সাধারণ আপেক্ষিকতার খোঁজে

আক্ষরিক অর্থেই বিংশ শতাব্দী ছিল পদার্থবিজ্ঞানের জন্য মিরাকল শতাব্দী। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর থিওরি অব রিলেটিভিটি—এই দুই শাখার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভীত। দুই ভীতেরই নির্মাণপ্রক্রিয়ায় ছিল আইনস্টাইনের নিপুণ হাতে পরশ। পদার্থবিজ্ঞানের মিরাকল সেঞ্চুরি যদি হয় বিংশ শতাব্দী, তাহলে মিরাকল ইয়ার হলো ১৯০৫ সাল। কারণ এই বছরই আইনস্টাইনের উত্থান হয় পাঁচটি ইতিহাস বদলে দেওয়া প্রবন্ধের মাধ্যমে। এর মধ্যে দুটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব, বাকি তিনটি বিশেষ আপেক্ষিকতা নিয়ে। এর পর দশ বছরের নিরলস গবেষণা। ১৯১৫ সালে নিউটনীয় গতিবিদ্যায় আঘেত চুড়ান্ত আঘাত হানেন আইনস্টাইন। নিউটনের ব্যাখ্যা করা মহার্ষের প্রকৃতি-ধর্ম ভেঙেচুরে মহাকর্ষ বলের নতুন তত্ত্ব দাঁড় করান। সেই তত্ত্বই পদার্থবিজ্ঞানের জগতে পরিচিত জেনারেল রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা নামে। মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য, বেড়ে ওঠা, প্রসারণ, নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু, ব্ল্যাকহোল, নিউট্রন স্টার, কোয়েসার, গ্যালাক্সির কাঠামো—কসমোলজি আর জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিতটাই বপিত হয় জেনারেল রিলেটিভির ভেতর থেকে। তাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানকে জানতে, মহাবিশ্বের ইতিবৃত্ত অনুসন্ধান করতে হলে সাধারণ আপেক্ষিতায় হাতেখড়ি হওয়াটা জরুরি।

সাধারণ আপেক্ষিকতা জানা অতটা সহজ নয়। ভীষণ জটিল সব গণিতের সমীকরণে ঠাসা জেনারেল রিলেটিভিটির জগৎটা। তাই এটা পপ সায়েন্সের বই লেখাও কঠিন। সমীকরণ-গ্রাফসহ জেনারেল রিলেটিভিটির নির্যাসটা স্কুল শিক্ষার্থীদের উপযোগী বই লেখা সত্যিকার অর্থেই দুরূহ। অথচ সেই দুঃসাধ্য কাজটাই নাঈম হোসেন ফারুকী করেছেন নিপুণ দক্ষতায়।

চা কফি আর জেনালের রিলেটিভিটি ঢাউস বই। হওয়ারই কথা। লেখক সমীকরণ সহযোগে সহজ বই লিখতে চেয়েছেন, সেজন্য দরকার জটিল গাণিতিক জ্ঞান। কিন্তু জটিল গণিতের জ্ঞান যাঁর নেই, তাঁকেও তো শিখতে হবে। এজন্য গণিতের গোড়ায় হাত দিয়েছেন লেখক। তারপর ধীরে ধীরে জাল বিস্তার করেছে কঠিনের দিকে। তাই কঠিন গণিতও আর শেষমেষ কঠিন থাকেনি। পদার্থবিদ্যার বেসিকের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মেনে লিখেছেন। জেনালের রিলেটিভিটি শিখতে গেলে পদার্থবিদ্যার যত রাশির মুখোমুখি হতে হবে, সেগুলির প্রত্যেকটির মূলে হাত দিয়েছেন লেখক। তাই যাঁরা স্কুল শিক্ষার্থী, বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক জ্ঞান যাঁদের ন্যূনতম, তাঁরাও সাহস করে হাতে নিতে পারেন চা কফি আর জেনারেল রিলেটিভিটি

চা কফি আর জেনারেল রিলেটিভিটি ।। নাঈম হোসেন ফারুকী ।। প্রকাশক: প্রান্ত প্রকাশন ।। প্রচ্ছদ: মেহরাব সিদ্দিকী সাবিত ।। পৃষ্ঠা: ৩৫২ ।। দাম: ৫৫০ টাকা

এ বইয়ে বিজ্ঞানীরা আছেন, আছেন কল্পচরিত্রও, আছে থট এক্সিপেরিমেন্ট। কল্পচরিত্রগুলো সেই থট এক্সপেরিমেন্টেরই পাত্র-পাত্রী। তাই সমীকরণে ঠাঁসা নিছক বিজ্ঞানের বই মনে করে একে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সহজ মুখের ভাষা ব্যবহার করেছেন লেখক, তাই ভাষাগত ও পরিভাষাজনিত জটিলতার আটকে যাওয়ার আশঙ্কাও নেই বললেই চলে।

শুধু জেনারেল রিলেটিভিতেই আটকে নেই বইটি। বিশেষ আপক্ষিকতার পাঠ না চুকিয়ে জেনারেল শিখতে গেলে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তাই আগে বিশেষ আপেক্ষিকতার ভেতরে ঢুকেছেন লেখক। আবার বিশেষ আপেক্ষিতা জানতে হলে নিউটনীয় বলবিদ্যা না জানলে চলে না। অর্থাৎ জেনালের রিলেটিভিটি জানতে জানতে যা যা জানা দরকার, তার প্রতিটি উপাদানই রাখা হয়েছে এই বইয়ে।

আপেক্ষিকতার বই যখন, অবধাররিতভাবে এসে পড়ে সময়ের ধীরে চলা, টাইম ট্রাভেলের কথা, স্থানকালের বক্র জ্যামিতি, বক্রতা, ব্ল্যাকহোলের রহস্যও। সেগুলোর গাণিতিক ভিত্তি কী? সেটা বুঝিয়েছেন লেখক সমীকরণের সাহায্যে, তেমনি গল্পের মতো করে জানিয়ে দিয়েছেন সেগুলোর চরিত্র ও ধর্মের কথা। তবু ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’র মতো একটা ব্যাপার রয়েই যায়। কারণ বইয়ের কলেবর আরও বাড়াতে চাননি লেখক। এজন্য বইয়ের নামের সঙ্গে প্রথম খণ্ড লাগিয়েছেন। এ থেকে আশা করা যায়, অদূর ভভিষ্যতে বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডও আসবে।

জেনারেল রিলেটিভিটির চমৎকার এই বইটি অমর একুশে বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে প্রান্ত প্রকাশনের স্টলে। এছাড়া অনলাইন বুক শপ থেকে কেনা যাবে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে।