প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমান ও বিপরীতমুখি প্রতিক্রিয়া আছে—প্রবাদবাক্যে পরিণত হওয়া নিউটনের তৃতীয় সূত্র এটা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সব ঘটনায় এ সূত্রটা ব্যবহৃত হয়। মোটাদাগে সবচেয়ে বড় ব্যবহার মহাকাশে রকেট পাঠাতে, কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে মিসাইল ছুড়তে। মহাজাগতিক বস্তুর ক্ষেত্রে সেটা কতটা খাটে? দুটি নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষে, গ্রহদের সঙ্গে গ্রহাণুর সংঘর্ষে নিউটনের তৃতীয় সূত্র সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু ব্ল্যাকহোলে? দুটি ব্ল্যাকহোলের মধ্যে সংঘর্ষ হলে কি এই সূত্রের সক্রিয়তা দেখা যায়? ব্ল্যাকহোলের ব্যাখ্যা নিউটনের সূত্রগুলো দিয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে হোয়াইট হোলকে কী বলবেন?
হোয়াইট হোল হলো ব্ল্যাকহোলের সম্পূর্ণ বিপরীত। হ্যাঁ, ব্ল্যাকহোল নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে হোয়াইট হোলে পরিণত হয় না বটে, কিন্তু বিপরীত দশা ও বিপরীত চরিত্রের কারণে আমরা নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সঙ্গে তুলনা টানছি। বলতে পারেন, সেটা স্রেফ মজা করার জন্য। এ ছাড়া ব্ল্যাকহোলের মতো হোয়াইট হোলেও নিউটনের সূত্র অচল। আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের একটা ধারণা আছে হোয়াইট হোল সম্পর্কে—ভুল ধারণা। আমরা ভাবি, আলবার্ট আইনস্টাইন ও নাথান রোজেনের ওই বিখ্যাত রোজেন-আইনস্টাইন ব্রিজ—বর্তমানে যেটা ওয়ার্মহোল নামে পরিচিত—সেখানে বুঝি মিলতে পারে হোয়াইট হোলের দেখা। ব্ল্যাকহোল আর হোয়াইট হোল পরস্পরের সিঙ্গুলারিটিকে বিলীন করে মাঝখানে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ওয়ার্মহোলে। ব্রিজের এক পাশে ব্ল্যাকহোলের মুখ, অন্যপাশে হোয়াইট হোলের গহ্বর।
সেখান থেকেই আমাদের ভাসাভাসাভাবে জানা, হোয়াইট হোল ব্ল্যাকহোলের ঠিক উল্টো। ব্ল্যাকহোল যেমন সবকিছু গিলে খায়, তেমনি তার ঘটনা দিগন্তের ভেতরে ঢুকে পড়া বস্তুকে আর কখনোই ফেরত দেয় না। তেমনি হোয়াইট হোল এমন এক গহ্ববর যে, কোনো কিছুই শোষণ করে না, সব ফিরিয়ে দেয়। আলো ব্ল্যাকহোল থেকে ফিরতে পারে না বলে যেমন সেটা একেবারে কালো, তেমনি কিছুই শোষণ না করার কারণে হোয়াইট হোল অতি উজ্জ্বল। আমাদের এই ধারণা আংশিক ঠিক। হোয়াইট হোল কিছুই শোষণ করে না। বরং সবকিছু প্রতিফলিত করে। কিন্তু এই ব্যাপারটা বাদে আর কিছুই আমাদের অনুমানের মতো নয়। ব্ল্যাকহোল নিয়ে অনেকেরই হয়তো মোটামুটি একটা ধারণা আছে। কিন্তু কার্লো রোভেল্লির হোয়াইট হোলস বইটা পড়ার পর মনে হবে, হোয়াইট হোল বিষয়ে আমরা আসলে কিছুই জানি না। শুধু নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো সবকিছুর উল্টো ব্যাপারটা ছাড়া।
‘আমি যখন কোনোকিছু নিয়ে লিখি, আমার মনের ভেতর তখন দুজন পাঠক থাকে। এদের একজন পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাঁকে আমি গবেষণার সৌন্দর্য দেখানোর চেষ্টা করি।’
ইতালিয়ান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী কার্লো রোভেল্লি লুপ কোয়ান্টাম থিওরির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর লেখার হাত দুর্দান্ত। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন হার্ডকোর বিজ্ঞানের বই লিখেছেন, তেমনি সাধারণ পাঠকদের জন্য লিখেছেন অসাধারণ কিছু জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই। এই ধারারই একটি অসামান্য সংযোজন হোয়াইট হোলস বইটি। ঝরঝরে গদ্যে খুব অল্প কথাই বিজ্ঞানের নবীনতম একটা হাইপোথিসিস নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি।
হোয়াইট হোল নামে সেই হাইপোথিসের প্রাথমিক ভাবনাটা এসেছিল তাঁর শিষ্য হ্যাল হ্যাগর্ডের মাথায়। তারপর গুরু-শিষ্য মিলে একটা গাণিতক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং যেমন ব্ল্যাকহোলকে বিকিরণের আয়নায় বাঁধতে চেয়েছিলেন, ব্যাখ্যা করেছিলেন গণিতের ভাষায়, অনেকটা তেমনি করে রোভেল্লি আর হ্যাল মিলে নির্মাণ করেছেন হোয়াইট হোলকে।
হোয়াইট হোলস বইটি তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্বে ব্ল্যাকহোলের খুঁটিনাটি এবং ব্ল্যাকহোল বিষয়ক প্রচলিত তত্বগুলোর ফাঁক-ফোঁকর বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ঘটনা দিগন্ত এবং সিঙ্গুলারিটি নিয়ে আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের যে অস্পষ্ট ধারণা আছে, সেটা বেশ স্পষ্ট করে তুলেছেন এই বইয়ে। ব্ল্যাকহোল অনেকটা ফানেলের মতো। সেই বিশাল ফানেলের ওপরের চওড়া মুখটা ঘটনা দিগন্ত, আর ফানেলের নলের শেষ বিন্দুতে থাকে সিঙ্গুলারিটি। এ বিষয়টার যেমন সরল বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনি চমক দিয়েছেন সিঙ্গুলারিটির বিশেষত্বের নতুন তথ্য জানিয়ে। তিনি বলছেন, ফানেলের শেষ বিন্দুতে সিঙ্গুলারিটি থাকে ঠিকই, তবে ‘বর্তমানে’ এই বিন্দুর কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং সিঙ্গুলারিটি ফানেলের শেষপ্রান্তে ঘুমিয়ে আছে ‘ভবিষ্যতের’ গর্ভে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে রোভেল্লি তাঁর স্বপ্নের হোয়াইট হোল নামের বস্তুটির কাঁটামো তৈরি করেছেন সহজ-সাবলীল ভাষায়। এখানেই তিনি বলেছেন, ‘হোয়াইট হোল এনট্রপি ও সময়ের স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে সময়ের পেছন দিকে ক্রিয়া করে। কোনো ভারী নক্ষত্র যখন নিজের কেন্দ্রের দিকে ভেঙে পড়ে, তখনই সিঙ্গুলারিটির দিকে এগোয়।’
হোয়াইট হোলস বইটি তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্বে ব্ল্যাকহোলের খুঁটিনাটি এবং ব্ল্যাকহোল বিষয়ক প্রচলিত তত্বগুলোর ফাঁক-ফোঁকর বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
এক নজরে
হোয়াইট হোলস
কার্লো রোভেল্লি
ভাষান্তর: আবুল বাসার
প্রচ্ছদ: উচ্ছ্বাস তৌসিফ
প্রকাশক: প্রথমা
প্রথম প্রকাশ: মে, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৬০
দাম : ৩২০ টাকা
ফানেলের মতো একটা মুখ রেখে নক্ষত্রের সব ভর গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয় ফানেলের নলের শেষ বিন্দুতে। কিন্তু সিঙ্গুলারিটি যদি বর্তমানে না থাকে, এমনটাও হতে পারে যে স্থানকালের পেছন দিকে গিয়ে সেই নক্ষত্রটা একটা হোয়াইট হোলে রূপ নিচ্ছে। বাস্তবে এমনটা কখনো ঘটতে দেখি না বটে, কিন্তু ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ভেতরে পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ নীতিগুলো কাজ করে না। স্থান-কাল সেখানে ওলট-পালট হয়ে যায়। তাই ফানেলের নলের টিউবের শেষপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার আগেই নক্ষত্রের বিন্দুর মতো ভর-শক্তি বাউন্স করে আবারও পেছনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। সেই সম্ভানাটাকে গাণিতিক রূপ দিয়ে হোয়াইট হোলে পরিণত করেছেন রোভেল্লি আর তাঁর শিষ্য হ্যাল। ব্ল্যাকহোলের নিজের কেন্দ্রের ওপর ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা যদি ভিডিও করা যেত, সেই ভিডিও রিভার্স মোডে চালানো যেত, তাহলে আমরা একটা হোয়াইট হোলের গঠন প্রক্রিয়া দেখতাম।
হোয়াইট হোলস বইয়ের তৃতীয় পর্বে রোভেল্লি ব্ল্যাকহোল ও হোয়াইট হোলের মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক তৈরি করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, মহাকাশে যেভাবে ব্ল্যাকহোলেরা ঘাপটি মেরে থাকে, তেমনি থাকতে পারে হোয়াইট হোলও। বাইরে থেকে দেখলে একটা ব্ল্যাকহোল আর হোয়াইট হোলের চেহারায় কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য এদের আচরণে। সেই আচরণের ফিরিস্তিই পুরো বই জুড়ে শুনিয়েছেন রোভেল্লি।
বইটি কীভাবে লিখলে সাধারণ পাঠকদের বোধগম্য হবে, সে চেষ্টার একটা নমুনা এই বইয়ে ১১৩ পৃষ্ঠার দুটি লাইন থেকে স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেখানে রোভেল্লি বলছেন, ‘আমি যখন কোনোকিছু নিয়ে লিখি, আমার মনের ভেতর তখন দুজন পাঠক থাকে। এদের একজন পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাঁকে আমি গবেষণার সৌন্দর্য দেখানোর চেষ্টা করি।’
লেখক যেমন ভাষার সাবলিলতায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, এই বইয়ের অনুবাদক আবুল বাসারও সে কাজটিই করেছেন বাংলা রূপান্তর করতে গিয়ে। বিজ্ঞান বইয়ে তাঁর অসাধারণ অনুবাদের দক্ষতা সম্পর্কে বিজ্ঞানপাঠক মাত্রই জানেন। সেই দক্ষতার বিচ্ছুরণ এই বইয়ে পাওয়া যাবে। অবশ্য শুরুর দিকে বেশ কয়েক জায়গায় আড়ষ্টতা আছে। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা এগোলেই সব ভুলে পাঠক এক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক যাত্রার রোমাঞ্চকর অনুভূতি লাভ করবেন।
লেখক: সাংবাদিক