সাধারণ আপেক্ষিকতা বুঝতে চাইলে

পদার্থবিজ্ঞানের যত গভীরে যাওয়া যায়, বিষয়গুলো সাধারণ মস্তিষ্কে চিন্তা করা তত দুরূহ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সমীকরণের ভিড়ে হারিয়ে যেতে থাকে তার বাস্তব চিত্র। শেষ পর্যন্ত আমরা পাই কিছু হিজিবিজি বর্ণের সমাহার, কিংবা কিছু দুর্বোধ্য সংকেতবাহী লিপি। পাঠ্যবইগুলো দেখলে সহজ জিনিসকেও অনেক কঠিন মনে হয়। আর যখন বিষয়টা হয় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের, তখন তা দুর্বোধ্যতার সীমা অতিক্রম করে চলে যায় অসীমের দিকে। কিন্তু আজকের আলোচ্য বইটা ব্যতিক্রম। চা কফি আর জেনারেল রিলেটিভিটি—নাম শুনে উদ্ভট মনে হলেও এর অর্থ আসলে স্বার্থক।

জেনারেল রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়। তবে একে যে চা-কফি খাওয়ার মতো করে বোঝার চেষ্টা করা সম্ভব, এই বইতে সেটাই দেখানো হয়েছে।

এই সিরিজের প্রথম বই—চা কফি আর জেনারেল রিলেটিভিটি: প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে। সেই ধারাবাহিকতায় বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ। এই খণ্ডে লেখকের চেষ্টা ছিল ডায়াগ্রামের মাধ্যমে জটিল ও দুর্বোধ্য সমীকরণগুলোর মানসিক চিত্র দাঁড় করানো, যাতে পাঠক প্রতিটা সমীকরণের প্রতিটি পদের অর্থ ভালোভাবে অনুভব করতে পারেন৷ এ জন্য কন্টিনিউয়াস ফাংশনকে ক্ষুদ্র আকারে ডিসক্রিট গ্রাফের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বলতে গেলে গ্রাফ বা ডায়াগ্রামে ঠাসা বইটি৷

বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশনের একটা চমৎকার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা। এ জন্য যেসব মৌলিক বিষয় দরকার, সবগুলো লেখক বইতে ধীরে ধীরে তুলে এনেছেন। তার আগে অবশ্যই বইটির প্রথম খণ্ড পড়তে হবে। তা না হলে অনেক কিছুই বোঝা যাবে না।

এবারে একটু বলি, বইতে কী কী আছে। প্রথমেই পাঠক পাবেন ফিল্ড ক্যালকুলাস, যেখানে পয়সন ফিল্ড ইকুয়েশনের (ক্ষেত্র সমীকরণ) প্রতিপাদন দেখানো হয়েছে। পরের অধ্যায়ে আছে ডিফারেন্সিয়াল জ্যামিতি। এই বিশেষ জ্যামিতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে পুরো জেনারেল রিলেটিভিটি, মানে আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। সরল, সহজ, অ-জড় প্রসঙ্গ কাঠামো থেকে কীভাবে স্থান-কালের বক্রতার ধারণা আসে, তার স্বরূপ উন্মোচনের জন্য এই অধ্যায়ে আছে কোভেক্টর, কোভ্যারিয়েন্ট ডেরিভেটিভ ও ক্রিস্টোফেল সিম্বল নামে একটি বিষয়, যা স্থান-কালের বক্রতার ফলাফল হিসেবে মহাকর্ষীয় ত্বরণের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দেয়। জিওডেসিক (সহজে বললে, যে সরল বা ক্ষুদ্রতম পথে বস্তু চলতে চায়) ও তার ডেভিয়েশন বা বিচ্যুতির ব্যাখ্যার জন্য আসে রিম্যান কার্ভেচার টেন্সর। প্রায় কাছাকাছি কাজের জন্য প্রয়োজন হয় রিচি কার্ভেচার টেন্সর।

 এর মধ্যে পাঠক পাবেন নিউটন কার্তান ফিল্ড ইকুয়েশন। এর মাধ্যমে পাঠক নিজের চোখে দেখতে পাবেন, কীভাবে সহজ সরল সমীকরণগুলো আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশনের মতো জটিল সমীকরণে রূপ নিতে চাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় পাঠক দেখবেন শূন্যস্থানে সরলীকৃত আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশনের একটি প্রয়োগ। তারপর ব্ল্যাকহোলের মেট্রিক সমীকরণ প্রতিপাদন করা হবে।

এরপরে আছে বহু অপেক্ষার সেই আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশন, যার ব্যাখ্যা শুরু হবে এনার্জি মোমেন্টাম টেন্সরের মাধ্যমে। এই টেন্সর ব্যাখ্যা করে কীভাবে স্থান-কালে ‘স্ট্রেস’ থাকতে পারে। এই স্ট্রেসগুলো মূলত ভর বা মোট শক্তি, কৌণিক ভরবেগ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। মূলত এই টেন্সরই নির্ধারণ করে দেয় স্থান-কালের বক্রতার পরিমাণ। তারপর সেকেন্ড বিয়াঙ্কি আইডেন্টিটি থেকে আসে আইনস্টাইন টেন্সর। এসব টেন্সর মিলে প্রতিষ্ঠিত হয় আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশনস, যা মূলত ১৬টি সমীকরণের সমাহার! এই বিশাল জিনিসের ব্যাখ্যা বইটিতে ধাপে ধাপে সুন্দর বর্ণনার মাধ্যমে, গণিত ও ডায়াগ্রামের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে।

একনজরে

চা কফি আর জেনারেল রিলেটিভিটি: ২য় খণ্ড

নাঈম হোসেন ফারুকী

প্রকাশক: প্রান্ত প্রকাশন

প্রচ্ছদ: সমুদ্র জিত সাহা

প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০২৪

পৃষ্ঠা: ৩৪২

দাম: ৬০০ টাকা

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠকের বইটি পড়তে লাগবে ধৈর্য্য ও বুঝে পড়ার মানসিকতা। জানতে হবে ক্যালকুলাস, ভেক্টর, মেট্রিক্স ইত্যাদি। আর প্রথম খণ্ড যে পড়ে আসতে হবে, তা তো আগেই বলেছি। এ ছাড়াও প্রতিটা অধ্যায়ের শেষে আছে কিছু কোডিং এক্টিভিটি। মূলত জেনারেল রিলেটিভিটির বড় বড় হিসাবগুলো সহজে প্রোগ্রাম দিয়ে করা যায়। এগুলো এত বড় যে এক রিম্যান কার্ভেচার টেন্সরের কম্পোনেন্ট, মানে উপাদানই ২৬৪টা, যা আলাদা আলাদাভাবে বের করতে হয়!

তবে এটুকু কষ্ট হয়তো আগ্রহী পাঠক করতে চাইবেন। কারণ, বইয়ের শেষে তৃতীয় খণ্ডের ব্যাপারে লেখক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, তৃতীয় খণ্ডে কসমোলজি (বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব) এবং ফিল্ড থিওরি (ক্ষেত্র সমীকরণ) সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকবে।

বইটির লেখক নাঈম হোসেন ফারুকী পেশাগত জীবনে প্রকৌশলী। তবে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর আগ্রহ প্রবল। এ বইতে সেই আগ্রহের প্রতিফলন বুঝতে পারবেন পাঠক।

সর্বোপরি আমার কাছে নিজে নিজে জেনারেল রিলেটিভিটি শেখার জন্য বইটিকে অত্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড মনে হয়েছে। বইয়ের কিছু বানান ভুল ও প্রিন্টিং মিস্টেক ছাড়া আর কিছু বাজে লাগেনি। কিছু ক্ষেত্রে কিছু উদাহরণ অতিরিক্ত এবং কনফিউজিং মনে হলেও তা নগণ্য ছিল, তাই এড়িয়ে গিয়েছি।

এই বই পড়তে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছি সময় নিয়ে। অনেক ভেবে এগোতে হয়। তা অবশ্য লাগারই কথা। আইনস্টাইনের যে জিনিস বুঝতে ১০ বছর লেগেছে, সেই জিনিস বুঝতে পাঠকের যদি কিছুটা সময় না লাগে, তাহলে চলে নাকি!