প্রক্রিয়াজাত খাবার স্থূলতা বাড়াচ্ছে?

বিশ্বজুড়ে স্থূলতা বাড়ছেই। ১৯৭৫ থেকে ২০১৬ সাল—এই ৪১ বছরে বিশ্বজুড়ে স্থূল মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন গুণ। স্থূলতা হার্টের অসুখ ও ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকি বাড়ায়। সাধারণত, এর জন্য দায়ী করা হয় খাবারে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকাকে। কিন্তু নতুন এক গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে, এসবের বাইরেও স্থূলতার জন্য দায়ী অন্য কিছু। উন্নত বিশ্বে মানুষ প্রক্রিয়াজাত খাবারের দিকে বেশি বেশি ঝুঁকে পড়ছে। এসব খাবারে চিনি, লবণ, তেল, সুগন্ধি—এসবের ব্যবহার অনেক বেশি। তাই আমাদের অন্ত্র আর মস্তিষ্কের মিতালিটা ঠিক জমছে না। মস্তিষ্ক অন্ত্র থেকে গৃহীত খাদ্যের পরিমাণের হিসাব গুলিয়ে ফেলছে। তাই আমরা খাবার যে যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে, সেটা বোঝার আগেই বেশি খেয়ে ফেলছি।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেসের গবেষক কেভিন হল নতুন এই ধারণা নিয়ে দুটি কাজ করেছেন। তাঁর প্রথম গবেষণায় তিনি দেখান, কম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ মেদ কমানোর হার কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ খাবারে শর্করার পরিমাণ কম রেখে শরীরের মেদ ঝরানোর যে প্রচলিত কৌশল, সেটি আসলে খুব একটা কাজের নয়। এ বছর আরেকটি গবেষণায় তিনি দেখান, আমরা অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার যখন খাই, তখন সাধারণ খাবারের তুলনায় কয়েক শ কিলোক্যালরি বেশি গ্রহণ করি।

আপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, আপনাকে নিশ্চয়ই প্যাকেটজাত কিংবা ফাস্ট ফুড খুবই টানে। কোথাও যাওয়ার পথে চিপস আর কোমল পানীয়, বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যায় বের হয়ে একটা পিৎজা—এসব নিশ্চয়ই আপনার নিত্যদিনের সঙ্গী। যদিও বাংলাদেশে এখনো এসব প্রক্রিয়াজাত খাবার একদম জেঁকে বসেনি, তবে পশ্চিমা বিশ্বে নিত্যদিনের সঙ্গী এসব খাবার। খিদে মেটানোর জন্য তাদের প্রধান নির্ভরতা এসব ‘রেডি টু ইট’ খাবার। অতি প্রক্রিয়াজাত এসব খাবারে তেল, চর্বি, চিনি, রং, ফ্লেভার, ক্যালরিবিহীন মিষ্টিকারক ইত্যাদির বাহার যেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যে রকম খাবার খেয়ে আসছে, তার সঙ্গে এসব খাবারের উপাদানের ও পরিমাণের তফাত অনেক। আমাদের দেহ যেন হুট করে শেষ ১০০ বছরে বদলে দেওয়া খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিমই খাচ্ছে।

কার্ব টেস্ট

গবেষক কেভিন হল একটা পরীক্ষা করেন খাবারে শর্করার পরিমাণ নিয়ে। তিনি ১০ জন পুরুষ ও ৯ জন নারীকে একটি হাসপাতালের ওয়ার্ডে রাখেন কিছুদিনের জন্য। তাঁদের সবাই ছিলেন স্থূল। ১১ দিনের এই পরীক্ষায় প্রথম ৫ দিন সবাইকে বেশি কার্বোহাইড্রেট ও অল্প স্নেহজাতীয় খাবার খেতে দেওয়া হয়। তাঁদের খাবারে ৫০ শতাংশ শর্করা, ৩৫ শতাংশ স্নেহ ও ১৫ শতাংশ প্রোটিন রাখা হয়। বিশেষ একটি চেম্বারে রেখে তাঁদের দৈনিক ক্যালরি খরচ হিসাব করে একদম ঠিক ততটুকুই খাবার দেওয়া হতো। যেন তাঁদের ওজন একটুও না বাড়ে বা কমে। এর পরের ছয় দিন শর্করার পরিমাণ নামিয়ে আনা হতো ২০ শতাংশে।

কয়েক দিন পর ঠিক এই পরীক্ষা আবারও করা হয় সেই ১৯ জন মানুষের ওপরই। দুবারই দেখা যায়, যখন শর্করা–স্নেহের অনুপাত কমিয়ে ফেলা হচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই রক্তে ইনসুলিন কমে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যায়, এটি শরীরের জমা মেদ থেকে খুব একটা শক্তি খরচ করাতে পারছে না। অর্থাৎ কম ইনসুলিন থাকলেই যে শরীরের মেদ খরচ হতে শুরু করবে, সে রকম নয় ব্যাপারটা। বরং উল্টো ঘটনা দেখা যায়, এতে শরীরের মেদ খরচ করার হার কমে যাচ্ছে। এই গবেষণা সেল মেটাবলিজম জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়।

কয়েক মাস পর এই এক্সপেরিমেন্ট আবার করা হয়। এবার ভলান্টিয়ারদের আট সপ্তাহ রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে (এনআইএইচ)। শর্করা থেকে ক্যালরির পরিমাণ একদমই কমিয়ে দেওয়া হয়। তবু দেখা যায়, সেটি দেহের মেদ কমাতে কোনো সাহায্যই করছে না। ২০১৬ সালে আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন-এ প্রকাশিত গবেষণায় এই এক্সপেরিমেন্টের বরাত দিয়ে তাঁরা দাবি করেন, ডায়েটে শর্করার পরিমাণ আসলে শরীরের মেদের পরিমাণে কোনো অর্থপূর্ণ প্রভাবই রাখতে পারছে না। তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কিছু দায়ী?

পশ্চিমা বিশ্বে লোকজন যে হারে মুটিয়ে যাচ্ছে, সেটা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। এখন হরেক রকম খাবার পাওয়া যায়, সেটা ঠিক। এখনকার খাবারগুলো আগের যুগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্বাদু ও আকর্ষণীয়। সে জন্যই কি মানুষ বেশি খাচ্ছে? নাকি যথেষ্ট খাবার গ্রহণের পরও মানুষের খিদে মিটছে না?

প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রভাব

শত বছর আগেও পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই খেতখামারে উৎপাদিত খাবারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। হুট করে গত শতকের শেষে এসে এই নির্ভরতা চলে গেছে ইন্ডাস্ট্রির দিকে। একজন আমেরিকানের দৈনিক গৃহীত ক্যালরির প্রায় ৫৮ শতাংশ এবং চিনির ৯০ শতাংশ আসে ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসা পণ্য থেকে। এসব পণ্যে উপাদানগুলো এমন কম্বিনেশনে থাকে, যা প্রাকৃতিক খাবারে কখনোই পাবেন না। চিপসের মতো লবণাক্ত কিংবা পেস্ট্রির মতো উচ্চ চর্বি আর মিষ্টিযুক্ত খাবার আপনি কখনো প্রকৃতিতে পাবেন? না। এমনকি পাউরুটি কিংবা প্রক্রিয়াজাত মাংসের মতো স্বাস্থ্যকর খাবারেও উপাদানের কম্বিনেশনটা প্রাকৃতিক নয় একদমই।

১৯৭০ সাল থেকে হিসাব করলে আমেরিকানদের দৈনন্দিন গৃহীত গড় শক্তি প্রায় ৬০০ কিলোক্যালরি বেড়ে গেছে। এটা কেন হলো? এর আগে তারা খাদ্যাভাবে ছিল, তেমন না কিন্তু। হুট করে ৫০ বছরে এত পেটুক হয়ে উঠল একটা জাতি। কেন? উত্তরটা খুঁজতে হলো আরেকটা পরীক্ষা করে, ২০১৮ সালে।

এবার শুনুন সেল মেটাবলিজম জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণার গল্প। আবারও সেই এনআইএইচের একটি ওয়ার্ড। এবার ২০ জন ভলান্টিয়ার। দৈবচয়নে কেউ পাবেন অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার, কেউ পাবেন সাধারণ খাবার। এ রকম খাবার চলল দুই সপ্তাহ ধরে। এরপর উল্টে দেওয়া হলো। যিনি প্রক্রিয়াজাত খাবার খেয়েছেন এত দিন, তিনি পাবেন সাধারণ খবার। অন্যরাও উল্টো। আবারও দুই সপ্তাহ দেখা হলো। এ সময় ডায়েটিশিয়ানরা দুই দলের জন্যই যে খাবার তৈরি করেন, তাতে শর্করা, আমিষ, স্নেহ, চিনি, সোডিয়াম ইত্যাদির আদর্শ কম্বিনেশনই তৈরি করে দেন। আর ভলান্টিয়ারদের বলা হয় ততখানিই খেতে, যতখানি তাঁর খেতে ইচ্ছে করে। এক কথায়, তাঁরা খিদে মেটানোর জন্য খাবেন।

গবেষকেরা অবাক হয়ে দেখলেন, যাঁরা প্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছেন, তাঁরা প্রায় ৫০০ কিলোক্যালরি বেশি গ্রহণ করছেন। অন্য দুই সপ্তাহে স্বাভাবিক খাবার খাওয়ার সময় তাঁরা ৫০০ কিলোক্যালরি কম খাচ্ছেন! প্রায় সবাই দুই সপ্তাহ অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার খেয়ে দুই পাউন্ড ওজন বাড়িয়ে ফেলেছেন!

অন্ত্র-মস্তিষ্কের মিতালি

ইয়েল ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট ডানা স্মল দাবি করেন, এর একটা ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেন। আমরা যখন খাই, তখন আমাদের পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র আর বৃহদান্ত্র মস্তিষ্ককে ভ্যাগাস নার্ভের মাধ্যমে জানাতে থাকে, কতটুকু খাবার আসছে পেটে। সেসব সিগন্যালে কতটুকু শক্তি গ্রহণ করা হলো, তারও একটা ধারণা দেয় পেট। এর সঙ্গে মস্তিষ্ক মুখে পাওয়া স্বাদ–গন্ধের হিসাবটাও মিলিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, কখন খাওয়া বন্ধ করা উচিত। কখন সন্তুষ্ট হতে হবে। কিন্তু বিপদ হয় যখন এসব অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার আমরা খাই। এতে উপাদানের কম্বিনেশনটা বুঝে ওঠার সময় এখনো মানুষ পায়নি। হাজার বছর ধরেই এই প্রাজাতি অন্য কম্বিনেশন দেখে আসছে। তাই আসলেই কতটুকু খাওয়া হলো, সেটা বোঝার উপায় থাকে না মানুষের।

ধরুন, আপনি যদি চিনি-মধু দিয়ে মিষ্টি করা একটি খাবার খান, আপনি বুঝতে পারেন, এটুকু মিষ্টি হলে এতে এতখানি ক্যালরি আপনি পাচ্ছেন। কিন্তু আজকাল স্থূলতার সমস্যা দূর করতেই ননক্যালরি সুইটেনার ব্যবহার করা হয়। যার স্বাদ মিষ্টি, কিন্তু ক্যালরি নেই। এখন এটি খাওয়ার পর আপনার মস্তিষ্ক প্রথমে ধরে নিচ্ছে, আপনি যথেষ্ট শক্তির খাবার গ্রহণ করে ফেলেছেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যায়, শরীর বুঝছে শক্তি গ্রহণ যথেষ্ট হয়নি। শক্তির অভাব দেখা যাচ্ছে। এরপর খাওয়ার সময় আপনার মস্তিষ্ক বেশি খাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে, অর্থাৎ আপনার পেট ভরছে বেশি খাওয়ার পর।

আরও সমস্যা হয় যখন একই খাবারে চিনি আর ননক্যালরি সুইটেনারের মিশ্রণ থাকে। মস্তিষ্ক কোনোমতেই হিসাবটা মেলাতে পারে না। আবার ধরুন, প্রকৃতিতে যে খাবারে শর্করা আছে, সেই খাবারে আঁশ-তন্তুও থাকে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির খাবারে শর্করার প্রয়োজনে শুধু শর্করাই দেওয়া হয়, ফাইবারের বালাই থাকে না। আবার কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া শর্করা আর প্রোটিন এক খাবারে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত খাবারে দুটির আধিক্য একসঙ্গে পাওয়া নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। এসবের কারণে মস্তিষ্ক ঠিক হিসাবই মেলাতে পারছে না, কতটুকু খাওয়াকে ‘যথেষ্ট’ বলা যেতে পারে।

মত-দ্বিমত

নিউট্রিশনের প্রফেসর রিক মেটস তো একরকম খেপছেনই কেভিন হলের ওপর। তিনি বলছেন, যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই মানুষকে ভুলভাল বোঝানোর চেষ্টা করছেন হল। গবেষণায় ভলান্টিয়ারদের হয় প্রক্রিয়াজাত, নইলে সাধারণ, যেকোনো একটি খাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা মিক্সড ডায়েটে অভ্যস্ত। আর এভাবে এক্সপেরিমেন্ট করে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

হলের এক্সপেরিমেন্টের একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, অতিপ্রক্রিয়াজাত খাদ্যে অল্প খাবারে অনেক বেশি ক্যালরি থাকে এবং এটি খুব দ্রুত খাওয়া যায়। তাই মানুষ বেশি খায়। তবে এই ব্যাখ্যার সমস্যা হলো, একবার বেশি খেলে তো পরের বেলায় কম খাওয়ার কথা, কারণ তার পরের বেলায় কম খিদে থাকবে। তাই বলা যায়, সমস্যাটা খিদে লাগা নিয়েই। আবার আরেকটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এসব ইন্ডাস্ট্রি থেকে পাওয়া খাবার ভিটামিন-মিনারেলের পরিমাণটায় ঘাটতি রাখছে। তাই আমাদের শরীর বেশি বেশি খেতে চাইছে।

অসময়ে মুটিয়ে যাওয়ায় সামাজিক হেনস্তা যেমন বড় সমস্যা, তেমনি বড় সমস্যা নানা রকম অসুখের ঝুঁকি। এর থেকে মুক্তির উপায় হতে পারে কম কম প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া। আমরা যদি অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া কমিয়ে দিই, তবে ইন্ডাস্ট্রিগুলোও প্রসেস করা খাবারের চেয়ে ননপ্রসেসড খাবার বেচতে শুরু করবে। সেটি হয়তো আমাদের অভ্যাসটা আবারও বদলে দিতে পারে। আর একই সঙ্গে মস্তিষ্কও যেন ক্যালরির হিসাবটা ঠিকঠাক করতে পারবে।

সূত্র: সেল মেটাবলিজম (ভলিউম ৩০, ইস্যু ১), সায়েন্টিফিক আমেরিকান