‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে…..’
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হোমো স্যাপিয়েন্স অর্জন করেছে কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের বিকাশ দিয়েছে উন্নত চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা, আর দুপায়ে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখে তারা পেয়েছে অসীমে চোখ মেলার সুযোগ। ফলে কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম একপাশে সরিয়ে রেখে তারা চিন্তা করতে পেরেছে বিশ্বজগতের নিয়মগুলো নিয়ে। এভাবেই সূচনা হয়েছে বিজ্ঞানের।
বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রাচীন শাখা যে জ্যোতির্বিদ্যা, সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়। কারণ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রে ছিল পরিবেশের সবচেয়ে মহাজাগতিক অংশটি—নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ। অবশ্য তখনও জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে কোনো স্পষ্ট সীমারেখা ছিল না। কোপার্নিকাসের কালে জ্যোতিষশাস্ত্র অন্ধকারের চোরাগলিতে পথ হারিয়ে নেমে গেল ছদ্মবিজ্ঞান বা স্যুডোসায়েন্সের কাতারে, আর বাস্তবিক অর্থেই আলোকরশ্মির পিঠে চেপে জ্যোতির্বিদ্যা, কিংবা এর আধুনিকতম সংস্করণ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান যাত্রা করল অনন্তের পথে।
এই অ্যাস্ট্রোফিজিকস, মানে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান ও তার প্রধান ভিত্তিপ্রস্তর—মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি—মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যাঁরা নিরলস কাজ করে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে কার্ল সাগানের উত্তরসূরী হিসেবে শুরুর দিকেই আসবে নীল ডিগ্র্যাস টাইসনের নাম। মার্কিন এই জ্যোতিঃপদার্থবিদ টেলিভিশনের পর্দায় যেমন বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন, তেমনি লিখেছেন বেশ কিছু জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই। ২০১৭ সালে তাঁর অ্যাস্ট্রোফিজিকস ফর পিপল ইন আ হারি বইটি প্রকাশের পরপরই নিউইয়র্ক টাইমস-এর জরিপে নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে বেস্টসেলার তালিকায় স্থান পায়। সেই ধারাবাহিকতায় গ্রেগরি মোনের সঙ্গে তিনি বইটির কিশোর উপযোগী একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন—অ্যাস্ট্রোফিজিকস ফর ইয়াং পিপল ইন আ হারি। ২০২১ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয় অ্যাস্ট্রোফিজিকস: সহজ পাঠ নামে, আবুল বাসারের অনুবাদে।
কিন্তু হঠাৎ খুদে অনুসন্ধানীদের কেন এ গল্প শোনাতে চাইছেন টাইসন? তিনি নিজে অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সে।
সূচিপত্রে ১২টি অধ্যায় দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা আসলে স্বল্প আয়তনের বই। শুরুতেই পাবেন টাইসনের স্বভাবসুলভ হালকা চালের বুননে বাঁধা ‘সর্বকালের সেরা কাহিনি’।
এটি কোনো দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা কাহিনি নয়। তবে রোমাঞ্চের দিক থেকে শার্লক হোমসের যেকোনো অভিযান বা আগাথা ক্রিস্টির রহস্যকে হার মানাতে পারে এক তুড়িতে। কারণ কাহিনিটি সময়ের সূচনার। যখন অসীম বক্রতার অকল্পনীয়রকম ক্ষুদ্র এক বিন্দু প্রসারিত হয়ে রূপ নিয়েছিল এই মহাবিশ্বে। সে সময়টাকে আমরা বলি মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং। সেখান থেকে মহাকালের সিঁড়ি বেয়ে লেখক এগিয়েছেন আজকের সময়ের পথে। এর মধ্যে ফিরে ফিরে এসেছে এই সময়ের সায়েন্টিফিক ক্রেজ ও সেগুলোর গোড়ার কথা। এক্সোপ্ল্যানেট, এলিয়েন থেকে শুরু করে ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি—বাদ যায়নি কিছুই। আর পুরোটাই লেখা হয়েছে এমন ঢঙে, যেন কিশোর-তরুণরা পুরোপুরি একাত্মভাবে অনুভব করতে পারে বিষয়গুলোকে। সব মিলিয়ে এই বই আমাদের মহাজাগতিক মহাকাব্যের চমৎকার এক কিশোরপাঠ্য সংস্করণ।
কিন্তু হঠাৎ খুদে অনুসন্ধানীদের কেন এ গল্প শোনাতে চাইছেন টাইসন? তিনি নিজে অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। এর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির প্ল্যানেটারিয়ামের একটা স্টার শো, অর্থাৎ নক্ষত্র প্রদর্শনী। তাই বলে তিনিও যে একই পরিকল্পনা নিয়ে বইটি লিখছেন, চট করে তা ভেবে নেওয়া বোধ হয় খুব বেশি যুক্তিসঙ্গত হবে না। বরং লেখকের বয়ানেই শোনা যাক তাঁর উদ্দেশ্য, ‘এই বই যারা পড়বে, তারা যে রাতারাতি অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হতে চাইবে, আমি তা আশা করি না। কিন্তু তোমার কৌতূহলে হয়তো স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেবে বইটা। রাতের আকাশে তাকিয়ে তুমি যদি কখনো বিস্মিত হয়ে ভাবো—এসবের মানে কী? এগুলো কীভাবে কাজ করে? মহাবিশ্বে আমার জায়গাটা কোথায়? তাহলে তোমাকে বইটা পড়া চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করব। অ্যাস্ট্রোফিজিকস ফর ইয়াং পিপল ইন আ হারি বইটা বড় বড় ধারণা ও আবিষ্কার সম্পর্কে তোমাকে প্রাথমিক জ্ঞানটুকু দিতে পারবে। এসব ধারণা ও আবিষ্কার মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ভাবতে সাহায্য করে। আমি যদি এ কাজে সফল হই, তাহলে ডিনার টেবিলে বসে তোমার বাবা-মাকে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে তুমি। তোমার শিক্ষককেও মুগ্ধ করতে পারবে। আবার মেঘহীন রাতে নক্ষত্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারবে গভীর অনুভূতি নিয়ে। তখন তোমার দৃষ্টিতে একই সঙ্গে থাকবে উপলব্ধি ও বিস্ময়।’
একনজরে
অ্যাস্ট্রোফিজিকস সহজ পাঠ
লেখা: নীল ডিগ্র্যাস টাইসন ও গ্রেগরি মোন
ভাষান্তর: আবুল বাসার
প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০২১
দাম: ২৮০ টাকা
‘ওপরে তাকাও, চিন্তায় বড় হও’—এ বড় হওয়া নিজেকে বড় ভাবা নয়, বরং বুঝতে ও স্বীকার করতে শেখা যে আমরা অতি সাধারণ, কোনোভাবেই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু নই
এই উপলব্ধির বিষয়টাকে লেখক আরও বেশি স্পষ্ট করেছেন শেষ অধ্যায়ে, যেখানে তিনি মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। আশা রেখেছেন এ দৃষ্টিভঙ্গিকে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরার। যে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায়, ‘ওপরে তাকাও, চিন্তায় বড় হও’—এ বড় হওয়া নিজেকে বড় ভাবা নয়, বরং বুঝতে ও স্বীকার করতে শেখা যে আমরা অতি সাধারণ, কোনোভাবেই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু নই—তা সত্ত্বেও আমরা এই মহাবিশ্বকে বুঝতে পারি, এর বিশালত্ব ও সুষমাকে অনুভব করে বিস্মিত হতে পারি এবং একে ভালোবাসতে পারি।
বইটি পাওয়া যাবে অনলাইন-অফলাইন বুকশপগুলোতে, রকমারি ডটকম ও প্রথমা বইয়ের দুনিয়ায়।