বৈজ্ঞানিক গবেষণার আকরগ্রন্থ

একনজরে: একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী ও কয়েকটি ভাঙা হাড়, লেখক: শাহাদুজ্জামান, প্রকাশ: মাওলা ব্রাদার্স, প্রথম প্রকাশ: ২০০৪, পৃষ্ঠা: ১৯২, দাম: ২৫০ টাকা

কবির নিতান্ত দরিদ্র এক গ্রাম্য মুদি দোকানি। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সম্বল বলতে পৈতৃক ভিটেমাটি। সেটাও গ্রাস করে নিতে চায় চাচাতো ভাইয়েরা। এ জন্য জাল দলিল পর্যন্ত প্রস্তুত। কিন্তু একচুল জমি ছাড়তে রাজি নয় কবির। চাচাতো ভাইয়েরা প্রভাবশালী। ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে দুই হাত কেটে নেয় কবিরের। সেই কবির ভর্তি হয় সরকারি হাসপাতালে। গরিবদের যন্ত্রণা পদে পদে। হাসপাতালের মতো জায়গায় সেটা আরও বেশি। কবিরদের মতো অশিক্ষিত, গ্রাম্য লোকেরা জানে না হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে গেলে টিকিট কাটতে হয়, তাতে তার কাটা হাত থেকে সব রক্ত গড়িয়ে যায় যাক। কবিররা জানে না ডাক্তারদের সামনে উচ্চ স্বরে কথা বলতে মানা, ওয়ার্ড বয়দের টাকা না দিলে হাসপাতালে বেড মেলে না। আবার সরকার রোগীদের জন্য যে ওষুধ দেয়, তা-ও নাকি এত সামান্য, রোগীরা তা পায়-ই না। টাকা দিয়ে ওষুধ কিনেও সব সময় তা ঠিকঠাকমতো কাজে লাগানো যাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছায় না সব ওষুধ। দ্বিতীয়বার হয়তো আবার কিনতে হয়।

বাংলাদেশের হাসপাতালগুলো সমাজের ভেতর আরেকটা আলাদা সমাজ। নিম্নবিত্ত নাগরিকের কাছে সেই সমাজ বড্ড অচেনা। পদে পদে তাদের হেনস্তা হতে হয়। সেই হাসপাতাল নিয়ে এ দেশে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা আর হয়নি বোধ হয়। লেখক নিজেও একজন চিকিত্সক, একই সঙ্গে এনজিওতে কাজ করার দরুন ধোপদুরস্ত সমাজকর্মী।

লেখক তাই বৈজ্ঞানিক আর সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন এ দেশের চিকিত্সাব্যবস্থার করুণতম দিকটি। তারপর সেটা তুলে এনেছেন তাঁর গবেষণাপত্রে, যেটা তাঁর পিএইচডির থিসিসও। লেখক দেখিয়েছেন, গ্রীষ্মকালে হাসপাতালের অর্থোপেডিকস সেকশনে শিশু-কিশোরদের সংখ্যা বেড়ে যায়। কারণ এ সময় গাছে আম থাকে। আমের প্রতি ছোটদের দুর্নিবার আকর্ষণ। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেশির ভাগ শিশু আম পাড়তে গিয়ে পা ভাঙে। লেখক আরও দেখিয়েছেন, বর্ষাকালে সড়ক দুর্ঘটনার রোগী অনেক বেড়ে যায়, কারণ এ সময় অতিবৃষ্টির ফলে রাস্তা পিচ্ছিল থাকে। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেশির ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে। এদের আবার ৮০-৮৫ শতাংশই পুরুষ। এই বয়সে পুরুষেরাই সাধারণত কর্মক্ষম। কর্মক্ষেত্রে তাদেরই পদচারণ বেশি, তাই এই বয়সীরাই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়। অন্যদিকে আজও ঘরের বাইরের কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়েনি, তাই দুর্ঘটনাকবলিত নারীর সংখ্যাও কম। এ ধরনের গবেষণা বাংলাদেশে খুব কমই হয়। হলেও সেসব গবেষণার ফল সাধারণের কাছে পৌঁছায় না। তা ছাড়া লেখক একই সঙ্গে চিকিত্সক, নৃবিজ্ঞান এবং সুসাহিত্যিকের ভূমিকা পালন করেছেন।

নিঃসন্দেহে সমকালীন কথাসাহিত্যে শাহাদুজ্জামান এক শক্তিমান লেখকের নাম। সেই তিনিই যখন পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে কোনো গবেষণা করেন, সেটার ফলাফল তুলে ধরেন দুই মলাটের বইয়ে, তখন সেটা আর নিছকই গবেষণাগ্রন্থ হয়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও বিজ্ঞানের গণ্ডি পেরিয়ে সেই বই হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য এক বৈজ্ঞানিক উপাখ্যান।

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার জুন ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত