বায়ো-বিজ্ঞানচিন্তা

চিত্র: ১

জীববিজ্ঞান, অনেকের কাছে নিতান্ত নীরস বিষয়, আবার কারও কাছে শ্বাসরুদ্ধকর। অথচ আমরা নিজেরাই জীব। তাই আমাদের উচিত নিজের দেহের নিযুত-কোটি কোষের মধ্যে সদা ঘটে যাওয়া নানান প্রক্রিয়ার কিছু অংশ জেনে রাখা। জীববিজ্ঞানীরা ‘কোষ’ শব্দটি দিয়ে ঠিক কী বোঝান, সেটি অনেকেরই মাথায় ঢোকে না। আবার প্রোটিন বলতে ডিম, দুধ, ডাল বা এক টুকরো মাংসই বোঝে। কিন্তু কোষের মধ্যে ঠিক কোথায় প্রোটিন থাকে, সেটি আমরা বুঝতে পারি না। একই কথা খাটে ডিএনএ, আরএনএ নিয়েও। সবকিছু মিলিয়ে এ যেন এক জগাখিচুড়ির জগৎ। আজকের এই আলোচনায় আমরা এই জগাখিচুড়ি জগত্টাকে সাদা ভাত বানিয়ে গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করব।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে আনুমানিক ১ লাখ বিলিয়ন কোষ থাকে। এ কোষগুলোর সবই দেখতে একই রকম নয়। যেমন আমাদের ত্বক থেকে জিবের গঠন আলাদা। আবার ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের নিজেদের গঠনও আলাদা। এমনটি হয় ভিন্ন ভিন্ন কোষের ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন তৈরির প্রবণতা থেকে। প্রাণীদেহের কোষগুলো একই ডিএনএ বহন করলেও দেহে কোষের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে কোষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন জিন প্রকাশিত হয়।

ডিএনএ কি জিন? প্রোটিনই-বা কী? এসব সঠিকভাবে বুঝতে হলে জানতে হবে কোষের গঠন সম্পর্কে (চিত্র ১ দ্রষ্টব্য)। প্রাণীকোষের কেন্দ্রবিন্দু হলো নিউক্লিয়াস। এর মধ্যে সুতোর গোলার মতো প্যাঁচানো অবস্থায় ডিএনএ থাকে। অবাক বিষয় হলো একজন মানুষের দেহের সব নিউক্লিয়াসের সব ডিএনএর প্যাঁচ ছাড়িয়ে পরস্পর লম্বালম্বিভাবে যুক্ত করলে দৈর্ঘ্যে সেটা সৌরজগতের ব্যাসার্ধের দ্বিগুণ হবে! নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্যাঁচানো ডিএনএগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রোটিন দিয়ে একটি সুসংবদ্ধ আকৃতিতে থাকে, যাকে বলে ক্রোমোজোম। এসব ক্রোমোজোমের প্যাঁচ ছাড়িয়ে ডিএনএর কিছু কিছু অংশ প্রোটিন তৈরিতে অংশ নেয়। সেগুলোকেই বলা হয় জিন (চিত্র ২ দ্রষ্টব্য)। ডিএনএর একটি জিন থেকে প্রথমে প্রস্তুত হয় ডিএনএ, আর এই ডিএনএর মধ্যেই লিপিবদ্ধ থাকে প্রোটিনটির চেহারা।

চিত্র: ২

একটি জিন থেকে এক বা একাধিক প্রোটিন তৈরি হতে পারে। আমাদের দেহে প্রায় ২১ হাজার প্রোটিন উত্পাদনের জিন আছে। তবে দেহে উত্পাদিত প্রোটিনের সংখ্যা ২.৫ থেকে ১০ লাখ। কোষে ৫০ শতাংশের বেশি অংশ জুড়ে থাকে পানি। এই পানির সুইমিংপুলে সাঁতরে বেড়ায় যাবতীয় অঙ্গাণু ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রোটিন। আমাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনা-কর্মকাণ্ড এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রোটিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কোষ নিজেও এর ভেতরের যাবতীয় অঙ্গাণু (নিউক্লিয়াস, মাইটোকন্ড্রিয়া ইত্যাদি) নির্দিষ্ট গঠনের ঝিল্লি বা পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। এসব ঝিল্লি একদিকে কোষ বা অঙ্গাণুগুলোকে রক্ষা করে, অন্যদিকে বিভিন্ন অতিক্ষুদ্র জৈব/অজৈব উপাদানের আদান-প্রদান নিয়ন্ত্রণ করে।

জীববিজ্ঞানীরা কোষীয় অঙ্গাণু ও প্রোটিনগুলো সঠিকভাবে জানতে অনেক ধরনের অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে থাকেন। আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সাধারণত কোষের আকৃতি ও তাতে নিউক্লিয়াসের অবস্থান দেখা যায়। অন্যদিকে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কোষের অঙ্গাণুগুলোর অতি সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মাইক্রোস্কোপিক নানা টেকনিকের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ইম্যুনোফ্লুরোসেন্স (প্রতিপ্রভা) মাইক্রোস্কোপি। এ পদ্ধতিতে কোষের বিভিন্ন অঙ্গাণু বা তাদের প্রোটিনদের বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ করা হয়। তবে প্রোটিন রং করার এই প্রক্রিয়াটির নেপথ্যে রয়েছে বায়োলজির আরেক শাখা ‘ইম্যুনোলজি বা প্রতিরোধবিদ্যা’।

বিজ্ঞানের এই শাখা আলোচনা করে অ্যান্টিবডি নিয়ে। অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিবায়োটিক কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রথমটা হলো প্রতিরোধ কোষ থেকে প্রস্তুত প্রতিরক্ষা-প্রোটিন। এটি অন্য কোনো প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। আর পরেরটি হলো একধরনের রাসায়নিক উপাদান, যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াদের দমনে ব্যবহূত হয়। প্রাণী নিজ দেহেই অ্যান্টিবডি বানায় সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় বা ধ্বংস করতে। কিন্তু আমাদের প্রতিরোধ কোষ যদি কখনো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ দমনে ব্যর্থ হয়, তখন প্রয়োজন পড়ে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের। নির্দিষ্ট একটি প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়াকারী এসব অ্যান্টিবডিকে প্রাণীদের রক্ত থেকে আলাদা করে পরীক্ষাগারে বিভিন্ন গবেষণার জন্য ব্যবহার করা যায়। এমনই একটি প্রয়োগ হলো ইম্যুনোফ্লুরোসেন্স মাইক্রোস্কোপি, যেখানে অ্যান্টিবডিদের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয় বিশেষ একধরনের রং, যা মাইক্রোস্কোপের নিচে বিশেষ আলোয় প্রজ্বলিত হয়।

মাইক্রোস্কোপের সঙ্গে যুক্ত ক্যামেরায় প্রজ্বলিত প্রোটিনের ছবি তুলে পরে কম্পিউটার সফটওয়্যারে ছবিগুলোকে যুক্ত করে কোষের ভেতরে প্রোটিনদের অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, কোষগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস। আবার কোষগুলো একে অপরের সঙ্গে গায়ে গায়ে লেগে আছে। যেহেতু প্রাণীদের কোষে কোষপ্রাচীর থাকে না, তাই কোষঝিল্লি কোষদের রক্ষা করে। কোষঝিল্লিতে অনেক ধরনের প্রোটিন পাওয়া যায়, যা পাশাপাশি দুটি কোষকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকতে সহায়তা করে।

এ ছাড়া দেখা যায় একটিন ফিলামেন্টদের। এই ফিলামেন্টগুলো (তন্তু) কোষময় ছড়িয়ে থেকে অনেকটা কঙ্কালতন্ত্রের মতো কোষদের আকৃতি দেয়। কোষদের গতিবিধি ও প্রয়োজনে একটি স্থানে কোষদের লেগে থাকা ইত্যাদিও এসব ফিলামেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কোষের অভ্যন্তরে অনেক ক্ষুদ্র প্রোটিন এই ফিলামেন্টগুলোর পথ বেয়ে নিউক্লিয়াস থেকে কোষঝিল্লির দিকে অথবা এর বিপরীতে চলাফেরা করে।

এ ছাড়া দেখা যাবে গলজি বস্তু-নিউক্লিয়াসের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে এরা। গলজি বস্তুদের কোষের পোস্ট অফিস বলা যায়। কোষদের প্রধান কাজ পুষ্টি গ্রহণ করে প্রোটিন তৈরি করা আর গলজিদের কাজ হলো প্রোটিনগুলোর সঠিক রূপ ও বন্ধন যাচাই করে তাদের যথাযথ স্থানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।

আমরা মনে করি, মাইটোকন্ড্রিয়া দেখতে অনেকটা বাদামের মতো। কিন্তু এরা কোষের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে সারি সারিভাবে যুক্ত থেকে তাদের নিজস্ব তন্তু গঠন করে। এদের কোষের পাওয়ার হাউস বা শক্তিঘর বলা হয়। এদের কাজ হলো পুষ্টি গ্রহণ করে কোষদের শক্তি প্রদান করা। খেয়াল করলে দেখা যাবে কীভাবে মাইটোকন্ড্রিয়ার তন্তুগুলো নিউক্লিয়াস ঘিরে রেখেছে এবং কোষঝিল্লিময় বিস্তৃত রয়েছে।

কোষ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। ভাইরাস কোষকে আক্রমণ করার পর কোষ তার নিজস্ব প্রোটিন উত্পাদন বাদ দিয়ে ভাইরাসের প্রোটিন উত্পাদন করা শুরু করে। ফলে কোষদের মৃত্যু ঘটে এবং ভাইরাসগুলো মৃত কোষ থেকে বেরিয়ে সুস্থ কোষকে আক্রমণ করে।

বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জ্ঞানের গভীরতম স্তরে প্রবেশ করছি। এই ক্রমবর্ধমান জ্ঞান আমাদের জানার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এককালে মোটা দাগে দেখা মানবদেহকে আমরা কোষ পর্যায়ে গবেষণা করতে শিখেছি অনেক আগেই। আর তা করতে গিয়ে আমরা এখন আলোচনা করি বিভিন্ন প্রোটিন ও এদের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে। গবেষণার আরও গভীরে ঢুকে আমাদের আলোচ্য এখন ন্যানোবায়োলজি ও কোয়ান্টাম বায়োলজি। এখানে বায়োলজির পাশাপাশি পদার্থ ও রসায়নের নিগূঢ় জ্ঞানের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, গবেষণার এখানেই শেষ নয়, বায়ো-বিজ্ঞানের এই চর্চা সবই চলতে থাকবে অনাদিকাল পর্যন্ত।

লেখক: গবেষক, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য

সূত্র: লেখকের নিজস্ব গবেষণাপত্র

* লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত