শিশুর ড্রাকুলার দাঁত

আয়ারল্যান্ডের লেখক ব্রাম স্টোকার ড্রাকুলা নামের এক রক্তচোষা মানবের রোমহর্ষ কল্পকাহিনি লিখেছিলেন ড্রাকুলা বইয়ে। সে প্রায় ১০০ বছর আগে। ব্রাম স্টোকারের জন্মস্থান সেই আয়ারল্যান্ডেই এক শিশুর মুখে দেখতে ঠিক রক্তচোষা ড্রাকুলার মতোই দাঁত গজিয়েছিল।

বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি লাউথে জন্ম নেয় শিশুটি, নাম অস্কার। অস্কারের বয়স যখন ১১ মাস, তার মুখে গজায় রক্তচোষা ড্রাকুলার মতো একটি দাঁত। এক রাতের মধ্যেই গজিয়ে উঠেছিল এটি। শিশুটির মা মিসেস টারা বার্নি দুধ খাওয়াতে গিয়ে শিশু অস্কারের মুখে সুচালো এ দাঁতের উপস্থিতি টের পান। এ ঘটনায় হতবাক হয়ে যান তিনি। শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় আউয়ার লেডি অব লোর্ডস হাসপাতালে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও অবাক। তাঁরা জানান, শিশুর এ দাঁত অস্বাভাবিক আকৃতির, উঠেছেও স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগে। তবে শিশুর মুখে গজিয়ে ওঠা এটি কি সত্যিই দাঁত, নাকি অন্য কিছু, এ নিয়ে কোনো কোনো চিকিৎসকের মধ্যে দেখা দেয় সংশয়। শেষে, ডাবলিনের টেম্পল স্ট্রিট শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ দন্তচিকিৎসককে ডাকা হয়। শিশুর মুখে এ দাঁত যেহেতু গজিয়েছে ১১ মাস বয়সে, নিঃসন্দেহে এটি দুধ-দাঁত, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দাঁতটি তুলে ফেলার। খবরটা সে সময় বেরিয়েছিল ডেইলি মিরর পত্রিকায়।

মানুষের মুখে রক্তচোষা ড্রাকুলার মতো দাঁত গজানো নতুন ঘটনা নয়। প্রায় নব্বই বছর আগে জার্মান দন্তচিকিৎসক জোসেফ ক্রাইস্ট রক্তচোষার মতো এ দাঁত এবং এর পেছনে জড়িত কারণটি প্রথম শনাক্ত করেন। যে রোগের কারণে মানুষের মুখে এমন দাঁত গজায়, তার নাম হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া।

এরপর ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে জার্মান চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হার্মান সিমেন্স এ রোগের চরিত্র নিয়ে পরিষ্কার ধারণা দেন। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে ফরাসি চর্মরোগবিশেষজ্ঞ আলবার্ট তোরেন এ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে উদ্‌ঘাটন করেন আরও কিছু তথ্য। এ তিনজন চিকিৎসকের নামানুসারে এ রোগটিকে ক্রাইস্ট-সিমেন্স-তোরেন সিন্ড্রোম নামেও ডাকা হয়। এ রোগের আরেকটি নাম অ্যানহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া।

হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া রোগে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ গঠনের সময় ত্বক, চুল, নখ, দাঁত এবং ঘামগ্রন্থি স্বাভাবিকভাবে গঠিত হয় না। ফলে জন্মের পর শিশুর মুখে সব কটি দাঁত গজায় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুখে স্থায়ী দাঁতের অনুপস্থিতি দেখা দেয়। দাঁত যেগুলো গজায়, সেগুলোও আকারে হয় ছোট, হয়ে পড়ে সুচালো, দেখতে ড্রাকুলার রক্তচোষা দাঁতের মতো।

শুধু রক্তচোষা দাঁতই নয়, এ রোগে আক্রান্তদের মাথায় চুলের সংখ্যা কম থাকে, শরীরেও থাকে লোমের স্বল্পতা, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় হাইপোট্রাইকোসিস। শরীরে চুল গজায় ধীরগতিতে, চুল হয়ে পড়ে ভঙ্গুর।

আক্রান্তদের শরীরে ঘামগ্রন্থির সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে কিংবা ওগুলো যথাযথভাবে কাজ করে না। ফলে শরীরে ঘাম নিঃসরণ কমে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় হাইপোহাইড্রোসিস ঘটে এদের। জ্বরে আক্রান্ত হলে কিংবা অনেকক্ষণ তপ্ত আবহাওয়ায় অবস্থান করলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তখন ঘাম নিঃসরণের মাধ্যমে উঁচু তাপমাত্রা স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালায় শরীর। হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়ায় এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া রোগের আরও কিছু লক্ষণ আছে। আক্রান্তদের মুখাবয়ব স্বাভাবিকের চেয়ে আলাদা হয়। কপালের আকৃতি হয় উন্নত, ঠোঁট হয় পুরুষ্ট, দুই চোখের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত নাকের সেতু বা নেজল ব্রিজ হয় চ্যাপ্টা। চোখের চারপাশের ত্বক হয় পাতলা ও ভাঁজযুক্ত, চোখের চারপাশে কালি পড়ে। ত্বকে একজিমা এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি চর্মরোগ দেখা দেয়, নাক থেকে নির্গত হয় দুর্গন্ধময় পদার্থ। তবে হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া রোগটি খুব বিরল। ১৭ হাজারে মাত্র ১ জন এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

রোমহর্ষ চলচ্চিত্রের জন্য খ্যাত আমেরিকান অভিনেতা মাইকেল জন বেরিম্যান হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। তাঁরও গজিয়েছিল ড্রাকুলার মতো রক্তচোষা দাঁত। হয়তো সে কারণেই রোমহর্ষ চলচ্চিত্রে অভিনয় তাঁকে সাফল্য এনে দেয়। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে আমেরিকার স্যাটার্ন অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি।

কীভাবে তৈরি হয় হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া রোগটি? আসলে এটি একটি জন্মগত রোগ। গর্ভে ভ্রূণ গঠনের ত্রুটির ফলে এ রোগের সৃষ্টি। ভ্রূণ সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠনের ভিত্তি হিসেবে ভ্রূণে তিন ধরনের টিস্যু বা কলার স্তর কাজ করে, যা জার্ম স্তর নামে পরিচিত। জার্ম স্তরগুলো হলো এক্টোডার্ম, মেসোডার্ম ও এন্ডোডার্ম।

প্রাথমিক ভ্রূণের জার্ম স্তরের সবচেয়ে বাইরের স্তরের নাম এক্টোডার্ম। এটা শরীরের স্নায়ুতন্ত্র, দাঁত, মুখগহ্বরের আবরণী, ত্বক, চুল, নখ, ঘামগ্রন্থি ইত্যাদির উদ্ভব ঘটায়। এক্টোডার্ম থেকে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিকভাবে উদ্ভব হওয়ার জন্য এক্টোডার্ম ও মেসোডার্মের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অত্যাবশ্যক। এক্টোডার্ম ও মেসোডার্ম স্তরের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আংশিক সিগন্যালিং পাথওয়ে গঠনে কাজ করে কিছু প্রোটিন উপাদান। গর্ভাবস্থায় যখন ভ্রূণের বৃদ্ধি ঘটতে থাকে, তখন EDA, EDAR, EDARADD এবং WNT10A নামের কতগুলো জিন অর্থাৎ বংশানুগতি নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান এ প্রোটিনগুলো গঠনের জন্য নির্দেশনা পাঠায়। দুর্ভাগ্যবশত, যদি এ জিনগুলোর কোনো একটির মধ্যে মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটতে শুরু করে, তখন এক্টোডার্ম ও মেসোডার্মের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে দেখা দেয় হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া। তখন ভ্রূণে ত্বক, চুল, নখ, দাঁত ও ঘামগ্রন্থির স্বাভাবিক গঠন বিঘ্নিত হয়।

মুখে ড্রাকুলার মতো রক্তচোষা দাঁত গজানোর জন্য দায়ী WNT10A জিনের মিউটেশন। WNT10A জিনের মিউটেশনে হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া হলে প্রাপ্তবয়স্কদের মুখে সবগুলো স্থায়ী দাঁতের অনুপস্থিতি দেখা যায়।

অন্যদিকে, বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া ঘটে EDA জিনের মিউটেশনের কারণে এক্স-লিঙ্কড রিসেসিভ রীতিতে। EDA জিনের মিউটেশনের ফলে এ রোগ সৃষ্টি হলে তাকে এক্স-লিঙ্কড হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া (XLHED) বলা হয়। যদিও EDAR এবং EDARADD জিনের মিউটেশনের কারণেও সৃষ্টি হতে পারে হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া, তবে তা সচরাচর কম দেখা যায়।

হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়ার ফলে যদি ড্রাকুলার মতো দাঁত গজায়, কীভাবে হবে তার নিরাময়? এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে দরকার হয় দাঁতের সৌন্দর্যবর্ধক বা কসমেটিক চিকিৎসা। মুখে দাঁত না গজালে অনেক শিশু-কিশোরকেই কৃত্রিম দাঁত পরিধান করতে হয়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু শিশু-কিশোরদের চোয়ালের আকৃতি পরিবর্তিত হয়, ফলে কৃত্রিম দাঁতও নতুন করে বানাতে হয় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। কারও কারও ক্ষেত্রে দাঁত সামঞ্জস্যকরণের জন্য ব্রেইস পরাতে হয়। বর্তমানে দাঁতের ইমপ্ল্যান্ট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মুখে গজানো রক্তচোষার মতো দাঁত তুলে ফেলে এবং দাঁত না গজানো চোয়ালে ইমপ্ল্যান্ট করে দাঁত বসিয়ে নিচ্ছে অনেকেই। তবে দাঁতের ইমপ্ল্যান্ট করাতে হলে চোয়াল পুরোপুরিভাবে গঠিত হতে হয়, ফলে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় রোগীকে।

এদিকে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন অন্য কথা। তাঁরা হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া প্রতিরোধের কথা ভাবছেন। এ জন্য তাঁরা গবেষণা চালাচ্ছেন রীতিমতো। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকার এডিমার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এক্স-লিঙ্কড হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়া প্রতিরোধের জন্য ইডিআই২০০ নামে ওষুধের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা শুরু করে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এক্স-লিঙ্কড হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিসপ্লাসিয়ায় আক্রান্ত ১০ জন নবজাতকের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। এতে নবজাতকদের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি হলেও এদের ঘামগ্রন্থি ও অন্যান্য জীববিজ্ঞানভিত্তিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। এডিমার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সূত্র ধরে একজন জার্মান চিকিৎসক হম স্নাইডার বিশেষ পদ্ধতিতে গর্ভস্থ ভ্রূণের ওপর ইডিআই২০০ ওষুধের পরীক্ষা চালান। এ পরীক্ষায় তিনি দাঁত ও ঘামগ্রন্থি গঠনে ভালো ফলাফল অর্জন করেন। ওষুধটি নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। পরীক্ষায় সফল হলে পৃথিবীতে আর কোনো ড্রাকুলা দাঁতের শিশুর জন্ম হবে না বলে আমরা আশা করছি।

লেখক: ডেন্টাল স্পেশালিস্ট, তায়েফ ডেন্টাল হাসপাতাল, সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়