বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে চাইলে

জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনার ঘরে আগুন লেগেছে। আপনি নিশ্চয়ই বসে বসে অন্য সব কাজ শেষ করে তারপর ধীরে-সুস্থে আগুন নেভাবেন না। এরকম একটা কথাটই বলেছে এক কিশোরী। তার নাম সংবাদপত্রের কল্যাণে আজ সম্ভবত সবারই জানা। গ্রেটা থুনবার্গ। তখন তার বয়স ১৫। মেয়েটা এক সকালে সিদ্ধান্ত নিল, রাজনীতিবিদ বা বড় মানুষদের কথায় কাজের কাজটুকু হচ্ছে না। পৃথিবীকে বাঁচাতে তাই তারই কিছু একটা করা প্রয়োজন। গ্রেটা নামের সেই কিশোরীর আন্দোলনটি আজ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক কিশোর-তরুণ এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সবাই একমত—পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে।

বাংলাদেশেও এরকম কিছু মানুষ জলবায়ু বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করছে আশপাশের মানুষদের। যেমন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী (স্নাতম করেছেন কানাডার ইউনিভার্সি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে) আবুল বাশার ও জলবায়ুকর্মী আরুবা ফারুক। তারা বারবার বলছে, আমাদের কিছু করা প্রয়োজন।

কিন্তু আমরা কী করব? বড় বড় প্রতিষ্ঠান নাহয় কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারে, দেশগুলো উদ্যোগ নিতে পারে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে। কিন্তু কিশোর-তরুণরা বা ব্যক্তি-মানুষ কী করবে? প্রথম কাজ হলো, জানা। জলবায়ু পরিবর্তন আসলে কী? এটা আসলে কতটা মারাত্মক?

আহমাদ মুদ্দাসসেরের লেখা সহজ ভাষায় জলবায়ু পরিবর্তন বইটি শুরু হয়েছে ঠিক এখান থেকেই। গ্রিন হাউস গ্যাস কী; আবহাওয়া আর জলবায়ুর পার্থক্য কী; জলবায়ুর ইতিহাসটা কেমন; এখন যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা কতটা প্রাকৃতিক আর মানুষ কতটা দায়ী; এ ব্যাপারে কিছু করলে ‘ভালো ভবিষ্যৎ’টা কেমন হবে—এসবই উঠে এসেছে বইটির প্রথম অধ্যায়ে।

১৩৬ পৃষ্ঠার ৮ অধ্যায়ের ছোট্ট বই। দ্বিতীয় অধ্যায়টিতে সবিস্তারে উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তন বিজ্ঞানীরা কীভাবে বোঝেন, কীভাবে এসব পরিবর্তন পরিমাপ করা হয়। এখানে বিভিন্ন ধরনের ফুটপ্রিন্টের কথা জানা যাবে। ফুটপ্রিন্ট মানে কী? পদচিহ্ন। পায়ের ছাপ। কার্বন নিঃসরণ, পানি খরচ বা অপচয়, খাদ্য কতদূর পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে—এসব নানা ক্ষেত্রে আমাদের ছাপ, চিহ্ন কীরকম, কতটা প্রভাব ফেলছে, সে সব নিয়েই অধ্যায়টির আলোচনা। সাবহেড বা উপশিরোনাম দিয়ে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত অধ্যায়টি। এরকম একটি উপশিরোনাম বেশ দৃষ্টি আকর্ষক—বিজ্ঞাপনের প্রভাব। সত্যি, বিজ্ঞাপন আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। ফলে, এর প্রভাব পড়ছে জলবায়ুতেও!

তৃতীয় অধ্যায়টি থেকে বইয়ের মূল আলোচনার শুরু। অধ্যায়টি শিরোনাম ‘তুমি কী করতে পারো’। আমরা যা যা করতে পারব নিজেদের উদ্যোগে—যেমন সচেতনভাবে খাওয়াদাওয়া করা, একটা টি-শার্ট কম পরা—এগুলোই ব্যাপক পরিসরে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধূলিকণা, বিন্দু বিন্দু জল—এভাবেই তো মহাদেশ ও সমুদ্র গড়ে ওঠে। একেকটি মানুষ মিলিয়েই পৃথিবী। তাই আমাদের এসব উদ্যোগই পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে সম্মিলিতভাবে।

চতুর্থ অধ্যায়টি বেশ ইন্টারেস্টিং। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা শুনলে অনেকে ভাবেন, এগুলো আসলে সত্যি না। এই অধ্যায়ে তাই আছে দুটি কেস স্টাডি। এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন যেমন দেখানো হয়েছে, ইতিবাচক উদ্যোগ কীভাবে নেওয়া যায়, রয়েছে সে আলোচনাও।

পঞ্চম অধ্যায়টি বাংলাদেশের কথা। এখানে একটু থেমে বইয়ের শুরুতে ‘লেখকের কথা’ অংশটি নিয়ে একটু বলা প্রয়োজন। লেখক নিজে ২০০৭ সালে সিডরের পর গিয়েছিলেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের ফুলহাতা গ্রামে। নিজের চোখে দেখেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। শুধু তাই নয়, সেখানকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের গণিত, বিজ্ঞান ও প্রোগ্রামিং শেখানোর প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তাঁর হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় জলবায়ু পরিবর্তন আর্থিকভাবে কেমন পঙ্গুত্ব চাপিয়ে দেয় মানুষের ওপর। কৃষিখাত কেমন করে ধ্বংস হয়ে যায় বন্যায়, নদীতে মিঠাপানির জায়গা দখল করে নেয় নোনা পানি।

একনজরে

সহজ ভাষায় জলবায়ু পরিবর্তন

বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে যা জানা দরকার

লেখক: আহমাদ মুদ্দাসসের

প্রকাশক: আদর্শ

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

পৃষ্ঠা: ১৩৬

দাম: ৩৪০ টাকা

একে একে সবুজ, অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব জ্বালানি; জলবায়ু শরণার্থীদের কথা—যাঁরা নিজ দেশ-গ্রাম ছেড়েছেন বাধ্য হয়ে; ছিন্নমূল—যাঁদের নিজেদের শেকড় ছিড়ে গেছে, গ্রাস করে নিয়েছে ক্রুদ্ধ পৃথিবী—জলবায়ু পরিবর্তনে জর্জরিত পৃথিবীর ক্ষোভ তাঁদের কীভাবে আঘাতে আঘাতে মুমূর্ষু করেছে, এ অধ্যায়টি তারই আখ্যান।

একদম শেষ অধ্যায়টি অনুপ্রেরণার, পথ দেখানোর। এ অধ্যায়ে জানা যাবে শুরুতে বলা সেই কিশোরী—গ্রেটার কথা। জানা যাবে বাংলাদেশে যাঁরা সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন, তাঁদের কথা।

বাংলা ভাষায় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত বিস্তৃত, তথ্যমূলক, তবে তথ্য ভারাক্রান্ত নয়—এরকম সচেতনতা বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টা দুর্লভ। জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞান বই রয়েছে অনেক, তবে আমাদের এই বাসস্থানটিকে বাঁচিয়ে তোলার লক্ষ্যে কিশোর-তরুণদের সচেতনত করার উদ্দেশ্যে খুব বেশি বই লেখা হয়নি। আজও অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন না। এই বইটি তাই সবারই পড়া প্রয়োজন। বইটি বা লেখকের বিশেষ কৃতিত্বের জন্য নয়; বিষয়টির গুরুত্বের জন্যই এ নিয়ে জানা প্রয়োজন। লেখকের কৃতিত্ব সেগুলোকে সহজভাবে, বাস্তবভাবে তুলে ধরায়—এটুকু স্বীকার না করে উপায় নেই। বইটির ভূমিকায় মুনির হাসানের বক্তব্য থেকেই এর গুরুত্ব বোঝা যাবে।

এ বইটিতেও কিছু ভুল জিনিস চোখে পড়বে। যেমন ৭৩ পৃষ্ঠায় অধ্যায়ের নামে ‘জলবায়ু’ হয়ে গেছে ‘জলবায়’। কিশোরদের জন্য বাংলায় লেখা বইতে ছবিতে ইংরেজি শব্দ—অনেকক্ষেত্রে বাহুল্য—চোখে বিসদৃশভাবে ধরা পড়ে।

বইটির পুরো নাম সহজ ভাষায় জলবায়ু পরিবর্তন: বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে যা জানা দরকার। আরেকটু ঠিক করে বললে, বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে ‘প্রাথমিকভাবে’ যা জানা দরকার, এ বইটি সেসব বিষয় উঠে এসেছে। আদর্শ থেকে প্রকাশিত বইটি পাওয়া যাবে অনলাইন-অফলাইনের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে।