যখন বোবায় ধরে

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আপনার। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আপনার মনে হলো, বুকের ওপরটায় যেন চেপে বসে আছে কেউ। হাত-পা-দেহ নাড়াতে পারছেন না একেবারেই। বুঝলেন আপনাকে বোবায় ধরেছে। অনেকেই এই অবস্থায় ভয় পেয়ে যান। কিন্তু বোবায় ধরার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানা থাকলে ভয় পাওয়ার কিছু থাকে না। বোবায় ধরাকে ইংরেজিতে বলে স্লিপ প্যারালাইসিস বা ঘুম পক্ষাঘাত। ঘুমের এই পক্ষাঘাত সাময়িক। একটু পরেই সেরে যায়। কিছুক্ষণ পর শরীর নড়াচড়া করার ক্ষমতা ফিরে আসে। এটা আসলে ঘুমের সমস্যাও নয়; বরং আমাদের মস্তিষ্কে ‘স্বপ্ন দেখার’ প্রক্রিয়ার সামান্য একটি ত্রুটি থেকে এই ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

ঘুম পক্ষাঘাতের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রকম হতে পারে। অনেকে অনুভব করেন যে তাঁর চারপাশে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কারও মনে হয়, কিছু একটা বুকের ওপর চেপে বসে আছে। ফুসফুস ভর্তি করার জন্য বড় দম নেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু খুব সামান্যই দম নিতে পারছেন। কেউ আবার অনুভব করেন, ধীরে ধীরে নিজ দেহ থেকে বের হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুম পক্ষাঘাত কয়েক মিনিটের জন্য স্থায়ী হয়। তবে অনেকের জন্য এটা কয়েক ঘণ্টার দীর্ঘ অত্যাচার!

আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ

কেন ঘুম পক্ষাঘাত ঘটে, এটা বুঝতে হলে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে একটু উঁকি দিতে হবে। মানুষের মস্তিষ্ককে তিন তলার একটি বাড়ি হিসেবে কল্পনা করা যায়। এর নিচতলায় হেডকোয়ার্টার হিসেবে আছে ব্রেনস্টেমসহ আরও কিছু অঞ্চল। এ অঞ্চল শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃত্স্পন্দন, ঘুমসহ দেহের মৌলিক কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রেনস্টেমের সঙ্গে আছে সেরেবেলাম। সেরেবেলাম হাঁটাচলা সমন্বয় করতে সাহায্য করে। এ অঞ্চলগুলোকে সরীসৃপ মস্তিষ্ক বলেও ডাকা হয়। কারণ, কাজের দিক দিয়ে এটি গড়পড়তা গিরগিটি বা টিকটিকির মস্তিষ্কের সমতুল্য।

সরীসৃপ মস্তিষ্কের ঠিক ওপরের তলায় রয়েছে স্তন্যপায়ী মস্তিষ্ক। সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কে এই অঞ্চলগুলো দেখা যায়। এর কাজ হলো দেহের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে আসা তথ্য লেনদেন করা। এ ছাড়া স্মৃতি গঠন, আবেগ পরিচালনা, মনোরম ও বিতৃষ্ণ অভিজ্ঞতার মাঝে পার্থক্য করার জন্য এ মস্তিষ্ক দায়িত্বপ্রাপ্ত। তিনটি কাজকে একসঙ্গে লিম্বিক সিস্টেমও বলে। সাপ কিংবা কচ্ছপকে চেষ্টা করলেও পোষ মানানো যায় না। কারণ ওরা সরীসৃপ, ওদের মস্তিষ্কে লিম্বিক সিস্টেম নেই। অন্যদিকে কুকুরের প্রভুভক্তির কথা সুবিদিত। কিংবা সার্কাসের হাতি বা সিংহকে চাবুকের বিতৃষ্ণ অভিজ্ঞতার ভয় দেখিয়ে মনিব বিভিন্ন খেলা শেখান। এগুলো সম্ভব হয় লিম্বিক মস্তিষ্কের কারণেই।

আচ্ছা, দম কখন কীভাবে নিতে হবে, সেটা কি আমরা কখনো সচেতনভাবে ভাবি বা পরিবেশের তাপমাত্রা অনুযায়ী দেহের বিপাকীয় গতি ঠিক করি? না। আসলে মগজবাড়ির নিচের দুইতলা এসব স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকটা বিমানের স্বয়ংচালিত অবস্থার মতো। ফলে আমাদের মস্তিষ্কের সবচেয়ে ওপরের তলা মুক্ত হয়ে যায় স্বাধীন চিন্তা, পরিকল্পনা, ভাষা ও দর্শন-ঘ্রাণ-শব্দে পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি-বস্তু-প্রাণীকে চিনতে পারার জন্য। এই ওপরের তলাকে বলা হয় প্রাইমেট মস্তিষ্ক। মানুষের মধ্যে প্রাইমেট মস্তিষ্কের বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়েছে।

সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী ও প্রাইমেট মস্তিষ্ক বিভিন্ন রাসায়নিক নিউরোট্রান্সমিটার দিয়ে নিজেদের মধ্যে তথ্য বিনিময় করে। এই তিনতলা একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। সরীসৃপ মস্তিষ্কে ব্রেনস্টেমের মধ্যে একটি এলাকা হলো পনস। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে পনস স্তন্যপায়ী মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে প্রাইমেট মস্তিষ্কে স্বপ্ন শুরু করার সংকেত পাঠায়। একই সঙ্গে পনস মস্তিষ্কের নিচে স্পাইনালকর্ডে অন্য একটি সংকেত পাঠায়। এর ফলে ঐচ্ছিক পেশিসমূহ সাময়িকভাবে অসাড় হয়ে পড়ে। এটা মূলত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা, যাতে আমরা স্বপ্নের মধ্যে হাঁটাচলা বা অঙ্গ সঞ্চালনা না করি। তবে কখনো কখনো এই ব্যবস্থার সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে যায়।

আমরা চিত হয়ে বা পিঠের ওপর ভর দিয়ে ঘুমালে কখনো কখনো কণ্ঠনালি দিয়ে ঠিকমতো বাতাস যেতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই তখন ফুসফুসে অক্সিজেন কমে যায়। স্বপ্নহীন গভীর ঘুমে এটা কোনো সমস্যা নয়। মস্তিষ্কের যে গহিন অঞ্চল অক্সিজেন তত্ত্বাবধান করে, তা শরীরকে গভীর ঘুম থেকে আধো জাগরণ অবস্থায় একটু তুলে দেয়। তখন হয় আমরা নাক ডাকি বা মাথা ঘোরাই বা পাশ ফিরে শুই। কিন্তু স্বপ্ন দেখা ঘুমে বিষয়টা একটু জটিল। তখন মস্তিষ্ক পনসকে নির্দেশনা দেয় পেশি অসাড় করার প্রক্রিয়া থামিয়ে দিতে। কখনো কখনো পনস এ নির্দেশে সাড়া দেয় না। এমন অবস্থায় মস্তিষ্ক ঘুম থেকে দেহকে আরও একটু জাগিয়ে দেয়।

কিন্তু মস্তিষ্ক অসাড়ই থাকে, আর শ্বাসপ্রবাহের সমস্যা রয়ে যায়। ঘটনা আরও সংকটপূর্ণ হওয়া শুরু করে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মস্তিষ্ক একেবারেই পূর্ণ জাগ্রত হয়ে যায়। মন তখন বুঝতে পারে কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে নিশ্বাসের সমস্যা তখন ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। দম নিতে পারছি না, আবার দেহও নাড়াতে পারছি না, এ রকম একটা অনুভূতি আসে। তখন স্তন্যপায়ী মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা সক্রিয় হয়ে ভয়ের অনুভূতি উদ্রেক করে। ফলাফল, মস্তিষ্কে ‘পালাও বা যুদ্ধ করো’ পরিস্থিতির উদ্ভব! তাতে অবশ্য কোনো লাভ হয় না, কারণ দেহ নড়াচড়া করা যাচ্ছে না। শুরু হয় আতঙ্ক। এ অবস্থাকে সাধারণ মানুষ ‘বোবায় ধরা’ নাম দিয়েছে।

অনেকের ক্ষেত্রে বিশ্রী পরিস্থিতিটা নাটকীয় দিকে মোড় নেয়। অনেকে পূর্ণ জাগ্রত না হতেই এই অবস্থায় প্রবেশ করেন। তাঁরা কখনোই স্বপ্ন থেকে বের হতে পারেন না। তাঁরা একদিকে অর্ধজাগ্রতভাবে চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সজাগ, অন্যদিকে দেহ নাড়াতে পারছেন না, আবার স্বপ্নের মধ্যে অর্থহীন দৃশ্যপট ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মানব মস্তিষ্ক বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক টানতে বেশ পারদর্শী, বিশেষ করে ঘটনাগুলো যদি সন্দেহজনক হয়। তাই তাঁরা স্বপ্নের বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে ঘুম পক্ষাঘাতের হ্যালুসিনেশনের সম্পর্ক টানেন। এ পরিস্থিতিতে মানুষ নিজ নিজ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে ব্যাখ্যা দেন। কেউ দাবি করেন, এলিয়েনরা এসেছিল, কেউ বলেন শয়তান ভর করেছিল, আর কেউ বা বলেন ভূতে ধরেছিল! অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির অর্ধজাগ্রত অবস্থা, স্বপ্ন আর ঘুম পক্ষাঘাত এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় যে তাঁরা আসলেই এসব অশরীরী অনুভূতি পান, দেখেন, শোনেন!

যাঁদের ঘুম পক্ষাঘাত ঘন ঘন হয়, তাঁদের পাশ ফিরে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। তবু যদি ‘বোবায় ধরে’, তখন ভয়ের কিছু নেই। কারণ এই নাটকীয় পক্ষাঘাত সাময়িক। আসলে আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, তা একটা আশ্চর্য বিষয়। ঘুম পক্ষাঘাতের পেছনেও স্নায়ুবিজ্ঞানের চিত্তাকর্ষক একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। সেই ব্যাখ্যা আমাদের মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়ার প্রতি আগ্রহ কেবল বাড়িয়েই তোলে।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, রিভারসাইড ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া