ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কালো থাবা

সম্প্রতি ভারতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের মুখে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো শুরু হয়েছে কালো ছত্রাকের আক্রমণ। কোভিড-১৯-এর সঙ্গে কালো ছত্রাকের সম্পর্ক কী? কেন শুধু ভারতেই ব্যাপক হরে এর সংক্রমণের কথা শোনা যাচ্ছে ?

কালো ছত্রাকের সংক্রমণকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মিউকরমাইকোসিস। এটা মূলত রাইজোপাস বা মিউকর জাতীয় ছত্রাকের সংক্রমণে হয়। এসব ছত্রাক পরিবেশে, বিশেষ করে মাটি, পঁচে যাওয়া জৈব পদার্থ যেমন, পঁচা ফলমূল পাতা বা পশুর বিষ্ঠায় ছড়িয়ে থাকে। এসব ছত্রাককে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম মিডিয়াতে যখন বৃদ্ধি করা হয় এদের রং হয় গাঢ় বাদামি বা কালো। তাই এদের কালো ছত্রাক বলা হয়। যেহেতু পরিবেশে যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকে এসব ছত্রাক, মানুষ প্রতিনিয়তই মুখোমুখি হয় এসব ছত্রাকের। কিন্তু বেশিরভাগ সুস্থ্য মানুষের জন্য এ সব ছত্রাক ক্ষতিকর নয়। কারণ সুস্থদেহে রয়েছে শক্তিশালী রোগপ্রতিরোধীব্যবস্থা। সমস্যা হলো, সেসব মানুষে যাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে বা যাদের ডাইয়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগ রয়েছে বা যেসব মানুষ রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থাকে দমিয়ে রাখে এমন চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে এই ছত্রাকের প্রভাব ভয়াবহ। ইমিউন সিস্টেম এ ঘাটতির কারণে এসব রোগীর কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ রকম ঝোপ বুঝে কোপ মারার বৈশিষ্ট্যের কারণে কালো ছত্রাককে সুযোগসন্ধানী অণুজীবও বলা হয়।

বাতাসে ভাসতে থাকা কালো ছত্রাকের স্পোর বা বীজগুটি নিঃশ্বাসের সাথে সাইনাস বা ফুসফুসে চলে যায়। শরীরে কাটা-ছেঁড়া বা ক্ষতের মাধ্যমে কালো ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। কালো ছত্রাকের সংক্রমণে নানা রকম রোগলক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন, সাইনাসের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সংক্রমণ হতে পারে। বিশেষ কের ডায়াবেটিস রোগী বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট রোগীদের মধ্যে। এসব রোগীদের জ্বর, মাথা ব্যাথা, নাকের ভেতর কালো রঙের ক্ষত, চোখ এবং মুখমণ্ডলের একপাশ ফুলে উঠার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে । ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ফুসফুসে সংক্রমণ হতে পারে। যা থেকে হতে পারে জ্বর , কফ, বুকে ব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট । আবার অল্পবয়সী শিশুদের মধ্যে পেটে ব্যাথা, বমি, ও খাদ্যনালীতে রক্তক্ষরণের কারণ হতে পারে কালো ছত্রাক । এমনকি সুস্থ দেহেও কখনো চর্মরোগের কারণ হতে পারে কালো ছত্রাক। গুরুতর রোগীদের মধ্যে কালো ছত্রাকের সংক্রমণ সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা থেকে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, কোমা চলে যাওয়া এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। যুদ্ধাহত রোগীদের মধ্যে কালো সংক্রমণে শরীরের ক্ষত পঁচে মারা যাওয়ার নজিরও আছে।

করোনাকালীন সময়ে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কালো ছত্রাকের প্রাদুর্ভাবের কথা তেমন না শোনা গেলেও ভারতে এর সংক্রমণের কারণটা খুবই পরিষ্কার। করোনাপূর্ব পৃথিবীতে কালো ছত্রাকের সংক্রমণের হার পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে প্রতি লক্ষে একজনেরও নিচে, ভারতে তা ১৪ জন। ভারতে প্রতিবছর গড়পড়তা প্রায় দুলক্ষ লোক কালো ছত্রাকের সংক্রমণে ভোগে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কালো ছত্রাকের সংক্রমণের ঝুঁকি আরো অনেক বেশি। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। করোনাভারাসের সংক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসে কালো ছত্রাকের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। আবার গুরুতর করোনা রোগীদের সাইটোকাইন স্টর্ম রোধ করতে কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ড্রাগ দিয়ে রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থা কে যখন দমিয়ে রাখা হয়। সেই সুযোগে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে সুযোগসন্ধানী কালো ছত্রাক। করোনা রোগীদের মধ্যে কালো ছত্রাকের সংক্রমণের আরেকটা বড় কারণ হলো ডায়াবেটিস। ভারতে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে করোনাভাইরাস এবং কালো ছত্রাক দুটোরই সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব কোভিড-১৯ রোগী কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছে তাদের শতকরা ৯৪ ভাগ রোগীই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ৬৭ ভাগ রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কাজেই করোনাভাইরাসের সঙ্গে কালো ছত্রাকের সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলেও ভারতে এর প্রাদুর্ভাবটা আনুসাঙ্গিক, যা সেখানে কালো ছত্রাকের এপিডেমিওলজির সাথে সরাসরি জড়িত।

সৌভাগ্যক্রমে কালো ছত্রাক মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব, হাসপাতালে ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন ব্যান্ডেজ, মাস্ক , পানির লিক, অপরিষ্কার এসি বা এয়ার ফিল্ট্রেশন সিস্টেম, কনস্ট্রাকশনের প্রক্রিয়া; এসব থেকে রোগীদের মধ্যে ছড়াতে পারে। কালো ছত্রাকের সংক্রমণ নিরাময়যোগ্য। তবে যত দ্রুত রোগ শনাক্ত করা যায় তত মঙ্গল। শনাক্ত করার পরে চিকিৎসার জন্য রয়েছে বিভিন্ন রকমের অ্যান্টিফাঙ্গাল ড্রাগ। এগুলো ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে সার্জারি করে ক্ষত পরিষ্কার করে রোগীদের সুস্থ করে তোলা যায় । কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে যাদের কালো ছত্রাকের সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ রোধে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন। প্রয়োজনে আগে থেকে অ্যান্টিফাঙ্গাল ড্রাগ ব্যবহার করে সংক্রমণ রোধ করতে হবে।

বাংলাদেশে কালো ছত্রাকের সংক্রমণের হারের সঠিক কোনো তথ্য নেই। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগের হার প্রায় ভারতের সমান। ভারতের অনেক জায়গার সাথে বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রকৃতি ও আবহাওয়ার ও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাই ব্যাপক হারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা মারাত্মক হারে বেড়ে গেলে বাংলাদেশেও কালো ছত্রাক বা অন্যান্য ছত্রাক জনিত রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ, দোহা, কাতার