মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ নকশার উৎস সন্ধানে

দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন

‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ শব্দের অর্থ যাই হোক না কেন, এই প্রজাতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথমেই আসবে তাদের অভিযানের নেশার কথা। মানুষ চিরকালের দুঃসাহসী অভিযাত্রী। ইতিহাসের একেবারে গোড়া থেকেই তারা ছুটে বেড়িয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কিন্তু কেন? হয়তো খাবার—নিজের কিংবা পালিত পশুদের—কিংবা নিরাপত্তার খোঁজে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এসব নিয়ে তাদের ছোটাছুটি স্বাভাবিক, বোধগম্যও। কিন্তু দিন শেষে রাতের তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন তাদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত, তখন কি কিছু সময়ের জন্য ছেদ পড়ত তাদের চিরন্তন ছুটে চলায়?

উত্তরটা আমাদের জানা। সে সময় যাত্রাটা পায়ে হেঁটে নয়, হতো তাদের চোখের তারায় এসে ধরা দেওয়া আলোকরশ্মির পিঠে চেপে। এ যাত্রার বিস্তার স্থান-কালের বিশাল চাদরের সেইসব প্রান্তে, যেখানকার আলো ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে সরে যাচ্ছে বর্ণালির লোহিত অংশের দিকে।

মহাবিশ্বের বিশালতা, আর এর মাঝে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়কর শৃঙখলাই মানুষের মুগ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু। মহাবিশ্বের এই মহিমান্বিত নকশা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের পূর্বসূরীদের কেউ কেউ তুলনামূলক সহজ রাস্তা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেই থেকে জন্ম হয়েছিল নানা দেশি পুরাণের। কেউ কেউ আবার হেঁটেছিলেন একেবারে ভিন্ন পথে। নক্ষত্রের উত্তপ্ত গর্ভে জন্ম নেওয়া মহাজাগতিক ধুলোয় গড়া জীবসত্তার কিছু প্রতিনিধি চেষ্টা করেছিল নিজেদের ১০০ বিলিয়ন নিউরনের সংযোগগুলোর জালে ধরে রাখতে প্রায় সমান সংখ্যক আলোকবর্ষবিস্তৃত এই মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত মহান নকশা৷ তাদের সেসব প্রচেষ্টার সম্মিলিত রূপই আমাদের আজকের বিজ্ঞান।

বলছি স্টিফেন হকিংয়ের কথা। জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন হুইলচেয়ারে বন্দী হয়ে, অবশ্যই শুধু শারীরিকভাবে। তাঁর মস্তিষ্ক অবশ্য ঘুরে বেরিয়েছে মহাবিশ্বের নানা প্রান্তে; মানস চোখে তিনি খুঁজে ফিরেছেন প্রকৃতির বড় বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর

তাতে অবশ্য সন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ সেই চির ঈপ্সিত একীভূত তত্ত্ব—গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি—যা এক সুতায় বাঁধবে পুরো মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক নিয়মকে, তা আজও আমাদের হাতে ধরা দেয়নি। তাই শেষ হয়নি চিন্তার অভিযাত্রাও। আমাদের মহাজাগতিক মহাকাব্যের প্রবাদপুরুষদের একজন জীবনের শেষ ত্রিশটি বছর কাটিয়েছেন এই তত্ত্বের সন্ধানে। আমাদের কালের আরেক নায়কের সারাজীবনের গবেষণার উদ্দেশ্যও ছিল তা-ই। তবে তিনি শুধু নিজে এই চিন্তার অভিযাত্রায় নেমে ক্ষান্ত হননি, ডাক দিয়ে গেছেন তাঁর সময়ের এবং আরও পরের অভিযাত্রিকদেরও—লেখার মাধ্যমে।

বলছি স্টিফেন হকিংয়ের কথা। জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন হুইলচেয়ারে বন্দী হয়ে, অবশ্যই শুধু শারীরিকভাবে। তাঁর মস্তিষ্ক অবশ্য ঘুরে বেরিয়েছে মহাবিশ্বের নানা প্রান্তে; মানস চোখে তিনি খুঁজে ফিরেছেন প্রকৃতির বড় বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর। এসব প্রশ্ন এবং উত্তর নিয়ে লিখেছেন জনপ্রিয় বিজ্ঞান ধারার অনেকগুলো বই, যেগুলোর প্রায় প্রতিটিই ব্যাপকভাবে পাঠকনন্দিত। এগুলোর মধ্যে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ লিওনার্ড ম্লোডিনোকে সঙ্গে নিয়ে লেখা তাঁর দ্বিতীয় বই দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন, প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। দীর্ঘসময় অ্যামাজন বেস্টসেলারের তালিকায় থাকা বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারি, ২০২৪-এ প্রথমা প্রকাশন থেকে, আবুল বাসারের অনুবাদে। আজ কথা বলতে বসেছি ছোট কলেবরের মাঝে বিশাল মহাবিশ্বের মহান নকশাকে তুলে ধরতে চাওয়া এই বই নিয়ে।

এখানে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের স্রোতের উৎপত্তির কথা আছে, আবার এখানেই তা বাঁক নিতে শুরু করেছে পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক রূপরেখার দিকে, যার সঙ্গে আমাদের পরিচিত বাস্তবতার যোজন যোজন দূরত্ব থাকলেও আসলে সেটি ঘোলাটে দৈনন্দিন স্বপ্নের চেয়েও বেশি বাস্তব। আর এই দুটো স্রোতের ঠিক ক্রান্তিকোণে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সায়েন্টিফিক ডিটারমিনিজম বা বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদের সঙ্গে

৮টি অধ্যায় নিয়ে ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি, যার প্রথমেই লেখক তুলে এনেছেন কিছু প্রশ্ন, যেগুলো তাঁর ভাষায় ‘জীবনের,  মহাবিশ্বের এবং সবকিছুর চূড়ান্ত প্রশ্ন।’ ‘অস্তিত্বের রহস্য’ নামের এই অধ্যায়টায় শুধু এই প্রশ্নগুলোই নয়, বরং প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে দিতে বইটির পরবর্তী আলোচনা কোন পথে গড়াবে, তারও একটি প্রচ্ছন্ন রূপরেখা এঁকেছেন লেখক দুজন। দ্বিতীয় অধ্যায় মূলত কালের মহান বিজ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, যাঁদের কাঁধে চড়ে আমরা তাকাতে শিখেছি নক্ষত্রের দিকে। এখানে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের স্রোতের উৎপত্তির কথা আছে, আবার এখানেই তা বাঁক নিতে শুরু করেছে পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক রূপরেখার দিকে, যার সঙ্গে আমাদের পরিচিত বাস্তবতার যোজন যোজন দূরত্ব থাকলেও আসলে সেটি ঘোলাটে দৈনন্দিন স্বপ্নের চেয়েও বেশি বাস্তব। আর এই দুটো স্রোতের ঠিক ক্রান্তিকোণে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সায়েন্টিফিক ডিটারমিনিজম বা বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদের সঙ্গে, কারণ পরবর্তী অধ্যায়গুলোর গভীরে ডুব দেওয়ার সময় লাইফজ্যাকেট হিসেবে কাজ করবে এই ধারণা।

'দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন' বাংলা অনুবাদের প্রচ্ছদ
একনজরে: দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন | লেখা: স্টিফেন হকিং ও লিওনার্ড ম্লোডিনো | অনুবাদ: আবুল বাসার | প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৪ | প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন | প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম | দাম: ৪০০টাকা

পরবর্তী অধ্যায়গুলো মূলত এই আপাত অবাস্তব-বাস্তবতার দিকে ক্ষণিক দৃষ্টিপাত। এখানে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিকতার দুই বিপরীত মেরু থেকে যাত্রার মাধ্যমে পাঠক একসময় পৌঁছাবেন এই দুয়ের মাঝে বিদ্যমান ফাটলের দিকে, যা একই সঙ্গে ভীষণ সূক্ষ্ম ও বিশাল। কীভাবে পূরণ করা যায় এই ফাটল? সেই রসদ কি আছে আমাদের হাতে?

এর উত্তর একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না; কেন—সে কথা হকিং জানিয়েছেন ৭ম অধ্যায়ে, আর শেষ অধ্যায়টা হকিংয়ের চিরায়ত আশাবাদ—সে আশা মানব জাতির হাজার বছরের অনুসন্ধানের সফল সমাপ্তির।  

প্রশ্নগুলো যখন বড়, উত্তরগুলোর জটিলতাও স্বাভাবিকভাবেই হবে একই মাত্রার৷ কিন্তু কলম যেখানে হকিংয়ের হাতে, সেখানে আর এ ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তা না করলেও চলে। হকিংয়ের স্বভাবসুলভ রসবোধ এখানে ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়—লেখা এবং ছবি দুটোতেই। অবশ্য কমিকসের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ডায়াগ্রাম ব্যবহারেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করা হয়নি। আর হকিংয়ের এই সিগনেচারমার্ককে অনুবাদক পুরোপুরি অক্ষুণ্ণ রেখেছেন এ বইটিতেও, ঠিক তাঁর আগের অনুবাদগুলোর মতোই।

তাহলে চলুন, ছেড়ে দেওয়া যাক কৌতূহলের লাগাম, চিরায়ত অভিযাত্রিক মস্তিষ্কটা বেরিয়ে পড়ুক মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ নকশার উৎস সন্ধানে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা