মিশ্র টিকা: কী বলছে বিজ্ঞান

কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীর বিস্তার রোধ করতে টিকার বিকল্প যে নেই, সে ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু চাইলেই অতি দ্রুত বিপুল পরিমাণ টিকা উৎপাদন করে পৃথিবীর সকলের জন্য তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আবার একইসাথে একই ধরনের বিপুল পরিমাণ টিকাও সহজলভ্য নয়। বাংলাদেশে শুরুতে কেবলমাত্র অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই আমদানি করে প্রয়োগ করা হচ্ছিল। কিন্তু প্রথম ডোজ গ্রহণকারী সকলের জন্য এখন পর্যন্ত এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করা যায়নি। বর্তমানে দেশে ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্না, প্রভৃতি অন্যান্য টিকা আনা হচ্ছে। একই পরিস্থিতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, প্রথম ডোজ এক ধরনের এবং দ্বিতীয় ডোজ অন্য ধরনের হলে সমস্যা হবে কীনা।

একই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য বিভিন্ন উপায়ে টিকা তৈরি করা হয়। মিশ্র টিকা বলতে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে দুটি ভিন্ন ধরনের টিকা প্রয়োগ করা। ধরা যাক, প্রথম ডোজ অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার এবং দ্বিতীয় ডোজ ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা দেয়া হলো। ‘হেটেরোলগাস প্রাইম–বুস্ট’ নামে পরিচিত এই কৌশলটি নতুন কিছু নয়, আগেও ইবোলার মত রোগের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রতিবারই দেখা গেছে, মিশ্র টিকা ব্যবস্থায় ক্ষতি তো নেই-ই, বরং কার্যক্ষমতা আরো বেশি হয়। একইসঙ্গে এই পদ্ধতির প্রভাবও আরো বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়। খানিকটা ভিন্ন ধরনের দুই ডোজ প্রয়োগ করার ফলে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিকারক ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে আরো গভীরভাবে চিনতে পারে বলেই এমনটা হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে প্রশ্ন এখন আরো সুনির্দিষ্ট: কোভিড-১৯ টিকার ক্ষেত্রেও কি এটা প্রযোজ্য?

গত মে মাসে স্পেনের একদল গবেষক তাদের গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছেন। প্রায় ৬০০ জনেরও বেশি মানুষের উপর পরিচালিত এ গবেষণার প্রাথমিক ট্রায়ালের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রথম ডোজে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার এবং দ্বিতীয় ডোজে ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা দেয়ার ফলে সার্স-কোভ-২ এর বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল এক ডোজের চেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত হয়। তবে একই টিকার দুই ডোজের সাথে দুটি ভিন্ন টিকার মিশ্র ডোজের সরাসরি তুলনা এখনও গবেষণাধীন। গত ১৮ই মে অনলাইনে এক প্রেজেন্টেশনে এ বিষয়ে জানানো হয়। যুক্তরাজ্যে চলমান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ‘কম-কোভ’ শীর্ষক গবেষণা দলও প্রাথমিকভাবে প্রায় একইরকম ফলাফল দেখতে পায়। যুক্তরাজ্যের ঐ গবেষণায় এও জানানো হয়, যে মিশ্র টিকা প্রয়োগের ফলে মাথাব্যথা, জ্বর, গা ব্যথা, ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছুটা বেশি হতে পারে। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা ক্ষণস্থায়ী, সেখানে গুরুতর কিছুই দেখা যায়নি। সম্প্রতি গত ২৮শে জুন তারা গবেষণার হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে ল্যান্সেট প্রি-প্রিন্ট সার্ভারে। সেখানে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকার মিশ্র প্রয়োগের সফলতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে তারা জানায়। জার্মানির অপর এক গবেষণাও অনুরূপ চিত্র তুলে ধরেছে। আগামীতে মিশ্র টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিবর্তনের ব্যাপারে আরো বিশ্লেষণমূলক ফলাফল পাওয়া যাবে। তবে গবেষকগণ এই পদ্ধতির উপযোগিতার ব্যাপারে আশাবাদী। কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট চৌ শিং বলেন, “দেখা যাচ্ছে যে এক ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাপ্রাপ্তদের অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে ফাইজারের টিকা। এটি একটি অসাধারণ খবর।” বর্তমান সময়ে এই পদ্ধতি একক কোনো টিকার উপর চাপ কমাতে পারবে, ফলে দ্রুত অধিক সংখ্যক মানুষকে টিকা দিয়ে মহামারীর বিস্তারের রাশ টেনে ধরা যাবে।

এরই মধ্যে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নেয়ার পরে দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে গ্রহণ করেন মডার্নার টিকা। সারাবিশ্বে যখন এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে, তখনই মের্কেল এ সিদ্ধান্ত নিলেন। ৬৬ বছর বয়স্ক মের্কেল প্রথম ডোজ গ্রহণ করেন এপ্রিল মাসে, আর দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেন সম্প্রতি (জুন মাসে)। উল্লেখ্য, ইউরোপের অন্যান্য কিছু দেশের মত জার্মানিতেও রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা থাকায় এ বছরের মার্চ মাসে অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ স্থগিত করা হয়েছিল। এরপরে টিকার কার্যক্রম চালু হলেও ষাটোর্ধ্বদেরকে টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছিল না। তবে বর্তমানে সকলকেই টিকা দেয়া হচ্ছে। এখন সেখানে ষাটের কম বয়স্কদের দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ভিন্ন ধরনের টিকা প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হচ্ছে।

বাহরাইন, কানাডা, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ভিন্ন টিকা প্রয়োগ শুরু করেছে বা করতে যাচ্ছে বলে রয়টার্স জানায়। বর্তমানে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ টিকার মিশ্র প্রয়োগসহ বিভিন্ন মিশ্র টিকা নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ইতালির ওষধবিষয়ক সংস্থা আইফা অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজের পরে অন্য ধরনের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার আবেদন অনুমোদন করেছে। ১৪ই জুন এক বিবৃতিতে আইফা জানায়, 'বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে আইফার বৈজ্ঞানিক কমিটি মিশ্র টিকার ব্যাপারটিকে অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।' সেখানে দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ফাইজার বা মডার্নার টিকা দেয়া হবে বলে জানানো হয়।

তবে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে এই পদ্ধতি নিয়ে আশ্বস্ত হতে প্রয়োজন আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তাই বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এখনো মিশ্র টিকার পথে হাঁটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও (এফডিএ) এ ব্যাপারে বেশ রক্ষণশীল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে মিশ্র ডোজের সম্ভাব্য অজানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র মূল টিকা (প্রথম ডোজের) না থাকার মত ‘বিশেষ অবস্থা’তেই ফাইজার বা মডার্নার দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পক্ষে এফডিএ। তবে শীঘ্রই বিশ্বব্যাপী পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল একে একে প্রকাশিত হবে। তখন আরো বেশি নিশ্চিত হওয়া যাবে, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে মিশ্র টিকার কৌশল কতটুকু কার্যকর।

লেখক: শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার নিউজ, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট অবলম্বনে