কেলাসের জগতে পরিভ্রমণ

বর্তমান সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় চারশ বছর আগে। আর আজ বিজ্ঞান ও তার প্রসূত প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে কাউকে একদিন বিদ্যুৎ ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রযুক্তিপণ্য ছাড়া থাকতে বললে কেমন হবে? জোর দিয়েই বলা যায়—একদিন তো দূরের কথা, মাত্র এক ঘণ্টাও এগুলো ছাড়া থাকলে অস্থির হয়ে পড়বেন অনেকেই। আসলে এগুলো আমাদের মন ও মস্তিষ্কে এমনভাবে বসে গেছে যে এগুলো ছাড়া চলাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আর হবে নাই-বা কেন? বিজ্ঞানের জাদুতে দিনকে দিন যেসব অভিনব প্রযুক্তি আসছে, তা দেখলেই যেন স্নায়ুর সার্কিটে সাড়া পড়ে যায়।

ফেসবুকে কাউকে কিছু পাঠানো প্রয়োজন বা কারো সঙ্গে একান্ত কথা বলা প্রয়োজন—হাতের ফোন ব্যবহার করে ম্যাসেজ লিখে ‘সেন্ড’ চাপলেই সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় কাঙ্খিত গন্তব্যে। হয়তো পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বার্সা-রিয়ালের দুর্দান্ত খেলা চলছে, সেটা সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে সেখান থেকে। আবার নাসা সৌরজগতের বিভিন্ন জায়গায় নভোযান পাঠাচ্ছে। হয়তো কিবোর্ডের এক চাপে সেই নভোযানে কমান্ড পাঠাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা পৃথিবী থেকে। এরকম মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো আরও কত কিছু যে হচ্ছে পৃথিবীতে!

এ তো গেল প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা ও জীবনে তার প্রভাবের প্রত্যুত্তর। কিন্তু এই প্রযুক্তির প্রাণ হিসেবে গণ্য করা হয় যে ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে; সেগুলো, বলা বাহুল্য, কোনো না কোনো পদার্থের তৈরি। তা হতে পারে ধাতু বা পরিবাহী, কিংবা অর্ধপরিবাহী ও অপরিবাহী। অর্থাৎ কোনো কিছু উপস্থাপন করতে হলে শুরুতেই চাই সেই পদার্থের ভৌত গঠন, কাঠামো ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর জ্ঞানার্জন ও গবেষণা। আর এসবের সম্মিলিত আলোচনাই খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে কেলাসের কথা বইটিতে।

একনজরে

কেলাসের কথা

লেখক: ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

প্রকাশক: তাম্রলিপি

পৃষ্ঠা: ৮৮

মূল্য: ২৭০ টাকা

প্রচ্ছদ: শাহরিয়ার রাব্বি

প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বইটি পড়ার মাঝে অসাধারণ আনন্দ-অনুভূতি আছে। সাধারণত বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বোঝানো একটু কঠিন। কিন্তু এ বই পড়লে বোঝা যায়, সহজ ভাষায় পাঠককে বিজ্ঞান বোঝানো সম্ভব। কেলাস বা স্ফটিকের গঠন ও কাঠামোর প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে বইয়ে সুন্দরভাবে অধ্যায়গুলো সাজানো হয়েছে। বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু ও শিক্ষার্থীদের জন্য বোধগম্য হবে বলে মনে করি। বিজ্ঞানী ম্যাক্স ভন লাউয়ের এক্সরের সাহায্যে কঠিন পদার্থের পরীক্ষা শুরু করেন। ইংরেজ পিতা-পুত্র স্যার হেনরি ব্র্যাগ ও স্যার লরেন্স ব্র্যাগের কেলাসের পরমাণুগুলোর মধ্যকার দূরত্ব মাপেন। এভাবে একটি সূত্র প্রণয়ন করেন এই বিজ্ঞানী পিতা-পুত্র। এই সূত্র কেলাসবিদ্যার চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে কেলাসের গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়।

কেন একই মৌলের ভিন্ন ভিন্ন রূপভেদ এবং তাদের ভৌত ধর্মের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান, তা এই কেলাসবিদ্যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, হীরা ও গ্রাফাইটের মাঝে কত বিস্তর পার্থক্য, তা তাদের পারমাণবিক গঠন বিন্যাস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কেলাসের গঠন, তা থেকে কেলাসের শ্রেণিবিভাগ ও তাদের ধর্মের পার্থক্য—এই সবকিছুর প্রাথমিক ধারণার প্রতিফলন স্বল্প পরিসরে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ব্রাভাইস ল্যাটিস কী ও কত ভাবে তাদের বিভক্ত করা যায়, সেগুলোর জ্যামিতিক গঠন ও কোনো কেলাসের ক্ষুদ্রতম গাঠনিক একক ঘনাকার হবে নাকি চতুর্ভুজাকার, তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

এটি আমার পড়া প্রথম বাংলা বই, যেখানে তাপ ধারকত্ব এবং নিরবচ্ছিন্ন থেকে বিচ্ছিন্ন শক্তির কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ধারণা প্রদানকারী কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সরল ব্যাখ্যায় অসামান্য নৈপুণ্যতা দেখানো হয়েছে। পরিশেষে কেলাসের ভেতরে পরমাণুসমূহের স্পন্দনের সরল ছন্দিত স্পন্দনের ধারণা পূর্ণতা দিয়েছে অধ্যায়টিকে। আশা করি, বইটি বিজ্ঞান পাঠকদের ভালো লাগবে।

লেখক: প্রভাষক, নটর ডেম ইউনিভার্সিটি