­পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী

আমরা যখন এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী কোনটি? তখন তাত্ক্ষণিকভাবে আমাদের জানা বা দেখা অভিজ্ঞতা থেকে হাতির কথাই মনে আসে। হাতি নিঃসন্দেহে বড়। এদের আমরা সব সময় দেখি। কিন্তু আদিকালে পৃথিবীতে চরে বেড়ানো সবচেয়ে বড় প্রাণী ছিল ডাইনোসর। কোনো কোনো ডাইনোসর প্রজাতি ১০-১৫টি হাতির ওজন ও আকৃতির সমান ছিল। এগুলো কমপক্ষে ৬ কোটি বা তারও আগে পৃথিবীতে দাপটের সাথে বিচরণ করত। পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুঘরে এদের কঙ্কাল ও জীবাশ্ম সযতনে রাখা হয়েছে।

তাহলে এক ডাইনোসরই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী? তা-ও ঠিক নয়। পৃথিবীর জীবিত প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী হচ্ছে তিমি। নীল তিমি বা blue whale-এর বৈজ্ঞানিক নাম Balaenoptera musculus।

তিমিকে আমরা অনেকেই মাছ বলে জানি। এমনটা ভাবার সংগত কারণও রয়েছে। তিমি মাছের মতো জলচর প্রাণী এবং মাছের মতো এরও লেজ রয়েছে। তিমিকে মাছ ভাবাটা বড় ধরনের ভুল। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ভুল বিশেষজ্ঞ মহলে ছিল। এই ভুলের প্রধান কারণ, তিমি গভীর জলের বাসিন্দা বলে ষোড়শ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এটির সঠিক বৈজ্ঞানিক শ্রেণীকরণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তিমিকে স্তন্যপায়ী প্রাণী মনে করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সার্বিক বিবেচনায় জীববিজ্ঞানীরা একমত হন, তিমি মাছ নয়; বরং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষও স্তন্যপায়ী প্রাণী। জীববিজ্ঞানের শ্রেণিবিন্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে মাছ, ব্যাঙ, সরীসৃপ ও পক্ষীকুলে পরে স্তন্যপায়ীর অবস্থান।

তিমির আকার-আচরণ

নীল তিমি লম্বায় ১১০ ফুট আর ওজন এক লাখ ৭৩ হাজার কেজি বেশি। এটা ২৫টি হাতির ওজনের চেয়েও বেশি। এদের জিবের ওজন একটি হাতির সমান। (৩-৫ হাজার কেজি) আবার তিমি যে বাচ্চা প্রসব করে, এর ওজন ২ হাজার ৭ শ কেজি। যেকোনো প্রাণীগোষ্ঠীর মধ্যে ছোট-বড় সদস্য থাকে। এখানেও ছোট পিগমি তিমি প্রজাতি রয়েছে। এদের দৈর্ঘ্য মাত্র ১১ ফুট। এগুলো গভীর জলের বাসিন্দা।

তিমি বিশ্বের সব মহাসাগরে কমবেশি রয়েছে। তবে আমাদের বঙ্গোপসাগরে এদের এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না।

এদের দেহগঠন বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। পাঠ্যপুস্তকে তা ‘টর্পেডো’ আকারের বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিমির সামনের বাহু বর্ধিত ও পরিবর্তিত হয়ে পাখনা বা ফিনে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে পেছনের পা প্রায় বিলুপ্ত। তাই এরা দ্রুত চলাফেরা করতে সক্ষম। এদের লেজ সমান্তরালভাবে প্রসারিত। মাছের মতো খাড়া নয়। এদের দেহ মসৃণ ও লোমহীন। দেহত্বক প্রায় ১০ ইঞ্চি পুরু ও চর্বিযুক্ত। তাই এরা প্রচণ্ড ঠান্ডাও সইতে পারে। এদের নাসারন্ধ্র মাথার ওপরে। তা দিয়ে মুখে টেনে নেওয়া পানি ওপরের দিকে ফোয়ারার মতো ছুড়ে দেয়। তিমির বাহ্যিক কান নেই এবং এদের চোখ মাথার দুই পাশে হয়ে থাকে।

প্রজাতিভেদে তিমিদের খাদ্যাভ্যাস প্রধানত দুই ধরনের। এক জাতের তিমি দাঁতের (টুথড হোয়েল) সাহায্যে শিকার ধরে খায়-যেমন মাছ, স্কুইড ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী।

অন্যদিকে আরেক ধরনের তিমি (ব্যালেন হোয়েল) মুখ খুলে পানি টেনে নেওয়ার পদ্ধতি ব্যবহার করে নিজের জালে প্রচুর পরিমাণে অণুবীক্ষণীয় প্রাণী, ক্রিল (ছোট চিংড়িজাতীয় প্রাণী) ও মাছ আটকিয়ে খেয়ে থাকে। এই ব্যাপারটা বিস্ময়কর বৈকি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী সবচেয়ে ছোট আকারের খাবার খায়। দিনে একটি বড় প্রজাতির তিমি প্রায় ৩ হাজার ৫ শ কেজি খাবার খায়।

তিমি ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার সময় প্রচুর বাতাস টেনে প্রায় দুই ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে। সাধারণত ৭-১০ বছরের মাথায় এগুলো প্রজনন সক্ষম হয়। এদের গর্ভধারণকাল ১০-১১ মাস। জন্মের পর শিশু তিমি ৭-৮ মাস মা তিমির দুধ খেয়ে ও এর একান্ত আদর-যত্নে পালিত হয়। শিশু তিমি দিনে প্রায় ৬০ কেজি দুধ খায়। একটি স্ত্রী তিমি এদের জীবনে ৩-৪টির বেশি বাচ্চা দেয় না।

তিমি কত দিন বাঁচে এর নির্দিষ্ট সময়সীমা জানা নেই। প্রজাতিভেদে এগুলো ৮০-১৩০ বছর বাঁচে বলে জানা গেছে।

তিমি আচরণে বেশ সামাজিক। এগুলো দলবদ্ধভাবে সাঁতার কাঠে, ঘুরে বেড়ায়, খেলা করে । কোনো কোনো সময় একটি দলে এক হাজারের মতো তিমি একত্রে চলাফেরা করে বলে জানা গেছে। এগুলো একধরনের বিশেষ শব্দ করে, একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিজেদের দলের কোনো সদস্যের অসুবিধা হলে এরা সাহায্য করতে এগিয়ে যায়। এমনকি কারও মৃত্যু হলে এরা দুঃখ প্রকাশ করতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।

তিমি শিকার ও গবেষণা

তিমির মাংস আমাদের খাদ্যতালিকায় না থাকলেও পৃথিবীর বহু দেশে এর মাংস, চর্বি খাদ্য হিসেবে গ্রহণীয়। এ ছাড়া এদের চামড়া ও পরিপাকতন্ত্রের একধরনের সুগন্ধি বস্তুর যথেষ্ট বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে। তাই আদিকাল থেকে তিমি শিকারের ব্যাপারটা মানুষের আওতাধীন ছিল। তবে তিমি যেহেতু গভীর জলের প্রাণী, তাই এদের শিকার করাটা তেমন সহজসাধ্য ছিল না। বাণিজ্যিকভাবে তিমি সম্পদ আহরণের প্রচলন শুরু হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে।

পরবর্তী সময়ে তিমির ব্যাপক বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে। তাতে আমেরিকাই অগ্রগণ্য অবস্থানে থাকে। তাদের তিমি শিকার শিল্পকারখানায় ১৮৪৬ সালে ৭৩৬টি সমুদ্রগামী জলযান এবং মানবশক্তি নিয়োজিত ছিল ৭০ হাজার। বিংশ শতাব্দীতে তা দাঁড়ায় ২০ লাখে। ফলে অনিয়ন্ত্রিত তিমি শিকারের কারণে (বিশেষ করে নীল তিমি) এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে থাকে। প্রকৃতিতে এর ভারসাম্য রক্ষার জন্য ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক হোয়েলিং কমিশন তিমি শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

তবে তিমি নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োজনে সীমিত আকারে তিমি মারার অনুমতি রয়েছে। এই ‘ক্লাসিফায়েড’ আইনের আওতায় গবেষণা যেহেতু গোপনীয়, তাই এই সুযোগে ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডার অনেক তিমি শিকার কোম্পানি অবৈধভাবে তিমি শিকার করছে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থার অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশেও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে (১৯৭৪) তিমি মারা নিষেধ রয়েছে। তবে আমাদের দেশে বাণিজ্যিক তিমি শিকারের কোনো ইতিহাস নেই।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী এবং খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক