গণিতের রাজ্যে, বাস্তব ও কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে

মেজোকাকু খুব আলাভোলা মানুষ। পরিবারে তিনি একরকম বহিষ্কৃত। তাঁর কথা বলাও মানা! তাঁর ধানমন্ডির বাড়িটি যেন রহস্যঘেরা, দুর্ভেদ্য দুর্গ।

বাড়ির ভেতরের রহস্য জানা গেল এক ঈদে। লিভিংরুম ভর্তি বই। আর দাবা বোর্ড, অসমাপ্ত খেলা, এলোমেলো ছড়িয়ে আছে ঘুঁটিগুলো। এভাবেই শুরু হয়েছে অঙ্ক ও মেজোকাকুর হেঁয়ালি

এগোতে এগোতে আমরা জানতে পারি, মেজোকাকু আসলে একজন ডাকসাইটে গণিতবিদ। হোমরাচোমড়া প্রফেসর। লিওনার্দ অয়লারের জন্মদিনে তাঁকে আলোচনা সভায় বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়। তাহলে, এই মানুষটিকে বাড়ির কেউ সহ্য করতে পারেন না কেন!

গোল্ডবাখের কনজেকচার শুনতে খুব সহজ। এর প্রস্তাবনা হলো—দুইয়ের চেয়ে বড় সব জোড় সংখ্যাকে দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল হিসেবে দেখানো যায়। এই সেই সোনার হরিণ।

রহস্যের জট খুলতে শুরু করল গল্প শুনতে শুনতে। বইয়ের কথক তাঁর বাবার কাছে গল্প শুনতে বসলেন রমনার বটমূলে। আমরা, পাঠক, জানতে পারলাম মেজোকাকু আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। পিএইচডি শেষ করে জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। তারপর কী এক অদ্ভুত গাণিতিক ধাঁধা নিয়ে পড়েছেন সব ছেড়ে। এই ধাঁধার নাম গোল্ডবাখের কনজেকচার। সহজ করে বললে, গোল্ডবাখের ধাঁধা।

তারপর ঘটনাচক্রে মেজোকাকু, ড. রহমানকেই গিয়ে ধরলেন কথক। এর মাধ্যমে আমরা, পাঠক, ঢুকে পড়তে থাকি গণিতের আশ্চর্য জগতে। দেখতে পাই, গণিতের দুরূহতম তিন সমস্যা—রিম্যান হাইপোথিসিস, ফার্মার শেষ উপপাদ্য ও গোল্ডবাখের কনজেকচার—এই তিনটির তৃতীয়টি নিয়ে পড়লেন তিনি। সব ছেড়ে-ছুড়ে ওর পেছনে লাগলেন। দেখা যায়, মেজোকাকু বাংলার ছেলে হয়ে জার্মানিতে পড়াশোনা-গবেষণার পাঠ চুকিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় খ্যাতনামা গণিতবিদ জি এইচ হার্ডির। তিনি কাজ করতে শুরু করেন বিশুদ্ধ গণিত নিয়ে।

গোল্ডবাখের কনজেকচার শুনতে খুব সহজ। এর প্রস্তাবনা হলো—দুইয়ের চেয়ে বড় সব জোড় সংখ্যাকে দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল হিসেবে দেখানো যায়। এই সেই সোনার হরিণ। গল্পে একে একে ইতিহাসের চরিত্ররা ভীড় জমাতে শুরু করে এরপর—ডেভিড হিলবার্ট, কুর্ট গোডেল থেকে শুরু করে জন লিটলউড, অ্যালান টুরিং মেজোকাকুর সঙ্গে কখনো কথা বলেন, কখনো তাঁদের কাজকারবারে রাগ করেন ড. রহমান। আর বিভোর হয়ে থাকেন সোনার হরিণ ধরার স্বপ্নে।

সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ বই ঠিক সায়েন্স ফিকশন নয়। বিজ্ঞানের বই-ই বলা উচিত, যদিও ফিকশন—সে হিসেবে বলা যায়, ম্যাথমেটিক্যাল ফিকশন।

এখানে বাস্তব আর কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বাংলাদেশি এরকম এক গণিতবিদের চরিত্র আমাদের কি বাংলাদেশি বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের কথাও খানিকটা মনে করিয়ে দেয় না? তবে মেজোকাকু একদম ভিন্ন চরিত্র। দেশে বিজ্ঞানচর্চা বা এরকম কিছু নিয়ে তাঁর আগ্রহ নেই। বরং তিনি বলেন, গণিতে ডুবে যেতে না পারলে সেই চেষ্টাই করো না। বলে, ঠিক বিপরীতধর্মী কথার ইঙ্গিতে তিনি আরও উসকে দেন আগ্রহ। তাঁর স্বপ্নে ধরা দিয়ে যায় সংখ্যারা। নীলনয়না দুই জমজ নারীর দুঃখ ছেয়ে ফেলে তাঁর ভাবনা। মেজোকাকু কি এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন?

সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ বই ঠিক সায়েন্স ফিকশন নয়। বিজ্ঞানের বই-ই বলা উচিত, যদিও ফিকশন—সে হিসেবে বলা যায়, ম্যাথমেটিক্যাল ফিকশন। গাণিতিক উপন্যাস। গণিতের রানি-খ্যাত নাম্বার থিওরির নানা দিক এ উপন্যাসের উপজীব্য। সেই সঙ্গে ইতিহাস, বাস্তব ও কল্পনা মিলেমিশে যায়। আমাদের প্রশ্ন করতে বাধ্য করে—যে কথাটি রয়েছে ভূমিকায়—একটি গাণিতিক ধাঁধা কি একজন মানুষকে পরাজিত করতে পারে? বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে কারো জীবন?

একনজরে

অঙ্ক ও মেজোকাকুর হেঁয়ালি

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম

পৃষ্ঠা: ১১৮

দাম: ৩৫০ টাকা

গণিতে যাঁদের আগ্রহ আছে, যাঁরা ভাবতে চান, ইতিহাসের গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়তে পছন্দ করেন, এ বই তাঁদের ভালো লাগবে।

বইটির ভেতরে প্রয়োজনীয় ছবি আছে। শেষে বইয়ে বারবার ঘুরে ফিরে চলা গণিতবিদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আছে। ভাষা স্বাদু, টেনে পড়ার মতো। গণিতের জটিল অনেক বিষয় উঠে এসেছে সহজ ভাষায়, গল্পচ্ছলে। অ্যাপোস্টোলোস দোক্সিয়াদিসের আঙ্কেল পেট্রোস অ্যান্ড গোল্ডবাখ’স কনজেকচার-এর ছায়া অবলম্বনে রচিত এ বই বাংলার বিজ্ঞান বইয়ের জগতে ভিন্ন ধরনের সংযোজন। প্রায় ১৬ বছর আগে, ২০০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তখন নামটি ছিল, অঙ্কের হেঁয়ালি ও আমার মেজোকাকুর গল্প। এবারে পরিমার্জিতভাবে প্রকাশিত হলো আবারও, খানিকটা ভিন্ন নামে—প্রয়োজনীয় ছবি ও সংযোজন নিয়ে।

গণিতে যাঁদের আগ্রহ আছে, যাঁরা ভাবতে চান, ইতিহাসের গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়তে পছন্দ করেন, বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখা পেরিয়ে যেতে চান এবং উপলব্ধির নানা ধাপ পেরিয়ে বাস্তবের কঠোর কঠিনে ঠুকরে গিয়েও স্বপ্ন দেখতে চান, এ বই তাঁদের ভালো লাগবে। পাওয়া যাবে অফলাইন ও অনলাইন বইয়ের দোকানে।