পিঁপড়া–সমাজ

মানুষ ছাড়াও অনেক মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে সুশৃঙ্খল আচরণ, বিশেষ করে সামাজিক দায়িত্ব লক্ষ করা যায়। এটা এরা এদের আবাসস্থল, বিশেষ করে বনে-জঙ্গলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই করে। এটা প্রাণিজগতে একটি উন্নততর আচরণ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু পিঁপড়া কি সেই অর্থে উন্নত জীবের আওতায় পড়ে? এর একটা সাধারণ উত্তর হয়তো দেওয়া যায়। ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। এগুলো আকার-আয়তনে নেহাত ছোট বলে এদের আচরণের যে অসাধারণ সামাজিক গুণাবলি রয়েছে, তা আমাদের চোখে পড়ে না তেমন। কারণ, চারপাশের পরিবেশ আমরা সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখি না। যেমন যাঁদের গ্রামে যাতায়াত আছে, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেন, বৃষ্টির দিনে শুকনো বারান্দা বা ঘরের আনাচে-কানাচে লম্বা কালো সুতার মতো আঁকাবাঁকা কিছু একটা দেখা যায়। আপাতত তা কালো সুতার আঁকাবাঁকা বা রেখার মতো মনে হলেও তা আসলে কালো পিঁপড়ার সারি। সেই সারি সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, সুশৃঙ্খল এই সারির প্রায় প্রতিটি পিঁপড়ার পিঠে সাদা একটা বোঝা রয়েছে। তখন একটা কথাই আমাদের মনে আসে, পিঁপড়ারা বুঝি ডুবে যাওয়া বাসায় জমা রাখা খাবার নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। কারণ, তাদের বাসা পানিতে ডুবে গেছে। আসলে কিন্তু পিঁপড়ার কাঁধের সেই বোঝাটি এদের সহোদর মূককীট বা পিউপা। এ অবস্থায় এগুলো নড়াচড়া করতে পারে না। সুতরাং একেকটি পিঁপড়া এদের নিজের ওজনের সহোদরকে কাঁধে নিয়ে দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়। এ ধরনের ব্যাপার অনেক উন্নত শ্রেণির প্রাণীতে দেখা যায়।

পিঁপড়া ছাড়া বিশাল কীটপতঙ্গ শ্রেণির লাখ লাখ প্রজাতির মধ্যে শুধু মৌমাছি, বোলতা ও উইপোকার এই বিশেষ গুণ রয়েছে। পিঁপড়া ইনসেক্টা শ্রেণির ফার্মিসিডি গোত্রের প্রাণী। এদের প্রজাতি সংখ্যা ২২ হাজারের মতো। বাংলাদেশে ১২০টি পিঁপড়া প্রজাতি দেখা যায়। পৃথিবীতে মানুষের তুলনায় পিঁপড়ার সংখ্যা ১০ লাখ গুণ বেশি। পিঁপড়াকে ছড়া-কবিতার ভাষায় পিপীলিকাও বলা হয় (যেমন: ‘পিপীলিকা, পিপীলিকা, দলবল ছাড়ি একা ...’)।

অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর পুরো স্থলভাগজুড়ে পিঁপড়ারা দাপিয়ে বেড়ায়। তবে কিছু দ্বীপপুঞ্জে, যেমন গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডে এদের অস্তিত্ব নেই বলে জানা গেছে। এটা প্রাণিজগতে অভিযোজন প্রক্রিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। পিঁপড়া বিভিন্ন খাদ্যাভাসে নিজেদের অভ্যস্ত করে সহজে বেঁচে থাকতে পারে। শিকারি ধরনের পিঁপড়াও রয়েছে যথেষ্ট। গ্রীষ্মমণ্ডলে একদল পিঁপড়া উইপোকা শিকার করে খায়। আবার ফরমিসিনি (formicinae) গোত্রের অনেক প্রজাতি জাব পোকা (aphids) লালন-পালন করে এবং সেখান থেকে খাদ্য হিসেবে হানিডিউ (Honeydew) পায়। এগুলো আকারে ছোট (০.৭৫ থেকে ৫২ মিমি) হয়। জীবাশ্মভিত্তিক এক পর্যবেক্ষণে জানা যায়, তা লম্বায় ২.৪ ইঞ্চি থেকে ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে (টাইটেনোমিরমা)। পিঁপড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাল বা কালো রঙের হলেও ধাতব ও সবুজ রঙের পিঁপড়াও দেখা যায়।

পিঁপড়ার দেহ তিন ভাগে বিভক্ত—মাথা, ধড় ও উদর। এদের মাথায় দুটি শক্ত চোয়াল রয়েছে। এগুলো দিয়ে এরা খাদ্য কাটাকাটি করে এবং শত্রুকে যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক কামড় দিতে সক্ষম। কোনো কোনো পিঁপড়া মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বার্তা আদান-প্রদান করে। এদের জীবনচক্র ডিম, শূককীট, মূককীট ও পরিণত—এই চার অবস্থার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়।

বেশির ভাগ পিঁপড়া কলোনিতে বসবাস করে। সেই কলোনিতে তিন ধরনের সদস্য—রানি, পুরুষ ও কর্মী পিঁপড়া একসঙ্গে থাকে। এগুলো সংঘবদ্ধ ও সামাজিক জীবন যাপন করে। এই বিবেচনায় সব পিঁপড়া সামাজিক। রানি কলোনির অন্যান্য সদস্যের তুলনায় অনেক বড় এবং ডানাবাহী। পুরুষদের ডানা থাকে, তবে এগুলো আকারে ছোট হয়। এদের আয়ুষ্কাল কম। সাধারণত দৈহিক মিলনের পর পুরুষ পিঁপড়া মারা যায়। কর্মী পিঁপড়া ডানাবিহীন স্ত্রী। কর্মীরা কলোনির যাবতীয় দায়িত্বে থাকে।

রানি পিঁপড়া সাধারণত দুই ধরনের ডিম পাড়ে। নিষিক্ত (2n); এগুলো থেকে স্ত্রী পিঁপড়ার জন্ম হয়। আর অনিষিক্ত (n) থেকে তৈরি হয় পুরুষ পিঁপড়া।

পিঁপড়ার মাটির বাসা

পিঁপড়া দলগতভাবে মিলেমিশে কলোনি বা মাটির ঢিবিতে (ছোট ছোট পাহাড়) বসবাস করে। তাতে গলিপথ রয়েছে। সাধারণত এগুলোতে কয়েক ডজন থেকে হাজার কয়েক পিঁপড়া বসবাস করে। কর্মী পিঁপড়ারা মাটির ঢেলা, কাঠকুটো ও ময়লা দিয়ে বাসা তৈরি করে। আবার তা সুরক্ষিত করার জন্য নানা খড়কুটো বা গাছগাছালির ছোট ছোট ডাল বসিয়ে দেয়। যাতে ঢিবির ভেতরের দিকে তা গড়িয়ে না পড়ে। তাতে এদের খোলামেলা নালিপথ ও কুঠুরি যেন চলাচলের যোগ্য থাকে। সব মিলিয়ে পিঁপড়ার ঢিবি বা পাহাড় বানানোর কলাকৌশল ও ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট চমকপ্রদ। এগুলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় ৩-৪ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।

পৃথিবীতে পিঁপড়ার ঢিবির নানা রকমের সংস্করণ রয়েছে। আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলের চালক (ড্রাইভার) পিঁপড়ার একটি ঢিবিতে ২০ মিলিয়ন কর্মীর সন্ধান পাওয়া গেছে। আরও জানা যায়, জাপানের ‘ফর্মিকা’ প্রজাতির ২.৭ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে ৪৫ হাজার ঢিবিতে এক মিলিয়ন রানি ও ৩০৬ মিলিয়ন কর্মী পিঁপড়া থাকে।

পিঁপড়ার পাতার বাসা

আমাদের দেশের বড় লাল পিঁপড়া বন-জঙ্গলের উঁচু গাছের ডালে পাতা দিয়ে গোলাকার বাসা বানায়। এগুলো স্থানীয় ভাষায় লাল পিঁপড়ার ‘ঢোল’ নামে পরিচিত। পিঁপড়া তাদের সংখ্যা অনুপাতে ছোট-বড় বাসা বা ‘ঢোল’ তৈরি করে। কর্মী পিঁপড়ারা গাছের পাতা কাছে টেনে শূককীটের তৈরি রেশম সুতা দিয়ে শৃঙ্খলভাবে সেলাই করে তা সুন্দরভাবে বানায়। এটা এদের প্রযুক্তিগত উদাহরণের এক চমকপ্রদ উদাহরণ। এ ধরনের বাসা যথেষ্ট মজবুত ও পানি প্রতিরোধক। ঝড়-বৃষ্টিতে এই পাতার বাসার ক্ষতি হয়ে গেলে কর্মী পিঁপড়ারা দ্রুত অন্য একটি বানিয়ে ফেলার যোগ্যতা রাখে।

আমার বিবেচনায় পিঁপড়া সম্পর্কে অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বের অনেক গবেষণাগারে এদের ওপর কাজ হচ্ছে। গবেষণা প্রাণী (Experimental animal) হিসেবে এদের কদর দিন দিন বড়ছে। সেই তুলনায় আমাদের দেশে তেমন কোনো কাজ হয়নি। আমার জানামতে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাত্র দু–একটি থিসিসের সন্ধান পাওয়া গেছে।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন