বাংলার বিজ্ঞানচর্চার চতুর্মাত্রিক খতিয়ান
‘বিজ্ঞান সাক্ষরতা ও চর্চা’ বেশ চমৎকার একটি বই। স্বাদে উপাদেয়, হজমেও সহায়ক। বইটি পড়তে পড়তে বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার জগতে মোটামুটি বেশ কয়েক পাক ঘুরে আসা যায়। সেই সঙ্গে সময়ের গহ্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু অজানা তথ্য জেনে মনে বেদনা জাগে। আমাদের রাজনীতি ও সমাজনীতির সংকটের সঙ্গে বিজ্ঞান সাক্ষরতার বেহাল দশা যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এই বইটি যথেষ্ট।
তবে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার কাটা ঘায়ে ইতিহাসের নুনের ছিটা পাঠককে হজম করানোই লেখকের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়; বরং এই বই ইতিহাসের পাতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পানে আলোকপাত করার এক দারুণ প্রচেষ্টা।
বইটির সবচেয়ে চমৎকার দিক হলো এর চতুর্মাত্রিক খতিয়ান। লেখক বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চাকে চারটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন। এক. একাডেমিক অবদান; দুই. প্রাতিষ্ঠানিক অবদান; তিন. সচেতনতামূলক বা জনপ্রিয় গ্রন্থ প্রণয়ন, লেখালেখি, ব্লগিং ও পত্রিকা প্রকাশ এবং চার. সাংগঠনিক কার্যক্রম।
বইটির আরেকটি বড় গুণ হচ্ছে অকপট ও নির্মোহ বিশ্লেষণ। স্পয়লার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বইয়ের কিছু অংশ ও সে সম্পর্কে আমার সম্পূরক মন্তব্য বা দ্বিমতগুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।
বইয়ের ২২ পৃষ্ঠায় লেখক পাঠ্যবই প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘কাজেই বাংলা পাঠ্যবইয়ের মূল অবদানটা এই মাঝারি-মেধার বিপুল সংখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মূল্য বহন করে এবং ঠিক এজন্যই এটাকে চালু রাখা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে একজন জাঁদরেল অধ্যাপককে এই শ্রেণির জন্য লিখতে বললেই তিনি নির্ঘাত নাক সিঁটকাবেন। নাসিকাকে উচ্চ রাখবার এই কুলীন প্রয়াস আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ। আধুনিক ও উচ্চতর বিদ্যার জন্য বাংলায় পাঠ্যপুস্তক লেখার সমস্যা হলো—পরিভাষা, প্রকাশনা এবং বাংলা ভাষার সতত চলমানতা।’
পরের পৃষ্ঠায় (পৃষ্ঠা ২৩) তিনি ড. কুদরাত-এ-খুদার উদাহরণ টেনেছেন, ‘এই প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার কথা বলা যেতে পারে। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে রসায়নের ওপর বাংলায় বেশ কিছু পাঠ্যবই লেখেন তিনি। তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি চার খণ্ডে রচিত জৈব রসায়ন। কিন্তু এসব বইয়ে তিনি যে উদ্ভট বাংলা ব্যবহার করেন, তাতে এসব বই কখনোই পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। ফলে এই টেক্সট বইটি অচিরেই মৃত্যুবরণ করে। ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার অবদান অন্য ক্ষেত্রে উজ্জ্বল; যেমন BCSIR স্থাপনে, তাঁর অবদান শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগে দিকনির্দেশনা প্রদানে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক লেখায় তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা কেবল স্মরণীয়, অনুকরণীয় নয়।’
বইয়ের ৩১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ইতোপূর্বে আমাদের দেশ অলিম্পিয়াড সংস্কৃতির সাথে পরিচিত ছিল না। তিনজন মানুষের একক প্রচেষ্টাবলে এটা সম্ভব হয়েছে।’
এখানে আমার খানিকটা দ্বিমত রয়েছে। এটি আসলে একক প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়নি। গণিত অলিম্পিয়াডের যাত্রাবিবরণীতে যাদের নাম সংযুক্ত করা সমীচীন, তাঁরা হলেন—বাংলাদেশ দলের কোচ ড. মাহবুব মজুমদার এবং প্রয়াত ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাবেক ও বর্তমান সদস্যবৃন্দ, একাডেমিক দল ও অর্গানাইজিং দলের সব সদস্য। এককথায় ম্যাথ অলিম্পিয়াড ভলান্টিয়ারস বা মুভার্সদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই এটি সফল হয়েছে।
বইয়ের ৩৪ পৃষ্ঠায় লেখক লিখেছেন, ‘যেমন দর্শনকে আধুনিক বিজ্ঞানীরা মৃত বলেছেন এ কারণে যে কোনো প্রশ্নের দার্শনিক ভিত্তির বিশ্লেষণ দ্বারা কোনো প্রপঞ্চকে আগাম ব্যাখ্যা করা যায় না। আগামীকাল সূর্য উঠবে কি না, সেটা দার্শনিক সমস্যা হতে পারে; কিন্তু এই দর্শন থেকে আগামীকাল সূর্যগ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না। একইভাবে রবীন্দ্রমানসে ধর্ম কী প্রভাব রেখেছিল কিংবা বঙ্কিমের লেখায় হিন্দু মৌলবাদ কতটা ছিল, সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির হিসাব মেলানো যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের অবদান চিহ্নিত করতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্রের বা মেথডোলজির দরকার। সেখানে সঠিক প্রশ্ন উত্থাপন করে, সঠিক প্রতিকূলতাকে সুচিহ্নিত করে এগোতে হবে। বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের দার্শনিক ভিত্তির অনুসন্ধান সেখানে ভ্রান্ত নির্দেশনা দেখাবে।’
এ বিষয়ে মন্তব্য করতেই হচ্ছে। ফিলোসফি ইজ ডেড বা দর্শন মৃত—স্টিফেন হকিংয়ের এই উক্তিটি সব আধুনিক বিজ্ঞানীর মতামত নয়, এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভিন্নমতও রয়েছে। সুকুমার রায়ের বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই স্টাইলে ‘বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?’—অর্থাৎ ‘কী-কেন-কীভাবে?’—এই তিন রকমের প্রশ্নেই দর্শনের চলাফেরা থাকে। আর দর্শনের প্রশ্ন হিসেবে ‘আগামীকাল সূর্য উঠবে কি না’, শুধু এটাও যদি ধরে নিই, তাহলেও সেটা বরং আগাম ব্যাখ্যা চাওয়াই হলো। সেটার কারণ অনুসন্ধানে গেলে কারণ দর্শানো বা রিজনিং আসবেই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, লেখক নিজেই বইয়ের ৬৩ পৃষ্ঠায় ‘ভিশন: ২০৫০’ অংশে বলছেন, ‘প্রতিটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের দর্শন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস/অগ্রগতি জাতীয় কোর্স থাকতে হবে।’ সেই বিবেচনায় ‘এই দর্শন থেকে আগামীকাল সূর্যগ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না’—কথাটি কিছুটা স্ববিরোধ বা প্যারাডক্স তৈরি করে। অনুমান করতে পারি, এ বঙ্গে মোটা দাগে দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক বিচ্ছিন্নতা থেকেই লেখকের এই খেদোক্তি।
একনজরে
বিজ্ঞান সাক্ষরতা ও চর্চা
লেখক: ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
প্রকাশনী: জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশক: ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৯৬
দাম: ২৫০ টাকা
বইয়ের ৫৮ পৃষ্ঠায় লেখক একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকার ধোলাইখালে গাড়ির যন্ত্রাংশের প্রচুর কারখানা আছে এবং সেখানে গাড়ির প্রায় সকল যন্ত্রাংশই মেরামত/তৈরি/ক্রয় করা সম্ভব। কিন্তু ধোলাইখালের কারোর পক্ষেই একটি পূর্ণাঙ্গ দেশি ব্রান্ডের গাড়ি তৈরি সম্ভব হয়নি। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটাই আমাদের নিয়তি হতে যাচ্ছে।’
এটি আমাদের প্রযুক্তিশিল্পের এক রূঢ় বাস্তবতা। লেখকের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই। বইয়ের ৭০ পৃষ্ঠায় তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘কেউ বলে না যে ‘হিমায়ক হতে কোক আনো’, সবাই বলে ‘ফ্রিজ খুলে কোক আনো’।
বইয়ের শেষ দিকে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০’ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ এড়ানোর জন্য আমি এ অংশ সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করছি না। কারণ, লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক হওয়ার সুবাদে এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষামূলক ও শিক্ষণীয় খুনসুটি লেগেই থাকে। তাই সেসব কথা না হয় গোপনই থাক। শুধু এটুকুই বলব, এখানে প্রস্তাবিত ধারণাগুলো বাস্তবায়নে অনেক ক্ষেত্রে বেগ পেতে হতে পারে। বিশেষত ‘খোলা চেক ও দুই দশক সময়’—কোনোটাই আসলে বাস্তবে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সেই তুলনায় এই রূপরেখা অনেক ক্ষেত্রে মন্দের ভালো।
তবে লেখকের নানা মত ও মতপ্রকাশে কিঞ্চিত স্ববিরোধ ও বায়াসকে মানবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। তাই বাজি ধরে বলতে পারি, আজি হতে শতবর্ষ পরেও বাংলার বিজ্ঞান শিক্ষার নির্মোহ ও ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিসের পথে এই বইটি পাথেয় হয়ে রইবে।