ধানের সব বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। এ জাতের ডিগপাতা একই মৌসুমে প্রচলিত জাত ব্রি ধান ৪৩ চেয়ে খাড়া। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ব্রি ধান ৮৩ হেক্টরপ্রতি ৪.০-৫.৩ টন ফলন দিতে সক্ষম, যা ব্রি ধান ৪৩-এর চেয়ে ১.০ টন/হে. বেশি। এ জাতের জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন এবং গাছের উচ্চতা ১০০-১০৫ সেমি। এ জাতের ধানের চাল মাঝারি মোটা, সাদা এবং ভাত ঝরঝরে, চালে এমাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৬ ভাগ। ব্রি ধান ৮৩ জাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিষে পুষ্ট দানার সংখ্যা ব্রি ধান ৪৩-এর চেয়ে গড়ে ৪০-৪৫টি বেশি এবং শিষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। এ ধানের দানার রং স্থানীয় কটকতারা জাতের অনুরূপ লালচে ধরনের এবং শিষ লম্বা হওয়ায় পরিপক্ব খেত দেখতে খুব আকর্ষণীয় হয়।

ব্রি ধান ৮৪ জাতটি ব্রি ২৯, ব্রি ১৪৪, ব্রি ২৮, বিআর-এর সংকরায়ণের পর বংশানুক্রম সিলেকশনের (Pedigree selection) মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। অঙ্গজ অবস্থায় ব্রি ধান ৮৪-এর গাছের আকার ও আকৃতি প্রায় ব্রি ধান ২৮-এর মতো। ডিগপাতা গাঢ় সবুজ রঙের। এ জাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ধানের দানার রং হালকা লালচে ধরনের। পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৬ সেমি। জীবনকাল ১৪০-১৪৫ দিন। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২২.৮ গ্রাম। অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৫.৫ ভাগ। চালে শতকরা ৮.৩ ভাগ প্রোটিন এবং প্রতি কেজি চালে ২৭.৬ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে, যা প্রচলিত অন্যান্য জাতের চেয়ে প্রায় ৮.২ মিলিগ্রাম/কেজি এবং জিংকসমৃদ্ধ বোরো ধানের জাত ব্রি ধান ৭৪-এর চেয়ে প্রায় ৩.০ মিলিগ্রাম/কেজি বেশি। ব্রি ধান ৮৪-এর জীবনকাল ব্রি ধান ২৮-এর মতোই। এ জাতের ডিগ হেলানো ও লম্বা। পরিপক্ব অবস্থায় ধানের শিষ ডিগপাতার ওপরে থাকে বিধায় খেত দেখতে খুব আকর্ষণীয় হয়। এ জাতটি হেক্টরে ৬.০-৬.৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। উপযুক্ত পরিচর্যা ও অনুকূল পরিবেশে সর্বোচ্চ ৮.০ টন/হেক্টর ফলন দিতে সক্ষম।

ব্রি ৮২ ধান, চাল ও রান্না করা ভাত

ব্রি ধান ৮৫ জাতটি দুটি Fসারি BR4828-54-1-4-9/IR50 এবং BR4828-54-1-4-9/LU HONG ZAO1-এর মধ্যে Double cross-এর মাধ্যমে বংশানুক্রম সিলেকশন পদ্ধতিতে উদ্ভাবন করা হয়েছে। রোপা আউশ মৌসুমে কুমিল্লা অঞ্চলসহ পূর্বাঞ্চলের জন্য জাত হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এ জাতের ডিগপাতা খাড়া, কিছুটা সরু ও লম্বা, পাতার রং সবুজ। এ জাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর শিষগুলো গাছের ওপরের দিকে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা প্রায় ১১০ সেমি, জীবনকাল ১০৬-১১০ দিন। ধানের রং সোনালি ও আকৃতি চিকন এবং মাঝারি লম্বা। ১০০০টি পুষ্ট চালের ওজন প্রায় ২২.৩১ গ্রাম। জাতটির চাল মাঝারি লম্বা ও চিকন এবং ভাত ঝরঝরে, রং সাদা। ব্রি ধান ৮৫-এর জীবনকাল ব্রি ধান ৪৮-এর প্রায় সমান।

ব্রি ধান ৮৬-এর কৌলিক সারি BR(Bio)8072-AC8-1-1-3-1-1। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর ইরান থেকে সংগৃহীত জাত নিয়ামতের সঙ্গে ব্রি কর্তৃক উদ্ভাবিত কৌলিক সারি BR802-78-2-1-1-এর সংকরায়ণের মাধ্যমে এই কৌলিক সারিটি তৈরি করা হয়। পরে F জেনারেশনে অ্যান্থার কালচার পদ্ধতি (জীবপ্রযুক্তি) ব্যবহার করে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত দেশের প্রথম জাত ব্রি ধান ৮৬। এই আধুনিক উফশী ধানের গাছের আকার ও আকৃতি ব্রি ধান ২৮ থেকে ভিন্ন। এ জাতের গাছ ব্রি ধান ২৮-এর চেয়ে খাটো। পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ৯৫ সেমি। পাতা গাঢ় সবুজ এবং ডিগপাতা খাড়া। দানা লম্বা ও চিকন। দানার মাথা সামান্য বাঁকা কিন্তু চাল সোজা ও লম্বা। ধানের ছড়ার অগ্রভাগের ৩-৫ দানায় খুব ক্ষুদ্র শুঙ্গ থাকে। এ জাতের গাছের কাণ্ড বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান ২৮-এর চেয়ে শক্ত, তাই ঢলে পড়ে না। ব্রি ধান ৮৬-এর জীবনকাল ব্রি ধান ২৮-এর মতো ১৪০-১৪৫ দিন। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২২.৮ গ্রাম। এ ধানের অ্যামাইলোজ ২৫ শতাংশ। কাণ্ড শক্ত, পাতা গাঢ় সবুজ এবং ডিগপাতা খাড়া ও লম্বা তাই খেত দেখতে খুব আকর্ষণীয় হয়। ধান লম্বা চিকন এবং অগ্রভাগ সামান্য বাঁকানো কিন্তু চাল সোজা। এ জাতটি হেক্টরে ৬.০-৬.৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ৭.৮০ টন/হেক্টর পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। চালের আকার আকৃতি লম্বা ও চিকন থাকায় এ ধানের চাল রপ্তানিযোগ্য। ধারণা করা হচ্ছে, বোরো মৌসুমের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত ব্রি ২-এর মতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো সম্পর্কে ব্রির মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘উদ্ভাবিত নতুন পাঁচটি জাতের মধ্যে তিনটি আউশ মৌসুমের ও দুটি বোরো মৌসুমের। আউশকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্য রয়েছে, সে জন্যই আমরা এবার আউশের ওপর জোর দিয়েছি। তিনি বলেন, ‘বোরোতে এখন পর্যন্ত যত জাত আছে সদ্য উদ্ভাবিত ব্রি ধান ৮৪-তে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক রয়েছে। ব্রি-৭৪ জাতের ধানে ২৪ শতাংশ জিংক থাকলেও নতুন জাতে এর পরিমাণ ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ যা জিংকসমৃদ্ধ আগের চারটি জাতের চেয়ে অনেক বেশি।’

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত