সমুদ্র যদি কেড়ে নেয় প্রাণ, ক্ষেপে যায় প্রকৃতি

কক্সবাজারে ভেসে এল বিরল প্রজাতির এক ডলফিনের মরদেহ। বিরল বলাটা ঠিক হলো না। ২০০৬ সালে ‘বেইজি’ নামের এই প্রজাতির শেষ সদস্য মারা গেছে চীনের ইয়াংঝু নদীতে। বিলুপ্ত সেই প্রজাতির ডলফিন কক্সবাজারে এল কোত্থেকে? বিরল দুটো রেড হ্যান্ড ফিশ কক্সবাজার মেরিন অ্যাকুয়ারিয়ামের জারে কোত্থেকে এল?

প্রকৃতি যেন ক্ষেপে গেছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সিজিএস শ্যামল বাংলা পেট্রল ভেসেল ছিন্ন ভিন্ন করে দিল সমুদ্র গহিনের বুদ্ধিমান এক প্রাণী—অক্টোপাস। আটটি শুঁড়ে আটটি মস্তিষ্ক, আরেকটি কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে বাকিগুলোকে। নয় মস্তিষ্কের এই বুদ্ধিমান প্রাণী কি মানুষের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান?

বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞান কল্পগল্পের প্রচলিত ধারাটি মূলত থ্রিলার ঘরানার, যাতে মহাকাশ, রোবট ও এআই এবং সংশ্লিষ্ট এরকম কিছু বিষয়ই ঘুরে ফিরে আসে বারবার। এই ধারার বেড়াজাল ভেঙেছেন তানজিনা হোসেন

কারফিউ জারি করা হয়েছে কক্সবাজারে। মানুষ মারা যাচ্ছে একের পর এক। কক্সবাজার হ্যাজ ফলেন! শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে নিরীহ প্রাণীগুলো হামলা করছে পর্যটকদের ওপর। কক্সবাজারে মেরিন বায়োলজিস্ট রুনা খন্দকার ও স্থানীয় সাংবাদিক অর্জুন মারমা চেষ্টা করছে এই সমস্যার কিনারা করার। তারা কি আদৌ সফল হবে? নাকি মানুষের চোখের আড়ালে, সমুদ্রের গহিনে আরও বুদ্ধিমান ও দক্ষ কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব আছে; যারা আজ পৃথিবীর দখল নিতে উঠে পড়ে লেগেছে—তারাই জিতে যাবে শেষতক? রুনা খন্দকার পাগল হয়ে যাচ্ছেন, মাছ হয়ে যেতে চাইছে অর্জুন।  আর মেরিন অ্যাকুয়ারিয়ামের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আজিজের মনে হচ্ছে, ল্যাবে খুব বাজে কিছু আছে। কী হচ্ছে আসলে?

এই প্রশ্নের জবাবই শুধু নয়, দুই মলাটে সমুদ্রের বুকের ভেতরের ধূসর সিন্দুকটি মেলে ধরেছেন চিকিৎসক, বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান লেখক তানজিনা হোসেন। বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞান কল্পগল্পের প্রচলিত ধারাটি মূলত থ্রিলার ঘরানার, যাতে মহাকাশ, রোবট ও এআই এবং সংশ্লিষ্ট এরকম কিছু বিষয়ই ঘুরে ফিরে আসে বারবার। এই ধারার বেড়াজাল ভেঙেছেন তানজিনা হোসেন। তাঁর সায়েন্স ফিকশনে উঠে আসে প্রকৃতি ও জীবনের, জীববিজ্ঞানের নানা বিষয়। থ্রিল বা রোমাঞ্চটুকু অটুট রেখে, গল্পের ঠাস বুনোটে উঠে আসে দর্শন। প্রশ্ন করে—কখনো জবাব দেয়, কখনো জবাবটুকু তোলা থাকে পাঠকের জন্য।

লেখকের গদ্য স্বাদু। কক্সবাজারের ঘটনায় স্থানীয়দের ভাষা তুলে এনেছেন, তাতে ‘অরিজিনালিটি’ এসেছে। পড়ে তৃপ্তি হয়। তবু বইটি শেষ করে কিছু প্রশ্ন রয়ে যায় মনে। এই প্রশ্নগুলো—লেখক যেসব প্রশ্নের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন, সেগুলো নয়; বরং প্রশ্নগুলোর যেন উত্তর নেই

এই বইটিতেও তাঁর সেই সিগনেচার টোন আছে। প্রাণ ও প্রকৃতি যেমন এসেছে, তেমনি মানুষই প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে কি না; ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব কি এক—এরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে। বইটি পাঠককে ভাবতে বাধ্য করবে, আগ্রহ উসকে দেবে—পাতায় পাতায় টান টান উত্তেজনা তাকে নিয়ে যাবে গল্পের শেষ প্রান্তে, তারপর দাঁড় করিয়ে দেবে নিজেদের এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিসের সামনে।

লেখকের গদ্য স্বাদু। কক্সবাজারের ঘটনায় স্থানীয়দের ভাষা তুলে এনেছেন, তাতে ‘অরিজিনালিটি’ এসেছে। পড়ে তৃপ্তি হয়। তবু বইটি শেষ করে কিছু প্রশ্ন রয়ে যায় মনে। এই প্রশ্নগুলো—লেখক যেসব প্রশ্নের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন, সেগুলো নয়; বরং প্রশ্নগুলোর যেন উত্তর নেই। যেমন কক্সবাজারের এক অ্যাকুয়ারিয়ামে রেড হ্যান্ড ফিশ কীভাবে এল? বুদ্ধিমান এক প্রাণের বদলে যাওয়ার ঘটনার ইঙ্গিত  ও কক্সবাজারের শেষ পরিণতি ‘ওপেন এন্ডেড’ হলেও তার যেমন জবাব পাওয়া যায়, এই প্রশ্নের সেরকম জবাব পাওয়া যায় না। সোয়ার্ম ইনটেলিজেন্স বা সমন্বিত বুদ্ধিমত্তার ধারণা রয়েছে প্রকৃতিতে। অনেক মৌমাছি একসঙ্গে মিলে কাজ করে। কিন্তু কক্সবাজারের জারের ভেতরে থাকা অক্টোপাস কেমন করে যোগাযোগ করছে সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণের সঙ্গে—এই প্রশ্নের জবাব যেন ঠিক মেলে না। এখানে এসে বইটি সায়েন্স ফিকশনের সীমা পেরিয়ে যেন সায়েন্স ফ্যান্টাসি হয়ে যায় অনেকাংশে। সঙ্গে ধাক্কা দেয় কিছু অতৃপ্তি। বইটির পরিসর হয়তো আরও বড় হতে পারত—মানুষ মারা যাচ্ছে, পাগল হয়ে যাচ্ছে, যুক্তির সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তথ্য ও ঘটনার ঘনঘটায় পাঠক যেন তা ঠিক উপলব্ধির যথেষ্ট সময় পাচ্ছে না। অবশ্য টান টান উত্তেজনার গল্প যাঁরা পড়তে চান, এটাকে ‘প্লাস পয়েন্ট’ হিসেবেও দেখতে পারেন—দম ফেলতে ভুলে যেতে পারেন কেউ কেউ।

একনজরে

সমুদ্র এক ধূসর সিন্দুক

তানজিনা হোসেন

প্রকাশক: বাতিঘর

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রি

পৃষ্ঠা: ১১২

দাম: ২৬০ টাকা

ভিন্ন স্বাদের, নতুন ধরনের সায়েন্স ফিকশন যাঁরা পড়তে চান; প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মানুষের আচরণের নির্মম দিকটি বুঝতে চান; অজানা ও গল্পের চেয়েও অদ্ভুত বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, তানজিনা হোসেনের সমুদ্রের ধূসর সিন্দুক তাঁদের জন্য; কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য

বইটির নামের যথার্থতা বোঝা যাবে শেষে এসে। চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রি। এক-দু জায়গার মুদ্রণ প্রমাদ বা বাক্যের সামান্য ত্রুটি—যেমন ‘প্রতিদিনের মতো অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ ও প্রাণীগুলোকে খাবার দিতে গিয়ে আজও বিশেষ জারটার সামনে এসে বদলে গেল আজিজ মিয়ার।’—বাদ দিলে বলতে হয়, দারুণ উপভোগ্য এক বই।

ভিন্ন স্বাদের, নতুন ধরনের সায়েন্স ফিকশন যাঁরা পড়তে চান; প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মানুষের আচরণের নির্মম দিকটি বুঝতে চান; অজানা ও গল্পের চেয়েও অদ্ভুত বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, তানজিনা হোসেনের সমুদ্রের ধূসর সিন্দুক তাঁদের জন্য; কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য। বইটি যেন প্রচলিত কল্পবিজ্ঞানের ভীড়ে একরাশ মুক্ত বাতাস। একদম দেশি ফ্লেভারের এই সায়েন্স ফিকশনের রেশ মনে দাগ কেটে যাবে, এটুকু বলা যায়। পাওয়া যাবে বাতিঘর-এর স্টল ও আউটলেটে এবং অনলাইন ও অফলাইন বুকশপগুলোতে।