সপ্তর্ষি: আধুনিক কালের সাত ঋষি

মেঘ আর আলোকদূষণ-মুক্ত আকাশের উত্তরে তাকালে রাত্রির আঁচলে ফুটে থাকা যে নকশাগুলো খালি চোখে ধরা দেয়, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বোধ হয় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। পাশ্চাত্য জ্যোতির্বিদ্যায় এটি মহাভালুকের (Ursa Major) লেজের অংশ। একে আবার ‘বিগ ডিপার’ নামেও ডাকা হয়। কিন্তু ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই সাতটি তারার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে প্রাচীন ভারতের সাত বিশিষ্ট জ্ঞানপিপাসু পদার্থবিজ্ঞানীর নাম। একসঙ্গে তাঁদের বলা হয় সপ্তর্ষি। এমন নামকরণের প্রকৃত কারণ এতদিন পর খুঁজে বের করা একটু কঠিন বটে। তবে কিছুটা ধারণা আমরা করতেই পারি। হয়তো প্রশ্নবোধক চিহ্নের আদলটাই এমন নামকরণের কারণ।

তারামণ্ডলের কথা থাকুক। বরং বলা যাক বাতিঘর থেকে প্রকাশিত সপ্তর্ষি বইটির কথা। লিখেছেন শিক্ষক-গবেষক ও বিজ্ঞান লেখক প্রদীপ দেব। বইয়ের নাম সপ্তর্ষি হলেও এর সঙ্গে উপরোল্লেখিত প্রাচীন ঋষিদের সরাসরি কোনো যোগ নেই। তবে এই সাত তারকাও ছিলেন একই পথের পথিক। জ্ঞান অর্জন ও স্বদেশের কল্যাণে জ্ঞান বিতরণই ছিল তাঁদের জীবনের লক্ষ্য৷ খ্যাতি বা প্রতিপত্তির মোহ তাঁদের বাঁধতে পারেনি, দমিয়ে রাখতে পারেনি। বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা বিশ্বমানের পদার্থবিজ্ঞানী তাঁরা।

বইয়ের শুরুতেই আছেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু; এরপর একই আদর্শ বুকে নিয়ে একে একে উঠে এসেছে আরও ছয়টি তারার কথা—মেসনের ভর নির্ণয়ের জন্য ফটোগ্রাফিক ইমালসন পদ্ধতির উদ্ভাবক জগদীশচন্দ্র বসুর আপন ভাগ্নে দেবেন্দ্রমোহন বসু; উপমহাদেশে বেতার-যোগাযোগসংক্রান্ত গবেষণার পথিকৃৎ শিশিরকুমার মিত্র; আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর ‘তাপীয় আয়নায়ন সমীকরণ’-এর আবিষ্কারক মেঘনাদ সাহা; মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা যাঁর নামে, সেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু; অমলকুমার রায়চৌধুরী—যাঁর সমীকরণ রচনা করেছে স্টিফেন হকিংয়ের গবেষণাসহ কসমোলজির আধুনিক অসংখ্য গবেষণার ভিত্তি; আর সবশেষে আমাদের জামাল নজরুল ইসলাম—বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী।

২২৩ পৃষ্ঠার ছোট্ট কলেবরে এই সাত পদার্থবিজ্ঞানীর কর্মময় জীবন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। সেখানে তাঁদের বেড়ে ওঠার কথা যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁদের গবেষণা জীবন, নানা প্রতিকূলতা এবং ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলার কথাও৷

এই সাত পদার্থবিজ্ঞানীর কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও একটা ব্যাপারে কিন্তু অদ্ভুত মিল ছিল। প্রত্যেকেই ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক। তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন, এই মাটির প্রতিভাগুলোকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছানোর উপযুক্ত করে তোলার। এখানে তাই আছে বাংলা ও বাঙালি শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের স্বপ্নের কথা, সে সব স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টার কথা। বিশেষত প্রথম ছয়জনের ক্ষেত্রে পরাধীন দেশের অস্থির পরিবেশে বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ছিল একরকম যুদ্ধের মতোই। সদ্য স্বাধীন দেশেও লুকিয়ে থাকে ভিন্ন রকমের প্রতিকূলতা—বিশেষত তা যদি হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। তবে চেষ্টা আর একাগ্রতা দিয়ে যে সব প্রতিকূলতাকেই জয় করা সম্ভব, তারই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আমাদের এই বিজ্ঞানীরা।

একটা কথা বলা প্রয়োজন। বইটি যেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময়ের ধারা অবলম্বন করে লেখা, তাই এটি নিছক জীবনীগ্রন্থের ছক পেরিয়ে হয়ে উঠেছে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসের আলেখ্য। আর পাঠকরা যেন নিজেদের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারেন, চাইলে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান চালাতে পারেন, সে জন্য প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে যোগ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র ও বইয়ের পূর্ণাঙ্গ তালিকা। সেই সঙ্গে লেখকের তথ্যসূত্র তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে বেশ তথ্যসমৃদ্ধ একটি বই।

এক নজরে

সপ্তর্ষি: সাতজন বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী

লেখা: প্রদীপ দেব

প্রকাশক: বাতিঘর

প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৪

প্রচ্ছদ: দেবব্রত ঘোষ

মূদ্রিত মূল্য: ৫০০ টাকা

ছোট্ট একটু জটিলতা আছে এসব তথ্যসূত্র, বই-গবেষণাপত্রের তালিকাসহ টীকামূলক বিষয়গুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে। লেখার মাঝে চিহ্নিত করে ১, ২… এভাবে দেওয়া আছে ধারাবাহিকভাবে; অথচ ১২-এর পরে চলে আসছে ১—কোন সংখ্যা দিয়ে তথ্যসূত্র বোঝাচ্ছে, আর কোনটি গবেষণাপত্র বা বই, তা আলাদা করা মাঝেমধ্যে হয়ে পড়েছে কঠিন।

তাহলে চলুন, ঘুরে আসা যাক আমাদের বিজ্ঞানচর্চার উত্থানযুগের সপ্তর্ষিলোক থেকে; সাক্ষাৎ হোক সেই তারাদের সঙ্গে, যাঁরা কখনো কখনো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছেন ঠিকই, তবু হারিয়ে যায়নি তাঁদের আলো। সে আলো তাঁরা যেমন জীবদ্দশায় ছড়িয়েছেন, তেমনি অনন্তকাল ছড়িয়ে যাবেন উত্তরসূরীদের মননে।

বইটি দেশের বিভিন্ন অফলাইন ও অনলাইন বুকশপে পাওয়া যাচ্ছে।