সবকিছুর তত্ত্ব সন্ধান

প্রাচীন গ্রিক থেকে শুরু করে বর্তমানে একুশ শতকের আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক রহস্যের মধ্যে অন্যতম হলো, মহাবিশ্বের শুরুটা হয়েছে কীভাবে? মহাবিশ্ব কত বড়? এ তালিকায় আরও আছে মহাবিশ্বের অতি ক্ষুধার্ত কৃষ্ণগহ্বর।

এসব রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানীদের বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। বিশাল বিশাল সব গাণিতিক প্রমাণ। তবে স্টিফেন হকিং তাঁর এ বইয়ে কোনো গাণিতিক সমীকরণ রাখেননি, বরং খুব সহজে গাণিতিক সমীকরণ সরিয়ে রেখেই মহাবিশ্বের মৌলিক নীতিগুলো উপস্থাপন করেছেন তাঁর দ্য থিওরি অব এভরিথিং বইয়ে।

বইটিতে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং পাঠকদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসের মাধ্যমে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক আবিষ্কার পর্যন্ত বাস্তবতার প্রকৃতি ও মহাজাগতিক রহস্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আলোচনায় উঠে এসেছে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি। বইটিতে এরকম মোট সাতটি বক্তৃতা রয়েছে।

বইয়ের মূল লেখা শুরু করেছেন খোলা চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণের সময় থেকে। অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনা কাল থেকে। বিজ্ঞানের এই শাখাটির সূচনা হয়েছিল প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের হাতে। তখনকার দিনে মাথার ওপরে থাকা খোলা আকাশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা দিয়ে দ্য থিওরি অব এভরিথিংয়ের যাত্রা শুরু। যেখানে তিনি জিওসেন্ট্রিক বা ভূকেন্দ্রিক এবং হেলিওসেন্ট্রিক বা সূর্যকেন্দ্রিক মডেলের উৎপত্তি, ধারণা ও ভুল নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। এখান থেকে শুরু করে তিনি গ্যালিলিওর দুরবিন থেকে কেপলারের হাইপোথিসস, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতার ধারণার জন্ম, মহাবিশ্বের সূচনা অব্দি উপস্থাপন করেছেন প্রথম বক্তৃতায়। বক্তৃতার নাম: মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণা।

মহাবিশ্বের সূচনা হয়েই যে সব থেমে আছে, এমন নয়। আমাদের এই মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের এই যে বিবর্তন হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করতে গেলে সাধারণ আপেক্ষিকতার জটিল সব সমীকরণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এ সময়ই গাণিতিক ঝামেলা এড়িয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে দুটি সহজ ভবিষ্যদ্বাণী এসেছিল, যাকে ফ্রিডম্যানের মডেল বলা হয়। ফ্রিডম্যানের এই মডেলেই মহাজাগতিক পরম বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের সূচনা। অর্থাৎ এ থেকে মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের ধারণা পাওয়া যায়। আর মহাবিস্ফোরণ নিয়ে যত প্রশ্ন ও কৌতূহলের সমাধাও দিয়েছেন দ্বিতীয় বক্তৃতায়। অর্থাৎ, ‘প্রসারণশীল মহাবিশ্ব’ অধ্যায়ে।

দ্য থিওরি অব এভরিথিং: মহাবিশ্বের জন্ম এবং শেষ পরিণতি বইয়ের প্রচ্ছদ

একনজরে

দ্য থিওরি অব এভরিথিং: মহাবিশ্বের জন্ম এবং শেষ পরিণতি

মূল: স্টিফেন হকিং

অনুবাদ: আবুল বাসার

প্রচ্ছদ: মাহবুব রহমান

প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

পৃষ্ঠা: ১৫১

দাম: ৩৭০

পুরো বইজুড়ে হকিং পাঠকদের বাস্তবতার প্রকৃতি ও মানুষের জ্ঞানের সীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ওপর কৌতূহল এবং সংশয়বাদ নিরসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন, পাঠকদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রশ্ন করতে ও নতুন ধারণাগুলো অন্বেষণ করতে

এই দুটো অধ্যায় থেকে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আপনার কৌতূহলী মনের তৃষ্ণা মিটবে। পাশাপাশি একুশ শতক অব্দি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক এ যাত্রায় উনিশ শতকের শুরুর আইনস্টাইন কিংবা একুশ শতকের রজার পেনরোজের মতো বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে ধারণা লাভ করবেন আপনি।

হকিং তাঁর তৃতীয় বক্তৃতা, অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বর অধ্যায়টি কৃষ্ণগহ্বর তথা ব্ল্যাকহোলের ধারণা ও উৎপত্তি ব্যাখ্যার মাধ্যমে শুরু করেছেন। যেখানে তিনি নক্ষত্রের জীবনচক্রের বিশদ আলোচনার মাধ্যমে চন্দ্রশেখর সীমারেখা অতিক্রম করে বেশি ভরের নক্ষত্রকে চুপসে যাওয়া থেকে পাউলির বর্জন নীতি রক্ষা করতে না পারার সমস্যার মতো জটিল বিষয় উপস্থাপন করেছেন সহজে। এ সমস্যা তিনি রেখেই দেননি, বরং পারমাণবিক বোমার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ওপেইনহাইমার এ সমস্যা নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। পরে হকিং কৃষ্ণগহ্বর কীভাবে গঠিত হয় এবং এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য কেমন, এসব নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

পরের বক্তৃতা, অর্থাৎ চতুর্থ বক্তৃতা: কৃষ্ণগহ্বর অত কালো নয়। এ অধ্যায়ে পেনরোজের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন, তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সুত্রের সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপিবিষয়ক সমস্যা, কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ ও কৃষ্ণগহ্বরের শক্তি, এর অন্তিম পরিণতি বা বিস্ফোরণ, সবচেয়ে প্রাচীন কৃষ্ণগহ্বরসহ আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন কোনো গাণিতিক সমীকরণের ওপর নির্ভর করা ছাড়াই। এর পরেই তিনি যে দুটো তত্ত্বের (সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা) ওপর নির্ভর করে কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা নিয়ে সাধারণ আলোচনা করেছেন‌।

প্রথম বক্তৃতায় হকিং মহাবিশ্বের সূচনা নিয়ে সামান্য আলোচনা করেই প্রসঙ্গটি ভুলে যাননি। তাই বইটির পঞ্চম বক্তৃতা: মহাবিশ্বের জন্ম ও শেষ পরিণতি। এ অধ্যায়ে মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল, মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানমহলে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কোয়ান্টাম মহাকর্ষ, অস্থিতিশীল মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন হকিং।

পরের বক্তৃতায় তিনি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সঙ্গে সময়ের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। আর সর্বশেষ বক্তৃতায় সার্বিক তত্ত্ব—স্ট্রিং থিওরি ও বহুমাত্রিক বিশ্বের মতো জটিল ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করেছেন সহজ ভাষায়।

দ্য থিওরি অব এভরিথিং বইটা আমাদের মহাবিশ্ব এবং রহস্যময় মহাজাগতিক বস্তু কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করবে। এই বইয়ে তিনি আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করেছেন। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ছাড়াও, হকিং তাঁর নিজের জীবন ও কাজের প্রতিফলন, ব্যক্তিগত মহাজাগতিক উপাখ্যান এবং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের প্রকৃতির সম্পর্কেও বলেছেন অকুণ্ঠভাবে। অসুস্থতা জনিত শারীরিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের জন্য হকিংয়ের ইচ্ছা তাঁর লেখায় বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়, পাঠকদের মহাজগতে তাঁদের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করে।

পুরো বইজুড়ে হকিং পাঠকদের বাস্তবতার প্রকৃতি ও মানুষের জ্ঞানের সীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ওপর কৌতূহল এবং সংশয়বাদ নিরসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন, পাঠকদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রশ্ন করতে ও নতুন ধারণাগুলো অন্বেষণ করতে।

সামগ্রিকভাবে দ্য থিওরি অফ এভরিথিং একটি চিন্তাশীল বই। পদার্থবিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্বের প্রতি কৌতুহলী যেকোনো বিজ্ঞানমনার তৃষ্ণা মেটাতে বইটি যথেষ্ট। স্টিফেন হকিংয়ের চিন্তাভাবনায় এই বই লেখা হলেও, বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক ও অনুবাদক আবুল বাসারের আকর্ষণীয় গদ্য বইটিকে সর্বস্তরের বাঙালি পাঠকের কাছে বোধগম্য করে তুলেছে। সে জন্যই, আমার ধারণা, এ অনুবাদ বইটি বর্তমান সময়ে পদার্থবিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্বের অন্যতম সেরা বইয়ের স্থান লাভ করেছে।