চারপাশে তিন-চারতলা বাড়ি, মাঝখানে দেড় কাঠার একটা প্লটে লাউ–কুমড়ো ও শিমের মাচা, এক কোণে বয়সী একটা মেহেদিগাছ। দেড় কাঠাজুড়েই ছোট ছোট আগাছার বাড়বাড়ন্ত। চারপাশের বাড়িগুলোর ছাদে চমত্কার সব ছাদবাগান।
মাঘের শেষভাগে একজোড়া ছোট পাখি এসে মেহেদির সরু ডাল–পাতায় ঝুলে–দুলে বাসা বানানোর জুতসই জায়গা বাছাই করে। পুরুষ পাখিটা দেখতে সুন্দর না! আর মিষ্টি ধাতব সুরেলা ও জোরালো গলা ওটার! এ ডাল-ও ডাল করতে করতে ওটা ঝিরঝির করে ডানা কাঁপিয়ে গান গেয়ে চলেছে। বউটি কিন্তু নীরব। সে সরু ডাল বাছাই করছে পরখ করতে করতে। বোকা পুরুষটা একটা ডালে ঝুলে হয়তো খুশিতে গান গেয়ে স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে—বলছে, ‘পেয়েছি! পেয়েছি! জুতসই ডাল। পেয়ে গেছি। দেখো এসে।’
কিন্তু স্ত্রীটি স্বামীর দিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। সে জানে, স্বামী তার এ ক্ষেত্রে একেবারেই আনাড়ি। তবু পুরুষ পাখিটি এ ডাল-ও ডালে ঝুলছে-দুলছে। অতি চঞ্চলতায় মাঝেমধ্যে মেহেদির আড়ালে বসে জোরালো গলায় গান গাইছে। নিরিবিলি এলাকা বা গ্রামবাংলা হলে এই ডাক শোনা যাবে দেড় শ-দুই শ গজ দূর থেকে। পুরো ঢাকা শহরে এই পাখিরা আছে, এমন কোনো পাড়া-মহল্লা-পার্ক-উদ্যান নেই, যেখানে এরা নেই। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাতেও এদের ডাক শোনা যায়। পুরুষটির শরীরে এখন মাঘের মিষ্টি রোদ পড়েছে। চকচকে বেগুনি–নীল রংটা এখন তাই ঝলকাচ্ছে। পুরো শরীরটা একই রঙের। তবে লেজ ও পাখার উপরিভাগে কালোর আধিক্য বেশি। লেজের দৈর্ঘ্য ০৩.০৩ সেমি। সদাসতর্ক চোখ। সুচালো ঠোঁটের অগ্রভাগটা নিম্নমুখী, রং কালো। ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ২ সেমি। পা-ও কালো। আমুদে, খেলুড়ে ও ফুর্তিবাজ এমন পাখি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। পুরুষটি পছন্দ করে উঁচু জায়গা। ঢাকা শহরে যেমন ছাদবাগানের ফুল-ফল গাছের শীর্ষদেশে বা কোনো উঁচু গাছের মগডালে—মনের সুখে গান গাইবে ওখানেই বসে। ধাতব গলাটাকে ওরা বিশ্রাম দিতে চায় না।
স্ত্রীটি পুরুষের কাছে একেবারেই ম্লান চেহারার। একনজরে জলপাই বাদামি পাখি। এটারও ঠোঁট-পা কালো। মুখোশ গাঢ় বাদামি। পুরুষটির বেগুনি–নীল রং ফোটে প্রেমের মৌসুমে, প্রজনন মৌসুম চলে গেলে দেখতে প্রায় স্ত্রীটির মতোই দেখায়। এ কথা খাটে সদ্য উড়তে শেখা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছানাদের ক্ষেত্রেও।
স্ত্রী পছন্দসই ডাল পেয়ে ডাকে স্বামীকে। অমনি মেহেদির ডগা থেকে মহা আনন্দসংগীত গেয়ে উঠেই পুরুষটি দর্শনীয়-নান্দনিক ভঙ্গিতে নিচের দিকে নেমেই বসল স্ত্রীটির পাশে। দুজনে মৃদুস্বরে কথা হলো—অর্থাৎ, পছন্দের ডাল পাওয়া গেছে। পাখা ঝাঁকিয়ে সে কী ফুর্তি এবার পুরুষটির! স্ত্রীটি উড়াল দিয়ে দালানকোঠার ফাঁক দিয়ে চলে যায় দূরে। পুরুষটি চারতলা বাড়িটির ছাদবাগানের পেয়ারাগাছের শীর্ষদেশে বসে আনন্দসংগীত গেয়ে চলে।
পরবর্তী ছয় দিনে স্ত্রী একাই টুকরো টুকরো পলিথিন, সরু ঘাস, লতা ও কাগজের টুকরো, মাকড়সার জাল, ডিমের খোলস, শুকনো পাতা-ঝুল-চুল দিয়ে চমত্কার একটি লম্বাটে থলের মতো বাসা বানিয়ে ফেলে। প্রবেশপথের মুখে আবার শেড আছে।
বাসাটি লম্বায় হবে ১৯ থেকে ২৩ সেমি। প্রস্থ ১৫ থেকে ১৮ সেমি। বাসার বাইরে আবার মাকড়সার জাল ও অন্যান্য উপকরণের শক্ত বন্ধনী। ঝড়-বাতাসে যাতে সহজে ছিঁড়ে যেতে না পারে। আর বসন্তের বাতাসে সরু ডালসহ বাসাটা যখন দোল খায়, তখন বাসায় ডিমে তা দিতে বসা স্ত্রীটি আহারে শান্তির সুখদোলা খায়! বাসা বানানো থেকে শুরু করে ডিম পাড়া ও তা দেওয়া—সবই স্ত্রীটি একাই করে। ছানা হওয়ার পর ক্বচিৎ পুরুষটি ছানাদের খাওয়ায়। ডিম পাড়ে দুটি। ডিম ফুটে ছানা হয় ১২ থেকে ১৫ দিনে। বাসা বানানোর মৌসুম এদের মাঘের শেষভাগ থেকে বৈশাখের শুরু পর্যন্ত। এরা বাড়িঘরের গাছপালাতেই বাসা বানায়। ঢাকা শহরের ফুলের বাগান, বহুল অভিজাত এলাকার ফুলের বাগান যেমন এদের চমত্কার ‘খাদ্যভূমি’, তেমনি বাগানবিলাসসহ অন্যান্য লতানো গাছ এদের বাসা বানানোর আদর্শ স্থান। আপনার বাড়ির প্রবেশপথের কাছে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায়ও এদের বাসা দেখা যাবে। বাসা করে ৩ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার ভেতরে।
মূল খাদ্য এদের বিভিন্ন ফুলের মধু, ছোট ছোট পোকা, ফুলের ভেতরের সূক্ষ্ম রেণু, তাল-খেজুরের রস ইত্যাদি। শিমুল-পলাশ ফুলের প্রতি এদের আসক্তি বেশি। আর জবাসহ অন্যান্য ফুলের সামনে যখন এরা হোভারিং করে, তখন এক নান্দনিক দৃশ্যের জন্ম হয়। লম্বা ঠোঁটটি ফুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে মধু পান করে, তখন দেখলে মুগ্ধ হতেই হবে।
পাখিটির নাম নীল টুনি ও দুর্গা টুনি। সারা বাংলাদেশে দেখা মেলে। ইংরেজি নাম পারপল সানবার্ড। বৈজ্ঞানিক নাম cinnyris asiaticus। দৈর্ঘ্য ১০ সেমি। ওজন ০৭.০৭ গ্রাম।
এদেরই এক জাতভাইয়ের নাম মৌটুসি বা ফুল টুনি। আকার, গড়ন, ধরন, স্বভাব, ঠোঁটসহ খাদ্যতালিকা, বাসার ধরন-গড়ন একই রকম। ঢাকা শহরে প্রচুর আছে। পার্ক-উদ্যানে বাসাও করে। এদের পুরুষটিও সুগায়ক। দৈর্ঘ্য ওই ১০ সেমিই। ওজন ০৯ গ্রাম। এদেরও ডিম হয় দুটি। ডিম ফোটে ১১ থেকে ১৩ দিনে। মৌটুসির ইংরেজি নাম পারপল রাম্পড সানবার্ড। বৈজ্ঞানিক নাম leptocoma zeylonica। এরাও নীল টুনিদের মতো চমত্কার হোভারিং করে ফুলের মধু পান করে।
লেখক: পাখিবিশারদ