হোয়াইট হোলের সন্ধানে

প্রতীকী ছবিছবি: সংগৃহীত
একনজরে—হোয়াইট হোলস: ইনসাইড দ্য হরাইজন, লেখক: কার্লো রোভেলি, প্রকাশক: অ্যালেন লেইন, পৃষ্ঠা: ১৬০, দাম: ১০.১ ডলার

ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের কথা আমরা বরাবরই শুনি। হোয়াইট হোলের নামও ঘুরে ফিরে আসে এর সূত্র ধরে। বিশেষ করে বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে। অনেকে ভাবেন, ব্ল্যাকহোলের মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়লে, ওটার অন্য পাশে পাওয়া যাবে হোয়াইট হোল। সেই হোয়াইট হোল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যাবে অন্য কোনো মহাবিশ্বে, অথবা এই মহাবিশ্বেরই অন্য কোথাও, বহুদূরে, অন্য কোনোখানে।

আসলে হোয়াইট হোল কী? বুঝতে হলে শুরুটা করতে হবে ব্ল্যাকহোল থেকেই।

মহাকাশে অগণিত নক্ষত্র। বুকে তাদের দাউ দাউ করে জ্বলছে নাক্ষত্রিক চুল্লী। হাইড্রোজেন-হাইড্রোজেন যুক্ত হয়ে তৈরি করছে হিলিয়াম। এই প্রক্রিয়ার নাম ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় তৈরি প্রচণ্ড চাপ নক্ষত্রের ওপর বহির্মুখী চাপ প্রয়োগ করে। আবার নক্ষত্রের প্রচণ্ড ভরের ফলে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ কাজ করে ভেতরের দিকে। এই অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী চাপের ফলে ভারসাম্যে থাকে নক্ষত্র।

কিন্তু নক্ষত্রদেরও মরে যেতে হয়। বুকের ভেতরের সব আগুন নিভে গেলে, সব হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে বাইরের দিকে আর কোনো চাপ কাজ করে না। ফলে নিজের ভরের প্রচণ্ড মহাকর্ষীয় টানে চুপসে যায় নক্ষত্রটি, ভেঙে পড়ে নিজের ওপরেই। সব নক্ষত্রেই কি এমনটা ঘটতে পারে? তা নয়। কোনো নক্ষত্র যদি সূর্যের চেয়ে অন্তত ১.৪ গুণ ভারী হয়, তবে মৃত্যু প্রক্রিয়ায় এমনটা ঘটে। এ সময় নক্ষত্রটি পরিণত হয় কৃষ্ণগহ্বরে। এত প্রচণ্ড তার মহাকর্ষ, আলোও এ থেকে বেরোতে পারে না। বাস্তবে অবশ্য কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে বদলে যায় স্থান-কালের দিক, স্থানের জায়গা নেয় কাল, আর কালের জায়গা নেয় স্থান। তবে এই সব কিছুকে এককথায় ওভাবেই বলা যায় সহজ করে—মহাকর্ষের প্রচণ্ড আকর্ষণে কিছুই কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা পেরিয়ে বেরোতে পারে না। কারণ, মহাকর্ষ মানে আসলে স্থান-কালের বিকৃতি। এখানে বলে রাখি, এই যে সূর্যের তুলনায় অন্তত ১.৪ গুণ ভারী হতে হবে, এ বিষয়টি প্রথম বুঝেছিলেন ভারতীয় জ্যোতিঃপদার্থবিদ সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর। তাঁর নামে এই সীমাকে তাই বলা হয় চন্দ্রশেখর সীমা।

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র যেখানে ভেঙে পড়ে, দিশে হারিয়ে ফেলে আপেক্ষিকতার মতো কালজয়ী তত্ত্ব। স্বাভাবিক। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব কাজ করে পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্রের মতো বড় বস্তুদের নিয়ে।

কৃষ্ণগহ্বর তো হলো। তারপর? হোয়াইট হোল কোথায়? ভবিষ্যতে! বুঝতে হলে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়তে হবে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে। বাস্তবে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকলে একসময় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে হবে। তবে কল্পনায় তো কত কিছুই করা যায়। পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে কল্পনার রথে চড়ে তাই ঢুকে পড়া যাক কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে।

বাইরের অংশটার নাম ইভেন্ট হরাইজন। ঘটনা দিগন্ত। আমরা যখন সেটা পেরিয়ে ঢুকে পড়ব, তখন বাইরে থেকে কোনো দর্শক দেখলে ভাববেন, আমরা কৃষ্ণগহ্বরের দিকে পড়ছি, পড়ছি… তাঁর হিসাবে আমাদের সময় ধীর হতে হতে প্রায় স্থির হয়ে গেছে। অথচ এই আমরা, আমরা যখন ঢুকে পড়ব, টেরও পাব না সেভাবে (বাস্তবে ওই ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার কথা নাহয় আপাতত থাকুক)। ধীরে ধীরে আমরা এগোচ্ছি কেন্দ্রের দিকে। কেন্দ্রে কী আছে? সেই মৃত নক্ষত্র। সবটা ভর তার জমে আছে এক বিন্দুতে। অকল্পনীয় ঘন, অতিভারী, ক্ষুদ্র এক বিন্দু। ঘটনা দিগন্ত থেকে ধীরে ধীরে স্থান-কাল ফানেলের মতো সরু হতে হতে একসময় গিয়ে থেমেছে সেই বিন্দুতে। ওই বিন্দুটিই সিঙ্গুলারিটি। পরম বিন্দু। আমরা ফানেলের মতো পথ ধরে এগোচ্ছি, পথটা সরু হচ্ছে। একসময় আমরা চলে যাব সেই পরম বিন্দুর কাছে।

পরম বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি কী? তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র যেখানে ভেঙে পড়ে, দিশে হারিয়ে ফেলে আপেক্ষিকতার মতো কালজয়ী তত্ত্ব। স্বাভাবিক। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব কাজ করে পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্রের মতো বড় বস্তুদের নিয়ে। অতিক্ষুদ্র যেকোনো বস্তু নিয়ে কাজ করে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। তা সেই বিন্দুসম অঞ্চলে, সেই স্থান-কালে, কিংবা স্থান-কালহীন সেই বিন্দুতে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতা—দুটোরই দরকার পড়ে। অর্থাৎ প্রয়োজন দুটোর মিলিত তত্ত্ব। এরকম একটি তত্ত্ব, আসলে হাইপোথিসিসের নাম লুপ-কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি। এই তত্ত্ব অনুসারে, পরম বিন্দুর অবস্থান ভবিষ্যতে।

স্থান-কাল যখন ভেঙে পড়ে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, একটি নির্দিষ্ট আকারের চেয়ে ছোট সে হতে পারে না। সেই অতিক্ষুদ্র আকারের নাম প্ল্যাঙ্ক আকার। তাই পরম বিন্দুর সেই অঞ্চলে অতিভারী সেই নক্ষত্রটি পরিণত হয় প্ল্যাঙ্ক নক্ষত্রে। আমরা যদি সেই নক্ষত্রটি, চুপসে যাওয়া সেই অঞ্চল—যেখানে ভেঙে পড়েছে পদার্থবিদ্যার প্রমাণিত সব সূত্র, সেখানে পৌঁছাই, এমন একটা অঞ্চল পাব, যেখানে আসলে স্থান-কাল কিচ্ছু নেই। সেই নক্ষত্র, তার চারপাশের স্থান, মহাকর্ষের প্রচণ্ড আকর্ষণে বিকৃত, এবং আমরা কল্পনার রথে—আমরা সবাই এ সময়ে বিচিত্র এক প্রক্রিয়ায় কালের রেখা ধরে ভবিষ্যতের পানে লাফ দেব। পৌঁছে যাব পরম বিন্দুর সেই অঞ্চলের ওপারে। একটা বলকে মাটিতে ছুড়ে দিলে সে যেমন ড্রপ খেয়ে আবার ওপরের দিকে ফেরে, যাকে ইংরেজিতে বলে বাউন্স; ঠিক সেরকম কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের পরম বিন্দু, সেই মৃত নক্ষত্রের অবশেষ ও আমরা স্থান-কালের শেষ সীমানায়—পদার্থবিদ্যার সূত্রের হিসাবে যেখানে শেষ হয়ে গেছে সময়, সেখানে গিয়ে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মতো প্রক্রিয়ায় বাউন্স করব।

হোয়াইট হোল বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

বাউন্স করে বল ওপরের দিকে আসে। অর্থাৎ বলটা যেভাবে পড়েছে, এখন ঘটছে তার উল্টো ঘটনা। কৃষ্ণগহ্বরের জন্য উল্টো ঘটনা যদি ভাবি—যা কিছু তার ভেতরে পড়েছে, যত পদার্থ, এর ভেতরের স্থান-কাল, সেই মৃত নক্ষত্র এবং আমরা—আমরা সবাই ঠিক উল্টোভাবে আবার বাইরের দিকে ছুটতে থাকব। অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বর থেকে যেখানে কিছুই বেরোতে পারে না, সব কিছু পড়তে থাকে ভেতরের দিকে, সেখানে এখন সব কিছু বাইরের দিকে পড়তে থাকবে। পরম বিন্দুর এ পাশের এই উল্টো কৃষ্ণগহ্বর—ভেতরের সব কিছু যেখান থেকে বেরিয়ে আসে, যার অবস্থান আসলে ভবিষ্যতে—এটিই হোয়াইট হোল।

হোয়াইট হোলের জীবনটা কেমন? আসলেই কি তার সন্ধান পাওয়া সম্ভব? এ বিষয়ে তো নানা মত আছে, নানা বিতর্ক রয়েছে বিজ্ঞানী মহলেই। সেই বিতর্কগুলো কী নিয়ে? কী ভাবছেন বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে? কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কার, হোয়াইট হোলের সম্ভাবনা, তাত্ত্বিক নানাদিক, ইতিহাসসহ সব কিছু সবিস্তারে উঠে এসেছে কার্লো রোভেলির নতুন বই হোয়াইট হোলস-এ।

লেখক একদম সহজ ভাষায় সব কিছু ব্যাখ্যা করেছেন। দান্তের ডিভাইন কমেডির উদাহরণ টেনেছেন বইতে বারবার। তাই বলে ডিভাইন কমেডি পড়া থাকতে হবে, এমন নয়। বরং এই উদাহরণ পাঠককে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে পুরো বিষয়টি। সিরিয়াস পাঠক ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ‘নোট’ অংশে বিস্তারিত আলোচনা। একদম পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়।

কার্লো রোভেলি
ছবি: সংগৃহীত

রোভেলি নিজে লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির অগ্রপথিকদের একজন। তাঁর অভিজ্ঞতা বইতে স্পষ্ট। সেভেন ব্রিফ লেসনস অন ফিজিকসখ্যাত রোভেলি জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞান লেখক হিসাবেও বেশ বিখ্যাত। সহজ ভাষায় সরল করে ব্যাখ্যা করেন সব কিছু। ধাপে ধাপে ভেঙে চুরে বুঝিয়ে বলেন, পাঠককে নিয়ে যান বিষয়ের গভীরে।

রোভেলির সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের গহীনে ভ্রমণ। গাইড হিসাবে সঙ্গে আছে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। তবে এই তত্ত্ব একসময় ছেড়ে যাবে। রোভেলি পাঠককে নিয়ে ছুটবেন ভবিষ্যতে। অনন্ত মহাশূন্যে হোয়াইট হোল ধরে বেরিয়ে আসতে গিয়ে পাঠক পদার্থবিজ্ঞানে মুগ্ধ হবেন, মহাবিশ্বের সৌন্দর্যে হবেন আভিভূত। জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায় আগ্রহী পাঠক যদি হোয়াইট হোল নিয়ে জানতে চান, বিস্ময়কর ঘোরলাগা এই ভ্রমণে আপনাকে স্বাগত।