মাঙ্কিপক্স: পুরোনো রোগের নতুন বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব

মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। এর প্রকোপ দেখা যায় মূলত আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশে। মে মাসের শুরুতে যুক্তরাজ্যে নাইজেরিয়াফেরত এক ব্যক্তির শরীরে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস ধরা পড়ে। মে মাসের শেষ পর্যন্ত আফ্রিকার বাইরের কমপক্ষে ২০টি দেশে নিশ্চিত এবং সম্ভাব্য মিলিয়ে চার শতাধিক মাঙ্কিপক্স রোগীর খবর পাওয়া যায়। ১৯৭০ সালে মানবদেহে মাঙ্কিপক্স প্রথম শনাক্ত হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত আফ্রিকার বাইরে এটিই এ রোগের সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব।

১৯৫৮ সালে ল্যাবরেটরিতে বানরের শরীরে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়। এ জন্যই এর নাম দেওয়া হয়েছিল মাঙ্কিপক্স। কিন্তু বানর থেকে নয়, ধারণা করা হয়, ভাইরাসটি মানুষের দেহে আসে ইঁদুরজাতীয় প্রাণী বা অন্যান্য বন্য প্রাণী থেকে। প্রতিবছর মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় কয়েক হাজার ব্যক্তি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হন। আফ্রিকার বাইরেও সংক্রমণ হতো। কিন্তু তার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সেসব রোগীর প্রায় সবাই আফ্রিকাভ্রমণে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর আর এই হিসাব মিলছে না। বেশির ভাগই আফ্রিকায় না গিয়েই আক্রান্ত হয়েছেন। আফ্রিকার বাইরে মাঙ্কিপক্সের এই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটাই বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ এনে দিয়েছে।

মাঙ্কিপক্স ভাইরাস অর্থোপক্সভাইরাস গণের সদস্য। এই গণের অন্যতম সদস্য গুটিবসন্তের ভাইরাস। মাঙ্কিপক্সের দুটি স্ট্রেইন দেখা যায়—পশ্চিম আফ্রিকান স্ট্রেইন আর মধ্য আফ্রিকান বা কঙ্গো বেসিন স্ট্রেইন। মে মাসে আফ্রিকার বাইরে পাওয়া ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই ভাইরাসের পশ্চিম আফ্রিকান স্ট্রেইনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এই স্ট্রেইনে লক্ষণ যেমন মৃদু, তেমনি মৃত্যুহার ১ শতাংশের কম। অন্যদিকে মধ্য আফ্রিকান স্ট্রেইনের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে—বেশির ভাগই শিশুমৃত্যু।

অন্যান্য পক্স বা বসন্ত রোগের ভাইরাসের মতোই মাঙ্কিপক্স। এর অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে র‌্যাশ বা ফুসকুড়ি। ভাইরাস সংক্রমণের ৫ থেকে ২১ দিন পর দেখা দেয় জ্বর, মাথাব্যথা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া, মাংসপেশিতে ব্যথার মতো লক্ষণ। জ্বর শুরুর এক থেকে তিন দিনের মধ্যে প্রথমে মুখে এবং পরে সারা শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যায়। সেগুলো ধীরে ধীরে বড় হয় এবং তরলে পূর্ণ হয়ে ওঠে। এই তরলে প্রচুর ভাইরাস থাকে। মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে ফুসকুড়িগুলো প্রায় একই সঙ্গে বড় হতে থাকে।

মাঙ্কিপক্স ছড়ায় মূলত রোগীর ফুসকুড়ি থেকে। রোগীর ফুসকুড়ি ওঠা থেকে শুরু করে সেটি বড় হওয়া এবং দুই থেকে চার সপ্তাহ শেষে সেটি পুরোপুরি শুকিয়ে গিয়ে নতুন করে চামড়া ওঠার আগপর্যন্ত মাঙ্কিপক্স রোগী থেকে এই রোগ ছড়াতে পারে। এ ছাড়া রোগীর কফ ও লালা থেকেও এ রোগ ছড়ায়। রোগীর সরাসরি সংস্পর্শে আসা ছাড়াও রোগীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র, যেগুলো রোগীর ফুসকুড়ি, কফ, লালার সংস্পর্শে আসে, সেগুলো থেকেও অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত প্রাণী থেকেও কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন। আবার মানুষ থেকে অন্য প্রাণীতেও সংক্রমণ সম্ভব। তাই মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তি যত দিন রোগের লক্ষণ প্রকাশ করছেন, তাঁকে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁর ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিছানার চাদর আলাদাভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং ঘরে পোষা প্রাণী থাকলে সেগুলোকেও রোগী থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

মাঙ্কিপক্সের সব রোগীর ক্ষেত্রেই জ্বর আর ফুসকুড়ি—লক্ষণ দুটি দেখা গেলেও একই রকম লক্ষণ চিকেনপক্স (জলবসন্ত) বা হামের ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে। তাই লক্ষণ দেখা যাওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং মাঙ্কিপক্স টেস্ট করে নেওয়া জরুরি। সাধারণত টেস্টের জন্য ফুসকুড়ির ওপরের চামড়া এবং ভেতরের তরল সংগ্রহ করা হয়। মাঙ্কিপক্স সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায়। কোনো ওষুধের দরকার হয় না। চিকিৎসকের পরামর্শে রোগী জ্বর ও ব্যথার জন্য ওষুধ খেতে পারেন, এ ছাড়া প্রয়োজন পুষ্টিকর খাদ্য ও বিশ্রাম।

মাঙ্কিপক্সের একটা বিশেষ দিক হচ্ছে, লক্ষণ প্রকাশের আগে সংক্রমিত ব্যক্তি রোগ ছড়ান না। তাই লক্ষণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করলেই নতুন কাউকে সংক্রমিত হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। কারও মাঙ্কিপক্স ধরা পড়ার পর প্রথমে অনুসন্ধান করা উচিত তাঁর সংস্পর্শে কে কে এসেছেন। সেসব ব্যক্তির মাঙ্কিপক্স হয়েছে কি না, সে খোঁজ নিয়ে রোগ ছড়ানো প্রতিহত করা সম্ভব। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং নামের এই পদ্ধতিতে অনেক দেশই মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে বাংলাদেশেও এরই মধ্যে বন্দরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে টিকার ব্যবহারও নতুন নয়। গুটিবসন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত এই ভাইরাস প্রতিরোধে গুটিবসন্তের টিকাই ব্যবহার করা যায়, যার কার্যকারিতা মাঙ্কিপক্সের জন্য ৮৫ শতাংশ। মজার বিষয় হলো, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর চার দিনের মধ্যে কেউ এই টিকা গ্রহণ করলেও সেটি কার্যকর হবে। আর কোভিড-১৯-এর টিকার মতো এই টিকা একদম সবাইকে দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যাঁরা আসবেন বা এসেছেন এবং যাঁরা সব সময় রোগী বা ভাইরাস নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের টিকা দেওয়াই যথেষ্ট।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইমার্জেন্সি প্রোগ্রামের স্মলপক্স সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোজামুন্ড লুইস জানান, মাঙ্কিপক্সের বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তাঁরা করছেন না। তবে নির্মূল হওয়ার পর থেকে সারা বিশ্বে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তাই কেউ কোনো অর্থোপক্সভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষিত নেই। এ অবস্থায় মাঙ্কিপক্স আগের চেয়ে সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁদের কাছে এখনো নেই।

মাঙ্কিপক্স নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে যাওয়ার একটি কারণ, এই ভাইরাসের বিশাল জিনোম। মাঙ্কিপক্সের জিনোম সার্স-কোভ-২–এর জিনোমের ছয় গুণ। এর মানে, একে নিয়ে কাজ করাও ছয় গুণ কঠিন। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আফ্রিকায় মাঙ্কিপক্স নিয়ে গবেষণায় অর্থায়নের অভাব। নাইজেরিয়া সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের প্রধান ইফেদায়ো আদেতিফা জানান, আফ্রিকার ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরেই মাঙ্কিপক্স নিয়ে গবেষণার অর্থায়নে এবং গবেষণা প্রকাশে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন। কিন্তু এখন ভাইরাসটি আফ্রিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ায় হুট করেই বিশ্বের জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এদিকে আগ্রহ প্রকাশ করছে।

এ ভাইরাস সম্পর্কে আমাদের জানা অনেক বাকি। সিডিসির পক্স ভাইরাস টিমের প্রধান আন্দ্রেয়া ম্যাককলাম বলেন, তিনি মনে করেন, এই প্রাদুর্ভাব শেষ হলে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে গবেষণার ক্ষেত্রে কোন দিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

লেখক: শিক্ষার্থী, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ

সূত্র: নেচার ডটকম, ডব্লিউএইচও, সিডিসি