স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অপুষ্টি নিরসনে পুষ্টিকর ধান

বাংলাদেশে ক্ষুধা নিয়ে আপাতত কোন দুশ্চিন্তা নেই, কিন্তু চিন্তা এখন অদৃশ্য ক্ষুধা বা অপুষ্টিকে ঘিরে। ক্ষুধা নিবারণে আমাদের দেশের কৃষকরা প্রতিবছর প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন করছেন। অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে এটা আমাদের বিশাল সাফল্য। কিন্তু খাদ্য হিসেবে আমাদের শুধু কার্বহাইড্রেট বা শর্করা খেলে তো হবে না। আমাদের প্রয়োজন সুষম খাদ্য। সুষম খাদ্য বলতে আমরা বুঝি শর্করা, আমিষ, স্নেহ, খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি সবকিছুর সন্মিলন। সুস্থ্ ও নিরোগ থাকার জন্য আমাদের নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করা দরকার। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আর্থিক অস্বচ্ছলতা বা সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার যেমন, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, কলা, আঙুর, আপেল ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে পারে না বা পরিমাণে কম গ্রহণ করছেন। এ অবস্থায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। আগামী ২০৪১ সালে বিশ্বে উন্নত দেশে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন- জিংক, আয়রন, প্রোটিন, খনিজসহ শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কাজ করছে। পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএম প্রযুক্তি ।

বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি এবং সরকারের নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে দেশে বিগত বারো বছরে (২০০৯-২০) চালের উৎপাদন ৬.০০ লক্ষ টন হারে বেড়েছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত আছে। রাইস ভিশনে যে প্রক্ষেপন করা হয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে উৎপাদনের বর্তমান গতিশীলতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০, ২০৪১ এবং ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে যথাক্রমে ৪০, ৪৪ এবং ৪৭ মিলিয়ন টন। বিপরীতে ২০৩০, ২০৪১ এবং ২০৫০ সালে যথাক্রমে ১৮৬, ২০৩ এবং ২১৫ মিলিয়ন লোকের খাদ্য চাহিদা পূরণে চাল প্রয়োজন হবে যথাক্রমে ৩৮.৫০, ৪২ এবং ৪৪.৬ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ বর্তমানের ন্যায় সামনের দিনগুলোতেও চাহিদা মিটিয়ে কিছু উদ্বৃত্ত উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েই ব্রির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২১ কোটি ৫৪ লাখ এবং স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী ২০৭১ সালে ২৪ কোটি ২৮ লাখে এসে স্থিতিশীল হবে। সর্বোপরি ২৫ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করার চিন্তা মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। প্রতি ১০০ গ্রাম চাল থেকে আমরা মোটামুটি ১২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ৭৮.০৯ গ্রাম শর্করা, ৭.১২ গ্রাম প্রোটিন, ০.২৮ গ্রাম চর্বি, ১.৩০ গ্রাম আঁশ ০.০৭ মি.গ্রাম থায়ামিন, ০.০১৫ মি. গ্রাম রিভোপ্লাবিন, ১.০৯মি. গ্রাম জিংক, ২৮ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮০ মি. গ্রাম আয়রন, ২৫ মি. গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান থাকে (ইউএসএইড পুষ্টি ডেটাবেজ)। বাংলাদেশে মাথাপিছু চালের গ্রহণের হার হিসেবে মোটামুটি দৈনিক যে পরিমাণে পুষ্টি আমরা চাল বা ভাত থেকে পাই যা কোনভাবেই আমাদের চাহিদার সমান নয়। এ কারণে খাদ্যের চাহিদা মিটলেও পুষ্টির চাহিদায় পূরণে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সী শিশুর প্রায় দু-তৃতীয়াংশই কোনো না কোনো মাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে, এর মধ্যে শতকরা ১৪ ভাগ শিশু ভুগছে মারাত্মক অপুষ্টিতে। এর কারণ পুষ্টি সচেতনতার অভাব অথবা পুষ্টিকর খাবার ক্রয় করার অসামর্থতা।

এটি বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন ভাতে কিভাবে শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপোদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করা যায়। কেননা দেশের সাধারণ মানুষ দুধ-ডিম ও মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পারলেও তারা ভাত নিয়মিত খেতে পারছে। এজন্য জিংক, আয়রন, প্রোটিন, এন্টি-অক্সিডেন্ট, গামা এমাইনো বিউটারিক এসিড (এআইএ) ও প্রো-ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস এবং স্বল্প জিআই সম্পন্ন ডায়বেটিক ধানসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবন করেছে ব্রি। দুধের উৎপাদন ১০ গুণ বাড়লেও দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। কেননা তাদের পুষ্টির অধিকাংশ ক্যালরি, প্রোটিন ও মিনারেল আসে ভাত থেকে। ভাত তাদের কাছে সহজলভ্য। দেশের সাধারণ মানুষ ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট এবং ৬০ থেকে ৬৫ প্রাত্যহিক প্রোটিন ভাতের মাধ্যমে পাচ্ছেন। সুতরাং ভাত বর্হিভূত উৎস থেকে আমাদের বাকী ২৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট এবং ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করার কৌশল ঠিক করতে হবে।

ব্রির পুষ্টিকর ধান গবেষণায় প্রথম সাফল্য আসে ২০১৩ সালে। ব্রির বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সর্বপ্রথম জিংক সমৃদ্ধ্ ধানের জাত ব্রি ধান ৬২ উদ্ভাবন করেন। মানব শরীরের জন্য জিংক খুব প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। মানবদেহে ২০০ এরও বেশি এনজাইমের নিঃসরণে অংশ গ্রহণ করে যেগুলো দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে এটি অংশ নেয়। এছাড়া দেহে এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, শর্করার ভাঙনে, দেহ কোষের বৃদ্ধিতে এবং পলিপেটাইড, গ্যাসটিন নিঃসরণের এর মাধ্যমেই স্বাদের অনুভূতি বা রুচি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। জিংক ডিএনএ ও আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের একটি আবশ্যক উপাদান। হাড়ের বৃদ্ধির জন্য কেরাটিন তৈরি ও তার পরিপক্কতা, ত্বকের ক্ষত সারানো, আবরনি কোষের রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজে মানব শরীরে জিংকের প্রয়োজন হয়। উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে ওঠার সময় জিংকের অভাব হলে শিশু-কিশোররা বেটে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু জিংক সমৃদ্ধ জাতের ভাত খেলে শরীরে জিংকের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটে যাবে এবং বেটে হবার সম্ভাবনা থাকবে না।

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের শরীরে জিংকের দৈনিক চাহিদা ১৫ মিলিগ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর দৈনিক চাহিদা ১২ মিলিগ্রাম। ব্রি ধান ৬২-তে জিংক এর পরিমাণ ১৯ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ মানুষের শরীরে জিংকের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার পুরোটাই মিটাতে পারে ব্রি ধান৬২ জাতের চাল। সাধারণত লাল মাংস, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, সয়া, দুগ্ধজাত খাবার, মাশরুম, যকৃত এবং সূর্যমুখীর বীজ জিংকের চমৎকার উৎস। কিন্তু ভাতের মতো এগুলো সহজলভ্য নয়। পরে ব্রি জিংক সমৃদ্ধ আরো চারটি জাত, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৪ এবং ব্রি ধান৮৪ অবমুক্ত করে। এই জাতগুলোর চাল জিংকের চাহিদা মেটাতে আদর্শ খাদ্য হতে পারে।

প্রোটিন বা আমিষের অভাবে দেহে সুনির্দিষ্ট অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয়। শরীরের প্রতিকেজি ওজনের জন্য পূর্ণ বয়স্কদের ক্ষেত্রে ১ গ্রাম, শিশুদের জন্য ২-৩ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। মাছ, মাংস ও ডাল প্রোটিনের অন্যতম উৎস হলেও এসব খাবার ভাতের ন্যায় সহজলভ্য নয়। ব্রি উদ্ভাবিত প্রোটিনসমৃদ্ধ জাতগুলোতে যে পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে তা আমাদের প্রোটিনের চাহিদার ৬০ ভাগ পূরণ করতে সক্ষম। যেমন, ব্রি ধান৬২-তে প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় শতকরা ৯ ভাগ। ফলে এই ধানটির ভাত মানবদেহে জিংকের পাশাপাশি প্রোটিনের চাহিদা পূরণেও অনন্য ভূমিকা রাখতে পারবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যদি ১ শতাংশ প্রোটিনের পরিমাণ চালে বৃদ্ধি করা যায়, তবে মানব শরীরে ৬.৫ শতাংশ বেশি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। আমাদের পুরানো ধানের জাতগুলির প্রোটিনের মাত্রা ছিল মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ তবে আমাদের নতুন জাতগুলির প্রোটিনের পরিমাণ ৯ থেকে ১০%। উদাহরণস্বরূপ- ব্রি ধান৮১-এ প্রোটিনের পরিমাণ ১০.৩%, ব্রি ধান৮৬-এ প্রোটিনের পরিমাণ ১০.১%, এবং ব্রি ধান৯৬-এ প্রোটিনের পরিমাণ ১০.৮%। এই জাতগুলো জনপ্রিয় ও সহজলভ্য করা গেলে পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে যে আশঙ্কা তা অনেকাংশেই মোকাবেলা করা সম্ভব। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা যাতে আমরা চাল থেকে প্রতিদিনের প্রোটিন চাহিদার কমপক্ষে ৮০ শতাংশ প্রয়োজন পূরণ করতে পারি।

আমাদের নতুন জাত ব্রি ধান ৮৪-তে আয়রনের পরিমাণ ১০ পিপিএম; আগে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোতে আয়রনের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে ৫ পিপিএম। ব্রির 'হেলদিয়ার রাইস' গবেষণা কর্মসূচির অধীনে এখন ৪৫ পিপিএম জিংক এবং ১৫ পিপিএম আয়রন সমৃদ্ধ দ্বৈত সুবিধার নতুন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা, যাতে মানব শরীরের মোট চাহিদার কমপক্ষে ৮০ ভাগ জিংক এবং ৫০ ভাগ আয়রনের চাহিদা চালের মাধ্যমে পূরণ করা যায়।

এছাড়া আমরা জানি ভিটামিন-এ এর ঘাটতি এখনো বাংলাদেশের একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দেশের প্রি-স্কুল এবং স্কুল-বয়সী শিশুদের ২০ ভাগ এর বেশি এবং গ্রামাঞ্চলে ২৫ ভাগ গর্ভবতী মহিলা ও স্তন্যদানকারী মা এই সমস্যায় ভোগেন। অবমুক্তির অপেক্ষায় থাকা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান গোল্ডেন রাইস আমাদের এই সমস্যা সমাধানে ভুমিকা রাখবে। আশা করা যাচ্ছে, গোল্ডেন রাইস অনুমোদিত ও অবমুক্ত হলে ভিটামিন এ এর চাহিদার ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করতে পারবে। কেননা গ্রামাঞ্চলের মানুষ দৈনিক ২-৩ বার ভাত খায়।

আগেই বলেছি চালকে প্রধান খাদ্যশস্য বিবেচনায় রাখতে হলে আমাদের কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট বা ক্যালরি চাল থেকে নিতে হবে। তা না হলে ডায়াবেটিক, স্থুলতাসহ বিভিন্ন জীবনাচরিত (লাইফ স্টাইল) রোগ বেড়ে যাবে। সে হিসেবে মাথাপিছু চালের গ্রহণ জনপ্রতি ১৩৪ কেজি নিচে আসা উচিত হবে না। অথচ ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অনেকে ওজন কমানোর জন্য খাদ্যতালিকা থেকে ভাত বাদ দিচ্ছেন। ভাতের পরিবর্তে তারা ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন, যা ভাতের তুলনায় আরও বেশি ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার।

অনেকে আবার বলেন, নিয়মিত ভাত খেলে লাইফস্টাইল রোগ বাড়ে। এটা আসলে সত্যি নয়, বরং আমরা প্রতিনিয়ত বাইরে যেসব স্ট্রিট ফুড বা মূখরোচক খাবার খাই, সেসব খাবারের সঙ্গে ট্রান্স ফ্যাট খাচ্ছি, এগুলোই লাইফস্টাইল রোগের জন্য অনেকখানি দায়ী।

লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর