জগদীশচন্দ্র বসু

জগদীশচন্দ্র বসু বাংলার বিজ্ঞানীদের অগ্রদূত। তিনিই বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আমরাও বিজ্ঞানী হতে পারি। তিনিই প্রথম বলেছিলেন গাছের অনুভূতি আছে। তিনিই রেডিও বা বেতারযন্ত্রের প্রথম আবিষ্কারক। বাংলা ভাষার প্রথম সায়েন্স ফিকশন পলাতক তুফান-এর লেখক কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুই।

ডাক্তারি পড়ার জন্য বিলাত পাঠানো হয় জগদীশচন্দ্রকে। অসুস্থতার কারণে জগদীশ বসু ডাক্তারি পড়েননি। সেখানে বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র৵লের সঙ্গে জগদীশের পরিচয় হয়। সেই র৵ালেই জগদীশচন্দ্রকে উত্সাহ দেন বিজ্ঞান পড়ার জন্য।

একটানা ৩০ বছর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। চাকরিজীবনের শুরুটা সুখকর ছিল না জগদীশচন্দ্রের। ওই কলেজের প্রায় সব শিক্ষকই ইউরোপিয়ান। ব্রিটিশ সরকার মনে করত, ভারতীয়দের তুলনায় ইউরোপিয়ানদের মর্যাদা অনেক বেশি। তাই ইউরোপীয় শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হতো, বসুকে দেওয়া হতো তার তিন ভাগের এক ভাগ। এই অন্যায় জগদীশ মানতে পারলেন না। বেতন না নিয়েই শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। বিজ্ঞানশিক্ষক হিসেবে ভারতীয়রা যে ইউরোপীয়দের সমান দক্ষ হতে পারেন, তা জগদীশ বসু প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই বেরিয়ে এসেছিলেন সত্যেন বোস আর মেঘনাদ সাহার মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরা।

প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি জগদীশ বসু শুরু করলেন গবেষণা। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভালো মানের গবেষণাগার ছিল না। অধ্যাপক বসু স্থানীয় মিস্ত্রিদের ট্রেনিং দিয়ে কম টাকায় নানা ধরনের সরঞ্জাম তৈরি করিয়ে নিলেন। ১৮৯৫ সালে জগদীশ বসু কলকাতার টাউন হল মাঠে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গকে বিনা তারে দেয়াল ভেদ করে কীভাবে পাঠানো যায়, তার প্রমাণ দিলেন। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়। ওই বছরই তাঁর কাজ নিয়ে একটা ফিচার ছাপা হলো ইংল্যান্ডের ইলেকট্রিশিয়ান পত্রিকায়। সেই ফিচারে লেখা হয়েছিল, এ পর্যন্ত যতগুলো বেতারযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সব কটিকে হারিয়ে দিয়েছে জগদীশচন্দ্র বসুর বেতারযন্ত্র।

ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির এক সভায় যোগ দিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। সেই সভায় বেতারে বার্তা প্রেরণ করে তাঁর কাজের প্রমাণ দেখান। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন লর্ড র৵ালেসহ অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তাঁর বক্তব্য শুনে ও পরীক্ষাগুলো দেখে বিখ্যাত বিজ্ঞানী র৵ালে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এমন নির্ভুল পরীক্ষা আগে কখনো দেখিনি, এ যেন মায়াজাল।’ সেই বক্তৃতার পর বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে অভিনন্দন জানান।

সে সময় ইউরোপের এক বিখ্যাত ইলেকট্রনিক কোম্পানি জগদীশ বসুর বেতারযন্ত্রের নকশাটা কিনতে চায়। কিন্তু তিনি সেটা বিক্রি করতে রাজি হননি। এর কিছুদিন পরই মার্কনিও বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন। তখন সেই ইলেকট্রনিক কোম্পানি মার্কনির যন্ত্রের নকশাটা কিনে নেয়। ফলে মার্কনির তৈরি বেতারযন্ত্রই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আবিষ্কারকের মর্যাদা তিনিই পেয়ে যান। পরে নোবেল পান মার্কনি। এ নিয়ে অবশ্য জগদীশ বসুর মনে কোনো দুঃখ ছিল না। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান হলো সাধনা, ব্যবসার বস্তু নয়।

এই ছিলেন আমাদের বিজ্ঞানগুরু জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি অন্যায়কে মাথা পেতে নেননি, আবার বিজ্ঞান নিয়েও ব্যবসা করেননি। তাঁর জীবন নির্মোহভাবে লেখা সহজ কাজ নয়। এরপরও অনেকেই চেষ্টা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে পথিকৃৎ শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞানশিক্ষকের বইটাকে রাখা যায় সবার ওপরে।