সাপ নিয়ে যত সংস্কার-কুসংস্কার

আজ ১৬ জুলাই বিশ্ব সাপ দিবস। সাপ নিয়ে আমাদের দেশে নানারকম কুসংস্কার প্রচলিত আছে। যেমন, সাপের মাথায় মনি থাকে, সাপ গুপধন পাহারা দেয়, গরুর দুধ খায়, সাপুড়ের বাঁশির সুর শোনে কিংবা সাপ প্রতিশোধপরায়ণ। বিশ্ব সাপ দিবসে জেনে নিন, এর কতটা আসলেই সত্যি?

সাপ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতিপরিচিত একটি প্রাণীর নাম। অথচ তা আমাদের জন্য মোটেও সুখের নয়; বরং ‘সাপ’ শব্দটি শোনার সঙ্গে আমাদের মনে ভয়ের এক আবহ তৈরি হয়। সাপকে আমরা ভয়ের কিংবা বিশ্বাসঘাতক চরিত্রের এক প্রাণী হিসেবে জেনে এসেছি। আমরা যারা শহরে নয়, গ্রামে বড় হয়েছি, সাপকে চাক্ষুষ দেখার আগে এদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে দাদি-নানির কোলে। তাঁদের গল্প-কিসসায় আমরা জেনে থাকি, সাপ একবার এদের বিষদাঁত মানুষ ও বিশাল কোনো জীবজন্তুর দেহে বসিয়ে দিতে পারলে তাদের মৃত্যু অনিবার্য। সেই ভয়-আতঙ্ক থেকেই আদিকাল থেকে সাপ নিয়ে জন্ম নিয়েছে নানা উপকথা, লোককাহিনি, উপাখ্যান ও কিংবদন্তির। সর্বোপরি ভারতবর্ষে ‘সর্পপূজা’র যে প্রচলন হয়েছিল, তা আজও অজগ্রামে প্রচলিত আছে।

সাপ আকার-আকৃতিতে তেমন বড় নয়। কেবল অজগর গ্রুপের দু-চারটা প্রজাতি ছাড়া বাকি সব সরু দৈর্ঘ্যে ৬-৭ ইঞ্চি থেকে নিয়ে ৮-১০ ফুটের বেশি লম্বা নয়। শনাক্ত গণনায় পৃথিবীতে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। আর বাংলাদেশে মোট ৭৮টি প্রজাতির সাপ দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৫২টি অবিষধর ও ২৬টি বিষধর সাপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ৪টি প্রজাতি যেমন গোখরা, কালকেউটে, সানকিনী ও চন্দ্রবোড়া আমাদের জন্য যথেষ্ট ভয়ের কারণ। বাকি সাপগুলোর মধ্যে ঢোঁড়া, পাইন্না, মেটে ইত্যাদি সাপ একেবারেই নিরীহ। কিন্তু সমস্যা হলো, অন্ধকারে যেকোনো সাপ তা বিষধর-অবিষধর যা-ই হোক না, একবার কামড়ালে আমরা সাধারণত ধরে নিই আর রক্ষে নেই। অথচ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কয়েকটি কামড়ে আমরা মারা যেতে পারি।

সাপের বিষ যখন অন্য দেহে প্রবেশ করে, তখন তা দুভাবে বিষক্রিয়ার সূত্রপাত করে। একটি কার্ডিও টক্সিন, যা হৃদ্যন্ত্র-রক্তসংবহনতন্ত্র ও অন্যটি স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে। আবার মুম্বাইয়ের ইফকিন্স ইনস্টিটিউটে এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতের যত লোক সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় বা মারা যায়, তাদের শতকরা ৮০ শতাংশই ঘটে অবিষধর সাপের কামড়ে। এসব মৃত্যুর মূল কারণ বিষক্রিয়া নয়, বরং ভয়ভীতি, আশঙ্কা থেকে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

এ ধরনের ভয়ভীতি, আশঙ্কা থেকে আমাদের মতো বিজ্ঞানে অনগ্রসর সমাজে সাপ নিয়ে বিরাজমান রয়েছে অনেক সংস্কার-কুসংস্কার, যত সব অপবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। এসবকে আরও উসকে দেয় আমাদের হাটবাজারে সাপুড়ে বা বেদেদের নানা ধরনের ছলচাতুরী ও ব্যবসায়িক অপপ্রচারণা।

এখানে এসব কিছু কল্পকাহিনির অবতারণা ও এগুলোর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের সূত্র ধরে সত্য সন্ধানের চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন, ক. সাপ প্রতিশোধপরায়ণ খ. সাপ গরুর দুধ খায় গ. সাপের মাথার মণি ঘ. সাপের গুপ্তধন পাহারা ঙ. সাপুড়ের বিচিত্র বাঁশি ইত্যাদি।

সাপ প্রতিশোধপরায়ণ!

আমরা অনেক সময় শুনে থাকি যে সাপের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা প্রবল। রাতবিরাতে চলতে-ফিরতে যদি কেউ সাপের গায়ে পাড়া দিয়ে এটাকে ব্যথা দেয়, তখন এগুলো তা মনে রাখে ও পরে সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে সাপের মগজের আকৃতিগত ও বিবর্তনভিত্তিক যে অবস্থান, বাস্তবে তা সম্ভব নয়। সুতরাং সাপ প্রতিহিংসা জিইয়ে রেখে প্রতিশোধ নিতে পারে, তা ঠিক নয়। এমন আচরণ কেবল উন্নততর মেরুদণ্ডী প্রাণীর বেলায় দেখা যায়।

সাপ গরুর দুধ খায়!

গ্রাম্যজীবনে এমন ঘটনা প্রায়ই শোনা যায় যে রাতবিরাতে কোনো একটা বিশেষ সাপ নিয়মিত সদ্য বাচ্চা দেওয়া গাভির দুধ খেয়ে যায়। অথচ ছোট বাছুরটি বা গৃহস্থ দুধ পায় না। এই অবস্থাটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে গৃহস্থ হয়তো একদিন দেখতে পেলেন, গাভির পায়ে সাপ পেঁচিয়ে আছে। এই অবস্থার সহজ-সঠিক কথা হলো, সাপ রাতের বেলায় ইঁদুর বা ব্যাঙ ধরতে এসে গরুর পায়ে পিষ্ট হওয়ার ভয়ে এমনটা করে। এখানে সাপের দুধ চুরির কাহিনি মানুষের কল্পনাপ্রসূত। গরুর দুধ সংগ্রহের যে সাধারণ কলাকৌশল, তা সাপ আয়ত্তে আনতে পারবে না। কেননা, মাটি খোঁড়কজাতীয় সাপ ছাড়া সাপের দাঁতের গঠন বেশ সুঁচালো এবং মুখের ভেতরের দিকে বড়শির মতো বাঁকানো। সুতরাং সাপ যদি গরুর দুধ খেতে যায়, তখন সেই দাঁত গরুর ওলানে চুষতে আটকে যাবে এবং বিষ নির্গত হবে, যাতে গাভির মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। সাপ গরুর দুধ খায়, এমন অবস্থা বাস্তবে কেউ স্বচক্ষে দেখেছে, তেমন প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। এখানে বলা যায়, এই পুরো ব্যাপারটা কল্পনাপ্রসূত।

সাপের মাথার মণি!

গ্রামীণ জীবনে এমনই একটা কথা প্রচলিত আছে যে কেউ কেউ মেঘলা অন্ধকার রাতে সাপের মাথায় মণি বা মুখে লাল আলোর আভা দেখেছে। সাপুড়ে-বেদেরা সাধারণত এ ধরনের মুখরোচক গালগল্পের অবতারণা করে ভয় দেখিয়ে পয়সা তোলে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দাবি করে যে তারা রাজসাপের মাথার মণি (যা সাত রাজার ধনের সমান) সংগ্রহ করেছে।

তবে আসল কথা হলো, বিষধর সাপের মাথার ওপরে একটি ছিদ্র থাকে। মুখবন্ধ অবস্থায় সেই ছিদ্র দিয়ে সাপ জিব বের করে এর চারপাশের পরিবেশ থেকে খাদ্যের কিংবা সাবধান হওয়ার সংকেত সংগ্রহ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে সাপুড়েরা সাধারণত তাদের বাক্সবন্দী সাপগুলোর মাথার উপরকার ছিদ্রে রংবেরঙের পাথর বসিয়ে রাখে, যা সূর্যকিরণে বা চাঁদের আলোয় ঝলমল করে। আর সেই আলোর বিচ্ছুরণকে তারা সাপের মাথার মণি বলে চালিয়ে দেয়।

সাপ সাপুড়ের বাঁশির সুর শোনে!

সাপুড়ের বাঁশির অদ্ভুত আকৃতি ও এর বিচিত্র সুরের সম্মোহনী শক্তির নানা কাহিনি শোনা যায়। সাপুড়ে-বেদেরাই তাদের পয়সা সংগ্রহের কৌশল হিসেবে এমন ধারার কল্পকাহিনি বানিয়ে থাকে। তারা বলে, ওই বাঁশির সুর শুনে সাপ নিজের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে সাপুড়ের হাতে ধরা দেয়। তখন তারা এদের বশে নিয়ে আসে। বাস্তবে আমরা জানি যে সাপের কান নেই এবং সুরশব্দ শোনার প্রশ্নই ওঠে না। শব্দ বা বিপত্সংকেত শোনার জন্য সাপের চোয়ালের নিচে হাড়ে শ্রবণস্পন্দন গ্রহণের স্নায়ুতন্ত্রে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সাপুড়ের বাঁশির বিচিত্র সুরের ওঠানামার সঙ্গে গোখরা সাপ যে ফণা তোলে, তা আমরা পথেঘাটে অনেক সময় দেখেছি। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, বাঁশির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আকৃতি ও সাপুড়ের ছন্দময় অঙ্গভঙ্গি ও তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত নাড়া সাপকে খেপিয়ে তোলে। এর সঙ্গে সাপুড়ের বাঁশির সুরের কোনো সম্পর্ক নেই।

সাপের গুপ্তধন পাহারা!

শুধু জনশ্রুতি নয়, অনেক জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাসেও পাওয়া যায় যে সাপ লুকানো রৌপ্য, মণিমুক্তা পাহারা দেয়। এ রকম ধারণার মূলে রয়েছে অতীতের কিছু ঘটনাক্রম। অতীতকালে অনেকে পারিবারিক সম্পদ স্বর্ণ-রৌপ্য ও মুদ্রাভর্তি হাঁড়ি বা কলসি মাটির নিচে গর্ত করে লুকিয়ে রাখত। এদিকে সাপ নিজে গর্ত খোঁড়ে না, অপরের খোঁড়া গর্তে বসবাস করে। সাপ স্বর্ণ, রৌপ্যমুদ্রা বা ধনরত্ন চেনে, এমন ধারণা একেবারে ভ্রান্ত। সাধারণত গৃহস্থের ধনদৌলত লুকিয়ে রাখার স্থানটি হয় খুব সুরক্ষিত। অন্যদিকে ওই গর্তে সাপের প্রিয় খাবার ইঁদুর-ব্যাঙও সেসব জায়গায় যাতায়াত করে। সুতরাং সুরক্ষিত ও খাদ্যের প্রলোভনের কারণেই সাপ সেসব গর্তকে নিজেদের লুকিয়ে বসবাস করার স্থান হিসেবে বেছে নেয়। গৃহস্থের লুকিয়ে রাখা ধনরত্ন পাহারা দেওয়ার জন্য নয়।

এমনই ধারার অসংখ্য মুখরোচক গল্প, কল্পকাহিনি ছড়িয়ে আছে। যেমন সাপের বিষ নামানো, সাপের পা দেখা, সাপে-নেউলে সম্পর্ক, সাপের বিষ হজম করা ইত্যাদি। এগুলো আমরা অযৌক্তিক কুসংস্কার বলে আখ্যায়িত করতে পারি, যা থেকে জন্ম নেয় আমাদের মতো বিজ্ঞানে অনগ্রসর জাতীয় জীবনে অপবিজ্ঞান।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়