বাংলার আইনস্টাইন

কীর্তনখোলার তীরে জন্ম প্রাণপ্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের। যে মাটিতে কবি জন্মান, সেই মাটি তো বিজ্ঞানীরও জন্ম দিতে পারে। জীবনানন্দ যখন পুরোপুরি লেখক হয়ে উঠেছেন, তখনই সেই বরিশাল শহরেই জন্ম অমল রায়চৌধুরীর। যাঁর নামে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে রায়চৌধুরী সমীকরণ।

গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আইনস্টাইন প্রকাশ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব। মহাকর্ষ বলের প্রকৃতি, মহাবিশ্বের জন্ম, বেড়ে ওঠার ইতিহাস তখনই জানতে শুরু করে মানুষ। আইনস্টাইনের সেই এক সমীকরণের অনেকগুলো সমাধান বেরিয়ে আসে নানা বিজ্ঞানীর হাত ধরে। সেসব সমাধান থেকে হিসাব কষে বিজ্ঞানীদের হিসাবের খাতায় একে একে জন্ম নেয় মহাজাগতিক বস্তু- সুপারনোভা, শ্বেত বামন, লাল দানব ইত্যাদি।

বাংলার আইনস্টাইন: অমল কুমার রায়চৌধুরী ।। শরীফ মাহমুদ ছিদ্দিকী ।। প্রকাশক: অনুপম প্রকাশনী ।। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ।। পৃষ্ঠা: ৮৪ ।। দাম: ১২০ টাকা

কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বের সবচেয়ে ভেলকিটা দেখান আরেক জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জশিল্ড। তিনি হিসাব কষে দেখান, মহাবিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে ঘাপটি মেরে আছে কৃষ্ণগহ্বর নামের মহাদানবেরা। এতটাই আগ্রাসী এদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র, এর ভেতর একবার কোনো বস্তু ঢুকলে তার আর সাধ্যি নেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। শুধু কি বস্তু, মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী জিনিস আলো পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পারে না। এহেন রাক্ষসী যার মহাকর্ষক্ষেত্র, খাতা-কলমে তার অস্তিত্ব যত স্পষ্টই হোক, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া এতটা সহজ কাজ ছিল না। তাই কার্ল সোয়ার্জশিল্ড কৃষ্ণগহ্বরের ভবিষ্যদ্বাণী করার পরও একে নিয়ে সত্যিকারের একটা তত্ত্ব তৈরি হতে পেরিয়ে গেছে ৫০ বছরেরও বেশি সময়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ডেভিড ফিংকেলস্টাইন, জন হুইলার, রয় কার, ওয়ার্নার ইজরায়েল, জেকব বেকেনস্টাইন, ইয়কাভ জেলদোভিচ, রজার পেনরোজ আর স্টিফেন হকিংয়ের জোর গবেষণার নতুন করে প্রাণ সৃষ্টি করে কৃষ্ণগহ্বর তত্ত্বে। একটু একটু করে উন্মোচিত হতে শুরু করে মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যটির আবরণ।

ব্ল্যাকহোলের বড় সমস্যাটা হলো সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুতে। কী এই সিঙ্গুলারিটি?

বিশাল ভরের কোনো নক্ষত্র জীবনের শেষ দশায় এলে, এদের ভেতরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া কমে যেতে থাকে। তখন ভেতরের বস্তুকণাগুলো পরস্পরের খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। ফলে আরও বাড়তে থাকে এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল। এতে বস্তুকণাগুলো আরও কাছাকাছি আসতে শুরু করে। এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। একসময় এমন অবস্থা তৈরি হয়, গোটা নক্ষত্রের সব ভর একটা বিন্দুতে এসে মিলিত হয়! সেই বিন্দুটির মহকর্ষ বল তখন এতটাই বেশি হয় যে এর চারপাশের স্থানকাল বেঁকে যায় অসীম মাত্রায়। সুতরাং সেই বক্র স্থানকাল থেকে কোনো আলোও আর বেরিয়ে আসতে পারে না।

অসীম ভরের এক পরম বিন্দু, যেখানে ভেঙে পড়ে পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র, সেই বিন্দু থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? কীভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় সেই পরম বিন্দুর? বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি ব্যাখ্যার জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত একটি সমীকরণের দিকে। সেই সমীকরণের আবিষ্কারক বরিশালের অমল রায়চৌধুরী।

ব্ল্যাকহোল–চর্চায় এই সমীকরণের ভূমিকা এখনো অপরিহার্য। অথচ এর নেপথ্যের নায়কের কথা আমরা বাঙালিরাই জানি না। বিস্মৃত এই বিজ্ঞানী সম্পর্কে বিজ্ঞানপ্রিয় তরুণদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি একা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আরেক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের শিষ্য শরীফ মাহমুদি ছিদ্দিকী। অনেক খোঁজখবর, গবেষণা করে তিনি লিখে ফেলেছিলেন অমল কুমার রায়চৌধুরীর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত। ‌কেন অমল রায়চৌধুরীকে বাংলা আইনস্টাইন বললে মোটেও ভুল বলা হয় না, তার বয়ানই রয়েছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। আশা করি, ভাবী বিজ্ঞানীদের জন্য এই বই অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে।