বহুরূপী ব্যাকটেরিয়া

দেবতা প্রোটিয়াস। গ্রিক উপকথার সমুদ্রদেবতা পসেইডনের পুত্র তিনি। তাঁকে সাগরের প্রাণিকুল ও নদীর দেবতা হিসেবেও ডাকা হয়। গ্রিক মহাকবি হোমার তাঁর মহাকাব্য ওডিসিতে প্রোটিয়াসকে আখ্যা দিয়েছেন ‘ওল্ড ম্যান অব দ্য সি’ বা সাগরবুড়ো হিসেবে।

দেবতা প্রোটিয়াসের ছিল এক অদ্ভুত ক্ষমতা। তিনি বদলে ফেলতে পারতেন তাঁর শরীরের আকার–আকৃতি। শত্রুর হাত থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্যই তাঁর এ রূপ বদলানো। নিজেকে বদলে ফেলতে পারতেন বলে তাঁকে সাগরের জল ও ঢেউয়ের ক্রমাগত বদলে যাওয়ার জন্যও দায়ী করা হয়। দেবতা প্রোটিয়াসের এমনি বদলে যাওয়ার ক্ষমতার কারণেই তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখে ইংরেজি ‘প্রোটিয়ান’ শব্দটির উৎপত্তি। প্রোটিয়ান শব্দের অর্থ নিয়ত পরিবর্তনশীল বা বিচিত্ররূপী।

দেবতা প্রোটিয়াস যেমন করে শরীরের আকৃতি বদলে ফেলতে পারেন, তেমনিভাবে একটি ব্যাকটেরিয়া তার গঠন বদলে ফেলে বহুরূপী সাজতে পারে মানুষকে আক্রমণ করার জন্য। সে বহুরূপী ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছিলেন জার্মান প্যাথলজিস্ট গুস্তাভ হাউজার ১৮৮৫ সালে। ব্যাকটেরিয়ার আকার বদলে ফেলার বিষয়টি গুস্তাভ হাউজারকে মনে করিয়ে দিয়েছিল হোমারের মহাকাব্য ওডিসিতে উল্লেখ করা গ্রিক দেবতা প্রোটিয়াসের কথা। এ ব্যাকটেরিয়া মানব শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য আকার বদল করে ফেলতে পারে, দেবতা প্রোটিয়াসের মতোই। তাই দেবতা প্রোটিয়াসের নামে তিনি এ ব্যাকটেরিয়ার নাম রাখেন প্রোটিয়াস।

প্রোটিয়াস ব্যাকটেরিয়ার রয়েছে অনেকগুলো প্রজাতি, এমনি একটি প্রজাতির নাম প্রোটিয়াস মিরাবিলিস (Proteus mirabilis)। মূত্রনালির সংক্রমণ ও কিডনিতে পাথর জমার ক্ষেত্রে এ ব্যাকটেরিয়ার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। প্রোটিয়াসের মাধ্যমে সৃষ্ট রোগের মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশি রোগ সৃষ্টি করে যে ব্যাকটেরিয়া, সেটি প্রোটিয়াস মিরাবিলিস। এটি অত্যন্ত চলনক্ষম গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া। এর রয়েছে চাবুকের মতো দেখতে অনেক ফ্লাজেলা, যা দিয়ে এটি সহজেই কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে, লেগে থাকতে পারে আঠার মতো।

প্রোটিয়াস মিরাবিলিস মানুষের অন্ত্রে পাওয়া যায় স্বাভাবিক অণুজীব হিসেবেই। এটি সাধারণত ক্ষতিকারক নয়। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল, তারা এর আক্রমণের শিকার হতে পারেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে যারা ক্যাথেটার নল দিয়ে মূত্র ত্যাগ করে, তারা ক্যাথেটারের মাধ্যমে মূত্রনালির সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। প্রোটিয়াস মিরাবিলিসের আক্রমণে মূত্রনালি সংক্রমণের প্রকোপ মূলত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। মূত্রনালিতে ইউরিয়ার সংস্পর্শে এলে এ ব্যাকটেরিয়া ক্ষতির কারণ হয়। এর সংক্রমণ মূত্রনালি থেকে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তা মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে। শুধু মূত্রনালির সংক্রমণই নয়, কিডনি ও মূত্রথলিতে পাথরও তৈরি করতে পারে এ ব্যাকটেরিয়া। প্রোটিয়াস মিরাবিলিসের একটি বড় অংশ প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন বলে এর চিকিৎসা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে।

প্রোটিয়াস মিরাবিলিস কীভাবে রোগ সৃষ্টি করে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রথমে এ ব্যাকটেরিয়া মানুষের মূত্রনালিতে কলোনি বা বসতি গড়ে তোলে। তারপর কৌশলে শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে আক্রান্ত করে মানুষকে। মানব শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এ ব্যাকটেরিয়া হয়ে ওঠে গ্রিক দেবতা প্রোটিয়াসের মতোই বহুরূপী, বদলে ফেলে নিজের আকার–আকৃতি।

প্রোটিয়াস ব্যাকটেরিয়ার রয়েছে চাবুকের মতো দেখতে ফ্লাজেলা নামক অঙ্গ। মানুষের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে আক্রমণের জন্য ফ্লাজেলাগুলোর আকার বদলে ফেলে প্রোটিয়াস ব্যাকটেরিয়া। আকার বদলানোর জন্য কাজ করে তিনটি আলাদা ফ্লাজেলিন জিন। এ জিনগুলো একত্র হয়েই তৈরি করে নতুন ফ্লাজেলা। এমনিভাবে নতুন অঙ্গ ফ্লাজেলা তৈরি করার মাধ্যমে প্রোটিয়াস মিরাবিলিস হয়ে ওঠে বহুরূপী। অবশ্য, মানুষের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে আক্রমণের জন্য এ পদ্ধতিই প্রোটিয়াস মিরাবিলিসের একমাত্র পদ্ধতি নয়। এর বাইরেও আরও কয়েকটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধক উপাদান অ্যান্টিবডিগুলোর মধ্যে একটি হলো ইমিউনোগ্লোবিউলিন এ। প্রোটিয়াস মিরাবিলিস ব্যাকটেরিয়া ইমিউনোগ্লোবিউলিন-এ ডিগ্রেডিং প্রোটিয়েজ নামক এনজাইম নিঃসরণ করে। ফলে তা ইমিউনোগ্লোবিউলিন এ অ্যান্টিবডিকে ভেঙে ফেলে, তখন মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, দেখা দেয় সংক্রমণ। অ্যান্ডোটক্সিন ও ইউরিয়েজ নিঃসরণের মাধ্যমেও মানুষকে সংক্রমিত করে প্রোটিয়াস মিরাবিলিস। ইউরিয়েজ মানুষের কিডনিতে পাথর তৈরিতে ভূমিকা রাখে, যেখানে প্রোটিয়াস মিরাবিলিস নিরাপদে আশ্রয় নেয় এবং অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখে। মানুষকে রোগাক্রান্ত করার এ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি অন্য ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও লক্ষ করা যায়।

সেই কবে, ১৮৮৫ সালে গুস্তাভ হাউজার আবিষ্কার করেছিলেন প্রোটিয়াস মিরাবিলিস ব্যাকটেরিয়া, ১৩৪ বছর বছর। এত বছর ধরে এই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা চলেছে নিরন্তর। ২০০৮ সালের ২৮ মার্চ মেলানি পিয়ারসন নামে একজন গবেষক প্রোটিয়াস মিরাবিলিসের জিনোম সিক্যুয়েন্স অর্থাৎ জীবনরহস্য উদ্‌ঘাটন করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি এ ব্যাকটেরিয়ার ৩৬৫৮টি কোডিং সিক্যুয়েন্স এবং ৭টি rRNA লোকাই শনাক্ত করেন। তাঁর এ উদ্‌ঘাটন নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয় বৈজ্ঞানিক জার্নালে। নিবন্ধে তিনি প্রোটিয়াস মিরাবিলিসকে আঠার মতো লেগে থাকা ও চলনশীলতার মাস্টার হিসেবে উল্লেখ করেন। শুধু তা–ই নয়, মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রোটিয়াস মিরাবিলিস সিদ্ধহস্ত, তার প্রমাণ তো পাওয়া গেছে সেই কবেই।

লেখক: ডেন্টাল স্পেশালিস্ট, তায়েফ ডেন্টাল হাসপাতাল, সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়